মুন্নিদের বাড়িটা পুরোনো আমলের | বড়সড় ‚ খোলামেলা | মুন্নির একটা দক্ষিণের জানলা দেওয়া নিজস্ব ঘর আছে | তার খাট, আলমারি, পড়ার টেবিল চেয়ার, বইয়ের র্যা ক এইসব দিয়ে সাজানো | কিন্তু ঘরে কোনও আয়না নেই | মুন্নি নিজেই রাখতে দেয়নি | আয়না মুন্নির পছন্দ নয় | আয়নার সামনে দাঁড়ানো মানেই নিজের খুঁতগুলো স্পষ্ট করে দেখতে পাওয়া | মায়ের ঘরের মস্ত ড্রেসিং টেবিলটাকে মুন্নি তাই মোটামুটি এড়িয়েই চলে | তার বাথরুমে একটা ঝাপসা হয়ে যাওয়া পুরোনো আয়না আছে ‚চুল বাঁধার কাজ তাতেই হয়ে যায় |
কিন্তু সেদিন একটা মজার ব্যাপার হল | মুন্নির বাবা ঠিক করেছেন বাড়িটা পুরোনো হয়ে গেছে | তাই বাইরেটা একবার রঙ করে নেওয়া দরকার | সেইজন্য ঝাড়াঝুড়ির কাজ চলছে | মিস্ত্রিরা নানারকম পুরোনো জিনিসপত্র টেনে বার করছে | কিছু ফেলে দেওয়া হচ্ছে | কিচ্ছু আবার মা রেখে দিচ্ছেন | রবিবার | বাবা বাড়িতেই আছেন | মিস্ত্রিদের কাজের তদারকি করছেন | হঠাৎ ছাদের সিঁড়ি থেকে তাঁর ডাক শুনে মুন্নি পড়া ছেড়ে উপরে উঠে দেখে চিলেকোঠার ঘরের সামনে বাবা দাঁড়িয়ে আছেন |মুন্নিকে দেখেই বললেন‚
এটা নিয়ে যা | তোর ঘরে নিয়ে গিয়ে রাখ |
এটা কী?
এটা তোর ঠাকুমার ড্রেসিং টেবিল | আসল সেগুন কাঠের তৈরি | বেলজিয়ান গ্লাস | চমৎকার জিনিস |পুরোদস্তুর আন্টিক | এসব আজকাল আর পাওয়া যায় না |
মুন্নি অবাক হয়ে দেখল জিনিসটা মোটেই ড্রেসিং টেবিলের মত দেখতে নয় | গোল ফ্রেমের মধ্যে একটা কাচ লাগানো | কাঠের ফ্রেমটা দুপাশে দুটো স্ট্যান্ডের সঙ্গে আটকানো | এমনভাবে আটকানো যে আয়নাটা দোল খায় |
এটাকে মোটেই ড্রেসিং টেবিল বলা যাবে না বরং দোলনা আয়না বলা যায় |
ঠাকুমাকে মুন্নির মনে নেই | তার যখন মাত্র এক বছর বয়স তখনই তিনি মারা যান | ছোট্ট মুন্নিকে কোলে নিয়ে তাঁর একটা ছবি বাড়িতে আছে | তবে বাবার কাছে ঠাকুমার অনেক গল্প শুনেছে মুন্নি | ঠাকুমা নাকি ভারি বুদ্ধিমতী মহিলা ছিলেন | অল্পবয়সে বিয়ে হয়েছিল | কিন্তু তারপর নিজের চেষ্টায় এমএ পাস করে স্কুলের হেড মিসট্রেস হয়েছিলেন | বাবা গল্প করে, ঠাকুমা নাকি মুন্নিকে ভারি ভালবাসতেন | মেয়ের গায়ের রঙ ময়লা বলে মা দুঃখ করলে তিনি মাকে ধমক দিয়ে বলতেন,
সেকি বউমা ভুলে গেলে‚ কালো যে জগতের আলো | তোমার এই মেয়ে দেখবে একদিন জগৎ আলো করবে |
ঠাকুমাই মুন্নির নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণকলি | এসব কথা ভাবতে ভাবতে আয়নাটা হাতে নিতে কাচের দিকে চোখ পড়ে মুন্নির | অমনি ভারি চমকে ওঠে সে | আয়নার ভিতর তাকে যেন ভারি ভাল দেখাচ্ছে! কপালের ঠিক ওপরটাতে কোথা থেকে একটা আলো এসে পড়েছে আর তাতে গোটা মুখটা যেন উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে | নিজেকে সামলে নিতে তাড়াতাড়ি আয়না থেকে চোখ সরিয়ে নেয় মুন্নি | তারপর আয়নাটাকে হাতে ঝুলিয়ে নিজের ঘরে এনে এক কোণে রেখে দেয় |
একটু পরেই স্নানের জন্য মা এসে তাগাদা দেন | যথানিয়মে সর-ময়দা মেখে স্নান করতে হয় মুন্নিকে | স্নানের পর অভ্যাসমত বাথরুমের ঝাপসা আয়নাটায় চুল আঁচড়াতে গিয়ে কী যে মনে হয় মুন্নির! কোণা থেকে ঠাকুমার আয়নাটা তুলে নিয়ে টেবিলে রেখে তার সামনে চিরুণি হাতে দাঁড়ায় | অমনি আবারও চমকে ওঠে দারুণভাবে | আয়নার ভিতর তারই রোজকার চেনা মুখ | কিন্তু কী যেন এক অপূর্ব সৌন্দর্য ফুটে আছে সেখানে | কোন এক জায়গা থেকে তার ভিজে চুলের ওপর আলো এসে পড়েছে | ঝিকমিক করছে চুল | নাক মুখ চোখ সবই যেন সেই অদ্ভূত আলোয় লাবণ্যে মাখামাখি | ভীষণ আশ্চর্য হয়ে তাড়াতাড়ি আয়নাটা সরিয়ে রাখে মুন্নি |কিন্তু তার মনটা হঠাৎ ভারি হালকা হয়ে যায় | কেমন যেন একটা আনন্দের ঢেউ মনের ভিতর দিয়ে বয়ে যায় |
খুশি খুশি মনে দুপুরের খাওয়া সেরে নিজের ঘরে ফিরে আসে মুন্নি | গরমের দুপুর | বাইরে ঝাঁ ঝাঁ করছে রোদ | কিন্তু তাদের পুরোনো বাড়ির দেওয়াল মোটা আর ঘরের দরজা জানলা সব বন্ধ বলে ঘরের ভিতরটা ভারি ঠান্ডা‚ আরামদায়ক | বিশেষ কিছু করার নেই বলেই মুন্নি আবারও অঙ্কবইটা খুলে টেবিলে বসে | বাড়িতে তাকে একজন মাস্টারমশাই অঙ্ক করাতে আসেন | অধিকাংশ দিনই মুন্নির বেশিরভাগ অঙ্ক ভুল হয় |হোমওয়ার্কও শেষ করে রাখে না |