অবশেষে সশরীরে রমণীর অবতারণা করিতে হইল । পুলিসের বেতনভোগী হরিমতি আমার সহায় হইল । মন্মথকে জানাইলাম , আমি এই হরিমতির হতভাগ্য প্রণয়াকাঙক্ষী , ইহাকে লক্ষ্য করিয়াই আমি কিছুদিন গোলদিঘির ধারে মন্মথের পার্শ্বচর হইয়া ‘ আবার গগনে কেন সুধাংশু-উদয় রে ‘ কবিতাটি বারংবার আবৃত্তি করিলাম ; এবং হরিমতিও কতকটা অন্তরের সহিত , কতকটা লীলাসহকারে জানাইল যে , তাহার চিত্ত সে মন্মথকে সমর্পণ করিয়াছে। কিন্তু আশানুরূপ ফল হইল না , মন্মথ সুদূর নির্লিপ্ত অবিচলিত কৌতূহলের সহিত সমস্ত পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিল ।
এমন সময় একদিন মধ্যাহ্নে তাহার ঘরের মেজেতে একখানি চিঠির গুটিকতক ছিন্নাংশ কুড়াইয়া পাইলাম । জোড়া দিয়া দিয়া এই অসম্পূর্ণ বাক্যটুকু আদায় করিলাম , “ আজ সন্ধ্যা সাতটার সময় গোপনে তোমার বাসায় ”— অনেক খুঁজিয়া আর কিছু বাহির করিতে পারিলাম না ।
আমার অন্তঃকরণ পুলকিত হইয়া উঠিল ; মাটির মধ্য হইতে কোনো বিলুপ্তবংশ প্রাচীন প্রাণীর একখণ্ড হাড় পাইলে প্রত্নজীবতত্ত্ববিদের কল্পনা যেমন মহানন্দে সজাগ হইয়া উঠে আমারও সেই অবস্থা হইল ।
আমি জানিতাম , আজ রাত্রি দশটার সময় আমাদের বাসায় হরিমতির আবির্ভাব হইবার কথা আছে , ইতিমধ্যে সন্ধ্যা সাতটার সময় ব্যাপারখানা কী । ছেলেটির যেমন সাহস তেমনি তীক্ষ্ম বুদ্ধি । যদি কোনো গোপন অপরাধের কাজ করিতে হয় তবে ঘরে যেদিন কোনো-একটা বিশেষ হাঙ্গামা সেইদিন অবকাশ বুঝিয়া করা ভালো । প্রথমত প্রধান ব্যাপারের দিকে সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট থাকে , দ্বিতীয়ত যেদিন যেখানে কোনো বিশেষ সমাগম আছে সেদিন সেখানে কেহ ইচ্ছাপূর্বক কোনো গোপন ব্যপারের অনুষ্ঠান করিবে ইহা কেহ সম্ভব মনে করে না ।
হঠাৎ আমার সন্দেহ হইল যে , আমার সহিত এই নূতন বন্ধুত্ব এবং হরিমতির সহিত এই প্রেমাভিনয় , ইহাকেও মন্মথ আপন কার্যসিদ্ধির উপায় করিয়া লইয়াছে ; এই জন্যই সে আপনাকে ধরাও দেয় না , আপনাকে ছাড়াইয়াও লয় না । আমরা তাহাকে তাহার গোপন কার্য হইতে আড়াল করিয়া রাখিয়াছি ; সকলেই মনে করিতেছে যে সে আমাদিগকে লইয়াই ব্যাপৃত রহিয়াছে — সেও সেই ভ্রম দূর করিতে চায় না ।
তর্কগুলা একবার ভাবিয়া দেখো । যে বিদেশী ছাত্র ছুটির সময় আত্মীয়স্বজনের অনুনয়বিনয় উপেক্ষা করিয়া শূন্য বাসায় একলা পড়িয়া থাকে , নির্জন স্থানে তাহার বিশেষ প্রয়োজন আছে এ বিষয়ে কাহারো সংশয় থাকিতে পারে না , অথচ আমি তাহার বাসায় আসিয়া তাহার নির্জনতা ভঙ্গ করিয়াছি, এবং একটা রমণীর অবতারণা করিয়া নূতন উপদ্রব সৃজন করিয়াছি ; কিন্তু ইহা সত্ত্বেও সে বিরক্ত হয় না , বাসা ছাড়ে না , আমাদের সঙ্গ হইতে দূরে থাকে না — অথচ হরিমতি অথবা আমার প্রতি তাহার তিলমাত্র আসক্তি জন্মে নাই ইহা নিশ্চয় সত্য , এমন-কি তাহার অসতর্ক অবস্থায় বারংবার লক্ষ্য করিয়া দেখিয়াছি , আমাদের উভয়ের প্রতি তাহার একটা আন্তরিক ঘৃণা ক্রমেই যেন প্রবল হইয়া উঠিতেছে ।
ইহার একমাত্র তাৎপর্য এই যে , সজনতার সাফাইটুকু রক্ষা করিয়া নির্জনতার সুবিধাটুকু ভোগ করিতে হইলে আমার মতো নবপরিচিত লোককে নিকটে রাখা সর্বাপেক্ষা সদুপায় ; এবং কোনো বিষয়ে একান্তমনে লিপ্ত হওয়ার পক্ষে রমণীর মতো এমন সহজ ছুতা আর কিছু নাই । ইতিপূর্বে মন্মথর আচরণ যেরূপ নিরর্থক এবং সন্দেহজনক ছিল , আমাদের আগমনের পর তাহা সম্পূর্ণ লোপ হইল । কিন্তু এতটা দূরের কথা মুহূর্তের মধ্যে বিচার করিয়া দেখিতে পারে , এত বড়ো মৎলবী লোক যে আমাদের বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করিতে পারে ইহা চিন্তা করিয়া আমার হৃদয় উৎসাহে পূর্ণ হইয়া উঠিল — মন্মথ কিছু যদি মনে না করিত , তবে আমি বোধহয় তাহাকে দুই হাতে বক্ষে চাপিয়া ধরিতে পারিতাম ।
সেদিন মন্মথর সঙ্গে দেখা হইবামাত্র তাহাকে বলিলাম , “ আজ তোমাকে সন্ধ্যা সাতটার সময় হোটেলে খাওয়াইব সংকল্প করিয়াছি । ” শুনিয়া সে একটু চমকিয়া উঠিল , পরে আত্মসংবরণ করিয়া কহিল , “ ভাই , মাপ করো , আমার পাকযন্ত্রের অবস্থা আজ বড়ো শোচনীয় । ” হোটেলের খানায় মন্মথর কখনো কোনো কারণে অনভিরুচি দেখি নাই , আজ তাহার অন্তরিন্দ্রিয় নিশ্চয়ই নিতান্তই দুরূহ অবস্থায় উপনীত হইয়াছে ।
সেদিন সন্ধ্যার পূর্বভাগে আমার বাসায় থাকিবার কথা ছিল না । কিন্তু আমি সেদিন গায়ে পড়িয়া নানা কথা পাড়িয়া বৈকালের দিকে কিছুতেই আর উঠিবার গা করিলাম না । মন্মথ মনে মনে অস্থির হইয়া উঠিতে লাগিল , আমার সকল মতের সঙ্গেই সে সম্পূর্ণ সম্মতি প্রকাশ করিল , কোনো তর্কের কিছুমাত্র প্রতিবাদ করিল না । অবশেষে ঘড়ির দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া ব্যাকুলচিত্তে উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল , “ হরিমতিকে আজ আনিতে যাইবে না ?” আমি সচকিত ভাবে কহিলাম “ হ্যাঁ হ্যাঁ সে কথা ভুলিয়া গিয়াছিলাম । তুমি ভাই আহারাদি প্রস্তুত করিয়া রাখো , আমি ঠিক সাড়ে দশটা রাত্রে তাহাকে এখানে আনিয়া উপস্থিত করিব । ” এই বলিয়া চলিয়া গেলাম ।
আনন্দের নেশা আমার সর্বশরীরের রক্তের মধ্যে সঞ্চরণ করিতে লাগিল । সন্ধ্যা সাত ঘটিকার প্রতি মন্মথের যেপ্রকার ঔৎসুক্য দেখিলাম আমার ঔৎসুক্য তদপেক্ষা অল্প ছিল না, আমি আমাদের বাসার অনতিদূরে প্রচ্ছন্ন থাকিয়া প্রেয়সীসমাগমোৎকণ্ঠিত প্রণয়ীর ন্যায় মুহুর্মুহু ঘড়ি দেখিতে লাগিলাম । গোধূলির অন্ধকার ঘনীভূত হইয়া যখন রাজপথে গ্যাস জ্বালিবার সময় হইল এমনসময় একটি রূদ্ধদ্বার পাল্কি আমাদের বাসার মধ্যে প্রবেশ করিল । ঐ আচ্ছন্ন পাল্কিটির মধ্যে একটি অশ্রুসিক্ত অবগুণ্ঠিত পাপ , একটি মূর্তিমতী ট্র্যাজেডি কলেজের ছাত্রনিবাসের মধ্যে গুটিকতক উড়ে বেহারার স্কন্ধে চাপিয়া সমুচ্চ হাঁই-হুঁই শব্দে অত্যন্ত অনায়াসে সহজভাবে প্রবেশ করিতেছে কল্পনা করিয়া আমার সর্বশরীরে অপূর্ব পুলকসঞ্চার হইল ।
আমি আর বিলম্ব করিতে পারিলাম না । অনতিকাল পরে ধীরে ধীরে সিঁড়ি বাহিয়া দোতলায় উঠিলাম । ইচ্ছা ছিল , গোপনে লুকাইয়া দেখিয়া-শুনিয়া লইব , কিন্তু তাহা ঘটিল না ; কারণ সিঁড়ির সম্মুখবর্তী ঘরেই সিঁড়ির দিকে মুখ করিয়া মন্মথ বসিয়াছিল , এবং গৃহের অপর প্রান্তে বিপরীতমুখে একটি অবগুণ্ঠিতা নারী বসিয়া মৃদুস্বরে কথা কহিতেছিল । যখন দেখিলাম মন্মথ আমাকে দেখিতে পাইয়াছে , তখন দ্রুত ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়াই বলিলাম ,
“ ভাই , আমার ঘড়িটা ঘরে ফেলিয়া আসিয়াছি , তাই লইতে আসিলাম । ” মন্মথ এমনি অভিভূত হইয়া পড়িল যে , বোধ হইল যেন তখনি সে মাটিতে পড়িয়া যাইবে । আমি কৌতুক এবং আনন্দে নিরতিশয় ব্যগ্র হইয়া উঠিলাম, বলিলাম , “ ভাই , তোমার অসুখ করিয়াছে না কি । ” সে কোনো উত্তর দিতে পারিল না । তখন সেই কাষ্ঠপুত্তলিকাবৎ আড়ষ্ট অবগুণ্ঠিত নারীর দিকে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম , “ আপনি মন্মথর কে হন । ” কোনো উত্তর পাইলাম না , কিন্তু দেখিলাম , তিনি মন্মথর কেহই হন না , আমারই স্ত্রী হন। তাহার পর কী হইল সকলে জানেন ।
এই আমার ডিটেক্টিভ-পদের প্রথম চোর ধরা ।
আমি কিয়ৎক্ষণ পরে ডিটেক্টিভ মহিমচন্দ্রকে কহিলাম , “ মন্মথর সহিত তোমার স্ত্রীর সম্বন্ধ সমাজবিরুদ্ধ না হইতেও পারে । ”
মহিম কহিল , “ না হইবারই সম্ভব । আমার স্ত্রীর বাক্স হইতে মন্মথর এই চিঠিখানি পাওয়া গেছে । ” বলিয়া একখানি চিঠি আমার হাতে দিল ; সেখানি নিম্নে প্রকাশিত হইল। —
সুচরিতাসু ,
হতভাগ্য মন্মথর কথা তুমি বোধকরি এতদিনে ভুলিয়া গিয়াছ । বাল্যকালে যখন কাজিবাড়ির মাতুলালয়ে যাইতাম , তখন
সর্বদাই সেখান হইতে তোমাদের বাড়ি গিয়া তোমার সহিত অনেক খেলা করিয়াছি । আমাদের সে খেলাঘর এবং সে খেলার সম্পর্ক ভাঙিয়া গেছে । তুমি জান কি না বলিতে পারি না , একসময় ধৈর্যের বাঁধ ভাঙিয়া এবং লজ্জার মাথা খাইয়া তোমার সহিত আমার বিবাহের সম্বন্ধ-চেষ্টাও করিয়াছিলাম , কিন্তু আমাদের বয়স প্রায় এক বলিয়া উভয় পক্ষেরই কর্তারা কোনোক্রমে রাজি হইলেন না ।
তাহার পর তোমার বিবাহ হইয়া গেলে চার-পাঁচ বৎসর তোমার আর কোনো সন্ধান পাই নাই । আজ পাঁচ মাস হইল তোমার স্বামী কলিকাতার পুলিসের কর্ম লইয়া শহরে বদলি হইয়াছেন , খবর পাইয়া আমি তোমাদের বাসা সন্ধান করিয়া বাহির করিয়াছি ।
তোমার সহিত সাক্ষাতের দুরাশা আমার নাই এবং অন্তর্যামী জানেন , তোমার গার্হস্থ্যসুখের মধ্যে উপদ্রবের মতো প্রবেশলাভ করিবার দুরভিসন্ধিও আমি রাখি না । সন্ধ্যার সময় তোমাদের বাসার সম্মুখবর্তী একটি গ্যাস্ পোস্টের তলে আমি সূর্যোপাসকের ন্যায় দাঁড়াইয়া থাকি , তুমি ঠিক সাড়ে সাতটার সময় একটি প্রজ্বলিত কেরোসিন ল্যাম্প্ লইয়া প্রত্যহ নিয়মিত তোমাদের দোতলার দক্ষিণদিকের ঘরের কাঁচের জানলাটির সম্মুখে স্থাপন কর ; সেইসময় মুহূর্তকালের জন্য তোমার দীপালোকিত প্রতিমাখানি আমার দৃষ্টিপথে উদ্ভাসিত হইয়া উঠে , তোমার সম্বন্ধে আমার এই একটিমাত্র অপরাধ ।
ইতিমধ্যে ঘটনাক্রমে তোমার স্বামীর সহিত আমার আলাপ এবং ক্রমে ঘনিষ্ঠতাও হইয়াছে । তাঁহার চরিত্র যেরূপ দেখিলাম তাহাতে বুঝিতে বাকি নাই যে , তোমার জীবন সুখের নহে । তোমার প্রতি আমার কোনোপ্রকার সামাজিক অধিকার নাই কিন্তু যে বিধাতা তোমার দুঃখকে আমার দুঃখে পরিণত করিয়াছেন তিনি সে দুঃখমোচনের চেষ্টাভার আমার উপরেই স্থাপন করিয়াছেন ।
অতএব আমার স্পর্ধা মাপ করিয়া শুক্রবার সন্ধ্যাবেলায় ঠিক সাতটার সময় গোপনে পাল্ কি করিয়া একবার বিশ মিনিটের জন্য আমার বাসায় আসিলে আমি তোমাকে তোমার স্বামী সম্বন্ধে কতকগুলি গোপন কথা বলিতে চাহি , যদি বিশ্বাস না কর এবং যদি সহ্য করিতে পার তবে তৎসম্বন্ধে প্রমাণও দেখাইতে পারি , এবং সেই সঙ্গে কতকগুলি পরামর্শ দিতেও ইচ্ছা করি ; আমি ভগবানকে অন্তরে রাখিয়া আশা করিতেছি , সেই পরামর্শ মতে চলিলে তুমি একদিন সুখী হইতে পারিবে ।
আমার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ নহে, ক্ষণকালের জন্য তোমাকে সম্মুখে দেখিব , তোমার কথা শুনিব এবং তোমার চরণতলস্পর্শে আমার গৃহখানিকে চিরকালের জন্য সুখস্বপ্নমণ্ডিত করিয়া তুলিব , এ আকাঙক্ষাও আমার অন্তরে আছে । যদি আমাকে বিশ্বাস না কর এবং যদি এ সুখ হইতেও আমাকে বঞ্চিত করিতে চাও, তবে সেকথা আমাকে লিখিয়ো , আমি তদুত্তরে পত্রযোগেই সকল কথা জানাইব । যদি চিঠি লিখিবার বিশ্বাসও না থাকে তবে আমার এই পত্রখানি তোমার স্বামীকে দেখাইয়ো , তাহার পরে আমার যাহা বক্তব্য তাহা তাঁহাকেই বলিব ।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।