ঠাকুমার আয়ান–শেষ পর্ব

 

উচ্চমাধ্যমিকে তোর ভাল রেজাল্ট হবে না তুই ধরে নিচ্ছিস কেন ?

না না ‚ তা বলছিল না | আমি প্রাণপণে চেষ্টা করব যাতে রেজাল্ট ভাল হয় | হবেও নিশ্চয় | কিন্তু যদি ধর কোনও কারণে খারাপ রেজাল্ট হয়ে যায় ‚ তখন্………| আমি যে সাবজেক্ট নিয়েই পড়ি না কেন ‚ যাই-ই পড়ি না কেন ‚তুমি শুধু কথা দাও আমাকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেবে |

এ আবার কি অলুক্ষুণে কথা মুন্নি! তোর কি বাড়িতে থাকতে ভাল লাগে না?

মায়ের প্রশ্নের কোনও উত্তর দেয় না মুন্নি | শক্ত মুখে চুপ করে | মা কিন্তু থামেন না ‚

এত আদরযত্ন ‚সারক্ষণ তোমার পিছনেই লেগে আছি ‚ কী করে আরও একটু ভাল হয়্….|

মায়ের কথার মাঝখানেই বাধা দিয়ে মুন্নি বলে ওঠে ‚

ওইজন্যই তো ভাল লাগে না | অত আদরযত্নের আমার দরকার নেই |

তা তো বলবেই | রূপ যেটুকু সে তো আমার জন্যই | নাহলে তো…|
মায়ের গজগজানি চলতে থাকে | মুন্নি আর কোনও কথা বলে না | বাবাও বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে কী যেন বোঝার চেষ্টা করেন ‚ তারপর বলেন,

ঠিক আছে | তাই হবে | তবে আমি আশা করব ‚ তুমি ভাল কোনও কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্যই চেষ্টা করবে |

উচ্চমাধ্যমিকের দুটো বছর কেমন যেন ঘোরের মধ্যে কাটে মুন্নির | পড়ার চাপ যথেষ্ট | কিন্তু সেটাই সব নয় | সে যেন কেমন একটা পড়াশোনার মধ্যে ডুবে গেছে | ঘন্টার পর ঘন্টা অঙ্ক করে যায় | ফিজিক্সের কঠিন কঠিন প্রবলেম অনায়াসে সলভ করে | কেমিস্ট্রির লম্বা লম্বা রিআকশন দিব্যি মনে রাখে | বন্ধুদের সঙ্গে গল্পগুজব ‚ টুকটাক সিনেমা দেখা ‚ গান শোনা এসব আছে ঠিকই | কিন্তু তার মাঝেও পড়াশোনাটাই যেন তার ধ্যানজ্ঞান | আর একটা জিনিস অবশ্য একদম বন্ধ হয়ে গেছে ‚ সেটা হল রূপচর্চা |
উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার পর সুতনুকা হাজার চেষ্টা করেও আর মেয়েকে একদিনের জন্য কোনওরকম রূপটান মাখাতে পারেননি |ফলে সারাক্ষণই তাঁর মনে হয় মুন্নির মুখটা খসখসে হয়ে যাচ্ছে ‚ চুল ম্যাড়মেড়ে হয়ে যাচ্ছে ‚ চেহারায় যেন কোনও জৌলুস নেই | কিন্তু মেয়ের তাতে কিছু তাতে কিছু আসে যায় না | মায়ের হাজার রকম সাবধাবাণীতে সে কান পর্যন্ত দেয় না |

এন্ট্রান্স পরীক্ষাগুলোর ফল বেরোতে শুরু করল | আইআইটি-র লিস্ট বেরোতে দেখা গেল ‚নাম রয়েছে মুন্নির | র্যা ঙ্কও বেশ ভালই | দিল্লিতে পাবে | আবার পছন্দসই সাবজেক্ট নিয়ে খড়গপুরে ভর্তি হতেও অসুবিধা নেই |

খড়গপুরেই ভর্তি হবি তো ? বাড়ির কাছে | আসা-যাওয়া করতে অসুবিধা নেই |

বাবার প্রশ্নের উত্তরে মুন্নি শান্তভাবে জানিয়ে দেয় ‚

যদি সেকেন্ড চয়েসও পাই ‚ তাহলেও দিল্লিতেই পড়ব |

আর যদি যাদবপুর পাস ? বাবার গলা কেমন একটু করুণ শোনায় |

ওটা নিয়ে আমি ভাবছিই না | তুমি তো আমাকে কথা দিয়েছিলে….

হাঁ নিশ্চয় | তুই যেখানে চাইবি সেখানেই ভর্তি করব |

বেঙ্গল জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোল সকালবেলা | নিজের কোনও আগ্রহ ছিল না বলে টেলিভিশনটা খোলেনি মুন্নি | কিন্তু একটু পরেই মুহুর্মুহু ফোন বাজতে লাগল বাড়িতে | আত্নীয়-স্বজন ‚ বন্ধুবান্ধব সবাই ফোন করছে | করবেই তো | ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ এবার প্রথম হয়েছে কলকাতার কৃষ্ণকলি মিত্র | খবরটা শুনে মুন্নি বেশ একটু থতমত | ভাল রেজাল্ট হবে ভেবেছিল | কিন্তু একেবারে ফার্স্ট তো ভাবেনি |

একটু পরেই ঘর ভরে গেল ক্যামেরা ঘাড়ে নেওয়া সাংবাদিকদের দলে | নানা রকম প্রশ্ন | উত্তরও নানা রকম | শুধু একটা উত্তর সব ক্ষেত্রেই এক ‚ ফার্স্ট হলেও কলকাতায় পড়বে না মুন্নি | ভর্তি হবে আইআইটি দিল্লিতে |

সাংবাদিকের দল ঘিরে ধরেছে মুন্নিকে | ঘন ঘন ক্যামেরার শাটার টেপার শব্দ | আলো ঠিকঠাক পাওয়া যাবে বলে বারান্দায় চলে গেছে সবাই | ঘরে বসে দেখতে মায়ের মনে হল্‚
ইস ‚ এত গুণের মেয়েটা | এত ভাল রেজাল্ট করল | এত ছবি উঠছে | কাল নিশ্চয় সব কাগজের ছবি ছাপা হবে ….| শুধু যদি দেখতে একটু ভাল হতো..

ভাবতে ভাবতে বারন্দার দিকে চোখ চলে যায় মায়ের | একটা বেতের চেয়ারে বসে আছে মুন্নি | বাইরের শিরীষগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো আলতোভাবে এসে পড়েছে | চমকে উঠে সুতনুকা দেখেন, আরে! মেয়ে তো তাঁর দারুণ সুন্দরী | ঝকঝক করছে বুদ্ধিদীপ্ত দুই চোখ | হেসে হেসে কথা বলছে | ঠোঁটের ভাঁজে, গালের টোলে ঝিকিয়ে উঠছে লাবণ্য | কপালের ওপর নেমে আসা অল্প একটু ঝুরো চুলে মুখখানা অপরূপ মায়াময় | কবে থেকে এত সুন্দর দেখতে হল মুন্নিকে ? অবাক হয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবেন সুতনুকা | মনের ভিতর তাঁর উথাল-পাথাল হতে থাকে |

ইন্টারভিউ হয়ে গেছে | বেশিরভাগ সাংবাদিকই চলে গেছে | একটা দল অবশ্য এখনও বসে আছে | তারা মুন্নিকে স্টুডিওতে নিয়ে যাবে | সেখানে একটা লাইভ ইন্টারভিউ নেওয়া হবে | তাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য পোশাক বদলে মুন্নি ঘরে ঢুকতে সাংবাদিক মেয়েটি বলে‚

একটু সাজগোজ করে নাও | প্রথমবার টেলিভিশনে বসবে তো …|

দরকার নেই |

মুন্নি কিছু বলার আগেই দৃঢ় গলায় বলে ওঠেন সুতনুকা | একটু হেসে আবার বলেন ‚

দরকার নেই | আমার মেয়ে এমনিতেই ভারি সুন্দরী | ওর সাজতে লাগে না |

অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকায় মুন্নি | মেয়েকে জড়িয়ে ধরে মা কানে কানে বলেন ‚
কাঁচা হলুদ ‚বেসন আর ওইসব হাবিজাবি কৌটোগুলো আমি আজই ডাস্টবিনে ফেলে দেব বুঝলি | যাদবপুরেই ভর্তি হয়েছে মুন্নি | মাকে ছেড়ে থাকতে বড্ড মন খারপ করবে বুঝে শেষপর্যন্ত মত বদলাতে হয়েছে | মেয়ের কথা শুনে বাবা অবশ্য একটু মুচকি হেসেছেন | প্রথমদিন কলেজ যাওয়ার আগে অভ্যাসমত বাথরুমের ঝাপসা আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়েই চুল বাঁধছিল মুন্নি | হঠাৎ কী মনে হতে ঘরে এসে ঠাকুমার দোলনা আয়নাটা বার করে টেবিলের ওপর রাখে | তারপর তার সামনে দাঁড়িয়ে পরিপাটি করে চুলটা বাঁধে | আজ আর কোনও অজানা উৎস থেকে আলো এসে পড়ছে না আয়নায় | মুন্নিকে যেমন দেখতে ঠিক তেমনটিই দেখাচ্ছে | চুল বাঁধা শেষ করে জামাকাপড় পরে নেয় |তারপর ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরোনর আগে আবার আয়নাটার সামনে এসে দাঁড়ায় মুন্নি | তারপর ভারি মিষ্টি করে হেসে বলে‚ থ্যাঙ্কিউ ঠাকুমা |

গল্পের ১ম অংশ পড়তে ক্লিক করুন।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!