আজও পড়াতে আসবেন বরেন স্যার | প্রফিট আন্ড লস-এর অঙ্ক করাচ্ছেন | অন্যমনস্কভাবে সেই চ্যাপ্টারটাই খোলে মুন্নি | পর পর করে যায় অঙ্কগুলো | সেদিন সন্ধেবেলা মুন্নিকে পড়াতে এসে রীতিমত আশ্চর্য হয়ে যান বরেন স্যার |মুন্নি শুধু হোমওযার্ক নয় পুরো চ্যাপ্টারের সব অঙ্ক করে রেখেছে এবং বেশিরভাগই ঠিক করেছে |কয়েকদিনের মধ্যেই মুন্নি বুঝতে পারে তার মধ্যে কিছু একটা বদল হয়েছে | পড়াশোনা করতে তার বেশ ভাল লাগছে | কঠিন কঠিন অঙ্ক অনায়াসে করতে পারছে | বিজ্ঞানের বিষয়গুলো পড়তে, নতুন নতুন জিনিস জানতে কেমন যেন একটা আবিস্কারের আনন্দ হচ্ছে | এমনকী ইতিহাস ‚ ভূগোলের মত বিচ্ছিরি-বিরক্তিকর বিষয়গুলোও দিব্যি গল্পের মত ঝরঝর করে পড়া হয়ে যাচ্ছে | আর সবথেকে ভাল ব্যাপার হল তার ওই সারাক্ষণ মন খারাপ হয়ে থাকার ব্যাপারটা কেমন যেন অনেকটাই কমে গেছে |এখন তার মনে সবসময়ই একটা বেশ খুশি খুশি ভাব |
কেন যে এটা হচ্ছে সেটা প্রথমটায় বুঝতে পারছিল মুন্নি |কিন্তু একটা ঘটনায় ব্যাপারটা অনেকটা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল | গড়িয়াহাটে বাজার করতে গিয়ে মায়ের সঙ্গে হঠাৎ তার এক স্কুলের বন্ধুর দেখা হয়ে গেছিল | বহুকাল পরে দেখা | তাই প্রথমটায় সেখানেই অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে গল্প | তারপর ঠিকানা আর ফোন নম্বরের আদান-প্রদান | তা মায়ের সেই বন্ধু আরতিমাসি একদিন এলেন মুন্নিদের বাড়িতে | মা তো ভয়ানক খুশি | ঘরদোর সব সাজিয়ে-গুছিয়ে রেখেছেন | নানা রকম খারাব-দাবারও বানানো হয়েছে | দুই বন্ধুতে বসে বেশ খানিকক্ষণ গল্প করার পর মা মুন্নিকে ডেকে পাঠালেন | মুন্নি ঘরে ঢোকামাত্র মাসি বলে উঠলেন ‚
একী রে সুতনুকা তোর মেয়ে তো একেবারে তোর মত দেখতে হয়নি | এই বয়সে তোর দিকে তাকালে তো চোখ ফেরানো যেত না | কী রঙ ছিল ‚ হলুদ গোলাপ ফুলের মত | ছুটির সময় স্কুলের বাইরে ছেলেদের লাইন পড়ে যেতো | না ‚ রে ‚মেয়ে তো তোর কিছুই পায়নি |
কান্না পেয়ে গেছিল মুন্নির | ইচ্ছে হয়েছিল তখনই সেখানে থেকে উঠে চলে আসতে | মাও একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলেছিলেন ‚
সে তো জানাই| কী আর করব বল | তবে ছোটবেলায় যা ছিল তার থেকে এখন রঙটা অনেক পরিষ্কার হয়েছে | রোজ কাঁচা হলুদবাটা মাখাই তো…..তোর মনে আছে আরতি আমাদের স্কুলের সেই মণিকা দিদিমণিকে….
মায়েদের গল্প অন্যদিকে ঘুরে যেতেই জল খাওয়ার অজুহাতে উঠে চলে এসেছিল মুন্নি | তারপর নিজের ঘরে এসে চুপচাপ শুয়ে ছিল |পরের দিন স্কুলে অঙ্ক পরীক্ষা | এর আগের পরীক্ষায় পুরো ক্লাসের মধ্যে সবথেকে বেশি নম্বর পেয়েছে সে | দিদিমণি অনেক আদর করেছিলেন | এবারও মুন্নি মনে মনে ঠিক করে নিয়েছিল এমনভাবে অঙ্ক প্র্যাকটিস করবে যাতে একটাও ভুল না হয় | কিন্তু আরতিমাসির কথা শুনে মনটা এমন বিগড়ে গেল যে অঙ্ক করতেই ইচ্ছে করছে না | মুখের ভিতরটা কেমন যেন তেতো লাগছে | খানিকক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে উঠে পড়ে মুন্নি | ভাবে ছাদে একটু ঘুরে আসবে | তাতে যদি মাথাটা ঠান্ডা হয় | ঘরে পরার চটিটার খোঁজে এদিক ওদিক তাকাতে গিয়ে হঠাৎ চোখ পড়ে খাট আর পড়ার টেবিলের মাঝের খাঁজে ঢুকিয়ে রাখা ঠাকুমার আয়নাটার দিকে | মুন্নির মুখের ছায়া পড়েছে আয়নাতে | নিচু হয়ে চটি খুঁজছিল মুন্নি | আয়নায় তাই লো আঙ্গেলে ধরা তার মুখ | ভুরু দুটো মনে হচ্ছে তুলি দিয়ে আঁকা | শ্রাবণ মাসের বিকেলে মেঘ কেটে আকাশ ভরে গেছে কমলা রঙের আলোয় | কোন চোরাপথে সেই আলো এসে পড়েছে আয়নার কাচে | সেই গোধূলি আলোয় তার মুখের রঙ যেন হলুদ গোলাপের মত | মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে মুন্নি | একটু পরে মায়ের ডাকে ঘোর ভাঙে | আরতিমাসি চলে যাবেন ‚ তাই মা তাকে ডাকছেন | নিচে নেমে দিব্যি মাসির সঙ্গে কথা বলে ‚ হাত নেড়ে চলে আসে মুন্নি | ফুরফুরে মেজাজে পড়ার টেবিলে অঙ্ক করতে বসে | ওই বিচ্ছিরি মন খারাপ করা ব্যাপারটা থেকে বেরোনর রাস্তাটা তার ততক্ষণে জানা হয়ে গেছে |
মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরিয়েছে | অঙ্ক আর বিজ্ঞানের সবকটা বিভাগ সব থেকে বেশি নম্বর পেয়েছে কৃষ্ণকলি |মুন্নির রেজাল্ট দেখে স্কুলের দিদিমণিরা তো বেজায় খুশি |বাড়িতেও আনন্দের হাওয়া | মা সবাইকে টেলিফোন করে করে রেজাল্ট শোনাচ্ছেন | বাবা মুখে বিশেষ কিছু না বললেও খুবই যে খুশি হয়েছেন সেটা মুখ দেখেই দিব্যি বোঝা যাচ্ছে | ইন্টারনেটেই রেজাল্ট জানা হয়ে গেছিল | দুপুরের পর স্কুল থেকে মার্কশিট নিয়ে ফিরল মুন্নি | তারপর বিকেলে চা খেতে বসে আলোচনা শুরু হল মুন্নি কী পড়বে ‚ কী কম্পিনেশন নেবে এইসব নিয়ে | বেশ খানিকক্ষণ আলোচনার পর বাবা বললেন ‚
সবই তো হল ‚ এখন মেয়েটা যে এত ভাল রেজাল্ট করল ‚ তার তো একটা গিফট পাওনা হয় | কী নিবি বল মুন্নি ?
একটা ভাল হার গড়িয়ে দাও না| মেয়ে বড় হয়েছে | সেজেগুজে কোথায় গেলে পরে যেতে পারবে |
কীরে মুন্নি গয়না নিবি ?মেয়ের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন বাবা | মাথা নাড়ে মুন্নি |
তাহলে কী নিবি বল ?
আমার কোনও গিফট এখন চাই না | কিন্তু আমার অন্য একটা জিনিস চাওয়ার আছে|
কী শুনি ?
মুন্নি একটু চুপ করে থেকে বলে‚
উচ্চমাধ্যমিকে আমার রেজাল্ট যেমনই হোক না কেন ‚ আমাকে হোস্টেলে থেকে পড়তে দিতে হবে |
তার মানে ? বাবা তো অবাক ‚