ট্যাবলেট—–ইরাজ আহমেদ

আ মারে গাঞ্জা আইনা দিতে পারছ?

আজমত মিঞার বাড়ির বাইরের বারান্দার একটা ঠুনিতে হেলান দিয়ে হিরু ঝিমাচ্ছে। দুদিন টানা বৃষ্টির পর চারপাশে লাফালাফি করছে রোদ। মাঝে মাঝে হাওয়া এসে নাড়িয়ে দিচ্ছে বড় গাছের মাথাগুলো। হিরুর আম-ঘুম ধরে আসে। আসার সময় বউ আম খেতে দিয়েছিল। বেশ বড় সাইজের ল্যাংড়া। গোটা চারেক পেটে চালান হয়েছে। এখন সেই আমের মিঠা আমেজে ঘুম আসছে আকাশ ভেঙে। হঠাৎ গাঁজার কথা শুনে চমকে উঠে হিরু নড়ে বসে। আঠার মতো লেগে আসা ঘুম সেকেন্ডে উধাও। এইসব কী কয় মিঞা বাড়ির মাইঝা মিঞা! বোকার মতো তাকায় হিরু। আজমত মিঞা ডাব্বা হুকাটা মুখের সামনে থেকে নামায়। এক দৃষ্টিতে সামনের লিচু গাছটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, গাঞ্জার কথা জীবনে প্রথম শুনলি মনে হয়?
হিরু থতমত খেয়ে বলে, আপনে গাঞ্জা খাইবেন! কী কন?
খাইলে সমস্যা কী?
না, কুন সমস্যা নাই, তয় এইসব তো আপনে খান না। ছোটলোকের নিশা।
হিরুর কথায় হাসে আজমত মিঞা।
অনেক সময় ছোটলোক হইতে হয় রে হিরু। তুই বুঝবি না। কুনদিন খাই নাই বইলা জীবনে খামু না এই রকম তো কুন কথা নাই। গাঞ্জা খাইলে শুনছি শরীলে শক্তি আহে; ভিতরে একটা চনমনা ভাব থাকে। বয়স হইয়া যাইতাছে, শরীলটারে একটু গরম রাখনের দরকার আছে।
মনের মধ্যে ফড়িংয়ের মতো লাফিয়ে ওঠা হাসিটাকে অনেক কষ্টে চাপা দেয় হিরু। আজমত মিঞা চেইতা যাইতে পারে। বুইড়ার মেজাজ সব সময় কাঁন্ধে উইঠা থাকে। হিরু সাবধানে তাকায় আজমত মিঞার দিকে। মনে মনে ভাবে, আচানক শরীল গরম রাখনের বুদ্ধি বুড়ার মাথায় ঢুকল কই থেইকা? নিশ্চয়ই পিছে কোনো একটা কাহিনী আছে, কিন্তু সেইটা কী?

 
চোখ বন্ধ করে হুকাটা ঠোঁটের ওপর চেপে ধরে টান দেয় আজমত মিঞা। অনেকটা ধোঁয়া ছেড়ে আধবোজা চোখে হিরুর দিকে তাকিয়ে বলে, কীরে কথা কস না ক্যান? আমার কথা কানে যায় নাই?
হিরু মাথা নেড়ে বলে, আপনে কইলে তো হরিণের চোখও তুইলা আনতে পারি। গাঞ্জা একটা ব্যাপার হইলো? আমাগো রিয়াজুলের কাছে হেই টাঙ্গাইল থেইকা এক নম্বর গাঞ্জা আসে। নিয়া আসুম?
যা কই চুপচাপ শুইনা যাবি। রিয়াইজ্যার কাছ থেইকা ইস্পেশাল কোয়ালিটির গাঞ্জা নিয়া রাইতে দিয়া যাবি আমারে। সুন্দর কইরা বানাবি যেন খাইতে পারি।
আজমত মিঞার গলার স্বর করাতের মতো ধারালো। হিরু আর কথা বাড়ায় না। মাথা নাড়ে শুধু।
আজমত মিঞা হুঁকায় যুত করে কয়েকটা টান দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, তুই অহন যা, আমি একটা কাইৎ হমু। শরীলটা ঢিশ-ঢিশ করতাছে।
হিরু ধীরে উঠে দাঁড়ায়। আজমত মিঞা ভেতর বাড়িতে যাওয়ার আগে হঠাৎ থেমে গলা নামিয়ে বলে, এই কথা যদি আমি কোনো জায়গায় শুনি তাইলে কিন্তু তর খবর আছে। আমি কোনো আওয়াজ চাই না।
আজমত মিঞার এই হিংস মুখটা চেনে হিরু। ভয়ও পায়। তাড়াতাড়ি ঢোক গিলে বলে, এইটা নিয়া আপনে ভাইবেন না। আমার মুখ বন্ধ থাকব।
আজমত মিঞা পা টেনেটেনে হেঁটে ভেতরে চলে যায়। হিরু উঠে দাঁড়ায়। তার মাথায় একটাই প্রশ্ন ঘুরতে থাকে, আজমত মিঞা আচানক- গাঞ্জা খাইতে চাইল ক্যান?
আজমত মিঞার বাড়ি থেকে বের হয়ে হিরু পেছনের পথটা ধরে। বাড়ির পেছন দিকে পুকুর। পুকুরের ধার দিয়ে পায়ে চলা পথ নেমে গেছে নিচু একটা জায়গায়। তারপর মাঠ। নিচু জায়গায় সবজি লাগানো হয়েছে। টসটসে সবজি দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। বৃষ্টির পানি জমে আছে জায়গাটায়। মাচায় লাউ ঝুলছে, ছোট ছোট গাছে বেগুন। এ রকম জায়গা দেখলে আবার ক্ষেতি-বাড়ি করার ইচ্ছা হয় হিরুর। চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নেয় হিরু। মনের পর্দায় ভেসে ওঠে একটা ছোট ঘর, ঘরের সামনে উঠান, একপাশে জাম্বুরা গাছ… স্বপ্ন, স্বপ্ন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হিরু। এসব চিন্তা মাথায় ঢুকলে মন খারাপ হয়ে যায়। হিরু ভাবতেও চায় না। তার চেয়ে আজমত মিঞার খেদমতি করাই ভালো।
সামান্য এক চিলতে জমি হিরুরও ছিল। বাপ চোখ বন্ধ করার পর জুয়া খেলার নেশায় সেটাও গেছে। হিরুর কপালটা অবশ্য ভালো। সব হারানোর পর আজমত মিঞা তার একটা খালি জমিতে ঘর তুলে থাকতে দিয়েছে। হিরুকে কাজে লাগে আজমত মিঞার। বাজারে তোলা আদায়, রাতে চোরাই মালের নৌকা-পাহারা- সব জায়গায় ডাক পড়ে তার। এলাকার মানুষ দীর্ঘদেহী হিরুকে ভয় পায়। সমঝে চলে। হিরু খুব ভালো করেই জানে, পেছনে তাকে সবাই গালাগাল করে। তাতে অবশ্য হিরুর কিছু যায় আসে না। এতোদিনে একটা হিসাব তার কাছে পাকা হয়ে গেছে- আজমত মিঞার ছায়া থেকে বের হলে কেউ এক বেলা ভাত দেবে না। মাঠের ওপর দাঁড়িয়ে থুতু ফেলে হিরু। ভেতরে রাগ কিলবিল করে। এই যে বাজারে মাইরপিটের কেসে ছয় মাস জেল খাইটা বাইর হইলাম, কেউ খবর নিছে আমার? বাড়িতে বউটা একা আছিল কেউ চুপি দিয়াও দেখে নাই। আজমত মিঞা তো চাইল-ডাইল পাঠাইছে। লোক দিয়া খবর নিছে। এইটুকু না করলে বউটা তো না খাইয়া মরত। আজমত মিঞা লোকটার ব্যবহার খারাপ হইলে কী হইব, মনটা অনেক নরম।
সেকেন্দরের কলা বাগানের ভেতরের রাস্তায় অর্জুন নাপিতের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় হিরুর। গ্রামে ঘুরে ঘুরে চুল কাটে অর্জুন। গোটা এলাকার সব খবর থাকে তার চুল কাটার বাক্সে। কার বউয়ের বাচ্চা হচ্ছে না, কার বউ কার জামাইয়ের সঙ্গে ঢলাঢলি করছে, কে-কার ছাগল চুরি করল- সব খবর পাওয়া যায় অর্জুনের কাছে। হিরু অর্জুনের খবরের পুরনো কাস্টমার। হিরুকে দেখে একগাল হাসে অর্জুন।
আরে তুমি কবে ছাড়া পাইলা ওস্তাদ?

 
হিরু একটা কলাগাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে, কাইল মাদানে (বিকেলে); আইতে রাইত হইয়া গেছিল।
তুমি একটা অমানুষ কাকা, খবর দিবা না? কতদিন তোমার লগে দেখা নাই।… এইবার অনেকদিন রাখল তোমারে।
কথাটা শুনে হিরু মনে মনে হাসে। এবার কপাল জোরে বাঁচা গেছে। হিরু অর্জুনের কাঁধে হাত রেখে বলে, হ, ঠিকই কইছ, অনেকদিন। তুমরা কেমন আছিলা, চাইরদিকের খবর কী?
হিরুর কথায় একটু চমকায় অর্জুন। কলা বাগানে দুপুরের রোদ চচ্চড় করছে। অর্জুন তার চুল কাটার যন্ত্রপাতি রাখার ছোট কাঠের বাক্সটা নাড়াচাড়া করতে করতে গলা নামিয়ে বলে, আইচ্ছা, আজমত মিঞার হইছে কী?
হিরু প্রশ্নটা শুনে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, ক্যান, হের আবার হইব কী? ভালাই তো দেখলাম। একটু আগে খাইয়া ঘুম পাড়তে গেল…।
খুকখুক করে শব্দ করে অর্জুন নাপিত। হাসে না কাশে বোঝা যায় না। হিরুর দিকে তাকিয়ে বলে, কিছু হয় নাই। তয় হইতে কতক্ষণ?
একটা কলা পাতা ছিঁড়ে আঙুলের প্যাঁচ দিয়ে ফেলে বাঁশি বানাচ্ছিল হিরু। অর্জুনের কথা শুনে বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকায়। কলাপাতাটা ফেলে দিয়ে বলে, ওই ব্যাটা নাপিতের পো, এতো ত্যানা প্যাঁচ মাইরা কথা কও ক্যান? যা কওনের সোজা কইতে পার না?
হিরুর কথায় আবারও গলা দিয়ে খকখক শব্দ করে অর্জুন। হাসে না কাশে বোঝা যায় না। তারপর হাতের বাক্সটা নাড়া দেয়। ঝনাৎ করে শব্দ হয় বাক্সের ভেতরে ছুরি-কাঁচি ধাক্কা লেগে। অর্জুন কিছু একটা ভেবে বলে, তুমার দাড়ি-গোঁফ বড় হইছে, মাদানে বাড়িতে আইসো, কাইটা দিমু।
কথাটা বলে আর দাঁড়ায় না অর্জুন নাপিত। বাক্স নিয়ে হনহনিয়ে কলাবনের ভেতর দিয়ে হেঁটে চলে যায়। হিরু কিছুক্ষণ চোখ-মুখ কুঁচকে চিন্তা করে। নাপিতের পো কিছু একটা জানে। কিন্তু সেইটা কী পষ্ট কইরা কইল না। হালারে চাইপা ধরতে হইব।
অন্যের জায়গায় হলেও ঘরটা অনেক যত্ন করে তুলেছিল হিরু। জংলা জায়গা পরিষ্কার করে এলোমেলো কয়েকটা গাছ লাগিয়েছিল এক বছর আগে। গাছ বড় হচ্ছে। এতো নাই- দুনিয়ার ভিতরে একটা ঘর, গাছ- খারাপ কী? সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে বিলকিসকে দেখতে পায় না হিরু। মনে হয় মিঞা বাড়িতে। কিছুদিন হল সেখানে কাজ করে বিলকিস। আগে দুইটা বাড়িতে কাজ করত। তারপর বিকেলে আটার মিলে। হিরু জেলে যাওয়ার পর মিঞা বাড়ি থেকে ডেকে বিলকিসকে কাজ দেয়া হয়েছে। হিরু জানে, আজমত মিঞা বলে করিয়েছে কাজটা। আজমত মিঞার এই সাহায্য না থাকলে হিরুর মতো ট্যান্ডল মাঠে মারা পড়ত।
সারাদিন গ্রামের নানা জায়গায় চক্কর দিয়ে হিরু গিয়েছিল নাপিতকে ধরতে। নাপিতের পেটের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে কথাটা বের না করা পর্যন্ত কেন জানি শান্তি পাচ্ছে না হিরু। কিন্তু নাপিত গেছে পাখির ট্যাকে এক বিয়ে বাড়িতে চুল কাটতে। ঘরে ফিরে নতুন ল্যাপা মাটির বারান্দায় বসে হ্যারিকেন হ্যারিকেন ধরায়। বারান্দার কোলঘেঁষা ছোট রান্নাঘর থেকে মুড়ির টিন বের করে মুড়ি চিবায়। ঘরের সামনে খোলা জায়গায় বিলকিস লেবু গাছ লাগিয়েছে। ছোট ছোট লেবুও ধরেছে। এবার জেল থেকে ফিরে ঘরের নতুন চাল, নতুন ল্যাপা ঘর দেখে বেশ অবাকই হয়েছে হিরু। বিলকিস খুব খুশি। মিঞা বাড়ি থেকে টিন পাওয়া গেছে, সেখানে কাজও মিলেছে। হিরু সব দেখেশুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে।
চালের ওপর বৃষ্টির ধুন্দুমার আওয়াজে ঘুম কেটে যায় হিরুর। ধড়মড় করে উঠে বসে। বৃষ্টির শব্দে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে যেন। এতো বিষ্টি কুনসম নামল? কিছুই ট্যার পাই নাই! চোখে আঠার মতো লেগে থাকা ঘুম নিয়ে হিরু বিভ্রান্তের মতো ভাবে। ঘর অন্ধকার। হ্যারিকেনটাও নেভানো। চৌকির ওপর বিলকিস ঘুমাচ্ছে। সন্ধ্যাবেলা আজমত মিঞাকে গাঁজা পৌঁছে দিয়ে ঘরে ফিরে অনেকদিন পর হিরু নিজেও এক কল্কে গাঁজা খেয়েছে। বিস্তর নেশা হয়েছিল। বিলকিস মিঞা বাড়ি থেকে এক বাটি ভাত আর মাংস নিয়ে এসেছিল। খায়নি হিরু। চৌকির পাশে বস্তা পেতে শুয়ে পড়েছিল। উঠে গিয়ে পায়রার খোপের মতো ছোট্ট জানালাটা সামান্য ফাঁক করে। জানালা ভেঙে বৃষ্টি ঢুকতে চায় ঘরে। হিরু ভাবে, কাইল এই বিষ্টি থামব? সকালে হিরুর অনেক কাজ। আজমত মিঞা তাকে হাশিমপুরে বাঁধের জন্য মাটি কাটার কাজ দেখতে পাঠাচ্ছে। সন্ধ্যাবেলা বুড়ার মনটা ফুরফুরা ছিল। গাঁজার স্টিকটা হিরুর সামনে বসেই শেষ করেছে। তারপর কাজটার কথা বলেছে। তুই কিছুদিন হাশিমপুরে গিয়া বান্ধের মাটি কাটার কাম দেখবি। লোকজন ঝামেলা করে। দিন গেলে পাঁচশ ট্যাকা পাবি। কথাটা শুনে তখন থেকে ভেতরে-ভেতরে লাফাচ্ছে হিরু। আজ আজমত মিঞা তার গাঁজা খাওয়ার রহস্যও বলেছে হিরুকে। শুনে মনে মনে হেসেছে হিরু। বিপদে পড়ছে বুড়া। বছর খানেক আগে পাশের গ্রাম হিদলাপুরের এক গরিব চাষীর মেয়েকে প্রায় জোর করে বিয়ে করেছিল আজমত মিঞা। এখন জোয়ান বউ সামাল দিতে বিপদে আছে বুড়া। গাঁজা খেয়ে ঝামেলার কথাটা বলেই ফেলেছে হিরুকে।

 
কথা মাঝপথেই শেষ করে দিয়েছিল আজমত। কিন্তু হিরুর যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে। আজমত মিঞাকে আশ্বস্ত করেছে হিরু।
সেইজন্য গাঞ্জা খাইতে হইব ক্যান! এখন ওষুধ আছে। আপনি কইলে নিয়া আসুম।
আজমত মিঞার মুখটা পাকা পেঁপের মতো দেখায়। একটুও দেরি না করে পাঁচশ টাকার একটা নোট হিরুকে ধরিয়ে দিয়েছে আজমত মিঞা। কথাটা ভেবে এখন আবার হাসি পায় হিরুর। বয়স হইল একটা ঝামেলার বিষয়; মনের কথা শুনে না।
জানালা থেকে সরে এসে চৌকির ওপর বসে হিরু। ঘুমন্ত বিলকিসের শরীরের ওপর হাত রাখে। ঠাণ্ডা। জেল থেকে ফেরার পর বিলকিসকে কাছে পায়নি হিরু। একটু নড়ে ওঠে বিলকিস। … ঝটকা মেরে হাত সরিয়ে দেয় বিলকিস।
রাইত কইরা কী শুরু করলা? ঘুমাও।
হিরু একটু থতমত খায়। তারপর আবার ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে। এবার বিলকিস ঘুম জড়ানো গলায় বলে, সারাদিন কাজ করতে করতে শরীল ব্যথা হইয়া গেছে। এহন আবার তুমি… একটু ঘুমাইতে দ্যাও।
রাগ হয় হিরুর। … ঝাঁপিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে বিলকিসের ওপর। তারপর নিজেই থমকে যায়।
বউটার জন্য মায়া হয়। আসলেই মিঞা বাড়িতে সারাদিন অনেক খাটনি যায় বিলকিসের। সংসার ঠিক রাখনের জন্য অনেক কষ্ট করে মাইয়াটা। মিঞা বাড়ি থেইকা ট্যাকা দেয় ঠিকই কিন্তু খাটাইয়া নেয়। সকাল থেইকা রাইত পর্যন্ত দম ফেলতে পারে না।
চৌকি থেকে উঠে জানালার কাছে ফিরে আসে হিরু। বাইরে বৃষ্টির বেগ আরও বেড়েছে। অন্ধকারে হাতড়ে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরায়। সস্তা তামাকের গন্ধ মিশে যায় অন্ধকারে।
তিন দিন পর এক সন্ধ্যাবেলা হাশিমপুর থেকে ফেরার পথে অর্জুন নাপিতের সঙ্গে হিরুর দেখা হয় লঞ্চ ঘাটে। অর্জুন মদনের দোকানে চা খাচ্ছিল। হিরুকে লঞ্চ থেকে নামতে দেখে বের হয়ে এসে পেছন থেকে ডাকে, ওস্তাদ, কই যাও?
হিরুর বাড়িতে যাওয়ার তাড়া। কিন্তু অর্জুনকে দেখে আটকে যায়। অর্জুন সেদিন কী একটা কথা বলতে গিয়েও বলেনি। কথাটা শোনা দরকার। অর্জুন চওড়া হাসি দিয়ে বলে, আমিত্তি খাইবা?
মাথা নাড়ে হিরু। মদনের দোকানের সামনে আমিত্তি তৈরি হচ্ছে। জ্বাল দেয়া গুড়ের গন্ধে জায়গাটা ম ম করছে। বিকেল ফুরিয়ে এলেও দোকানে কাস্টমার আছে। দোকানের ভেতরে ঘুপচির মধ্যে লম্বা বেঞ্চে চিৎ হয়ে ঘুমাচ্ছে মদন। নিঃশ্বাসের নিয়মিত ওঠানামায় তার বিশাল ভুঁড়িটাও দুলছে। ভেতরে ঢুকে ময়লা পড়ে কালো হয়ে যাওয়া একটা কাঠের চেয়ার টেনে বসে হিরু। পকেটে হাত দিয়ে আজমত মিঞার ট্যাবলেটের প্যাকেটটা দেখে নেয়। রিয়াজুলকে জেলা শহরে পাঠিয়ে ট্যাবলেটগুলো আনিয়েছে।
হিরুর দিকে তাকিয়ে খামোখাই হাসে অর্জুন। গলা তুলে একটা ছেলেকে দুই কাপ চা আর আমিত্তি দিতে বলে বিড়ি ধরায়। আয়েশ করে বিড়িতে একটা টান দিয়ে বলে, অনেকদিন পরে তুমারে দেখলাম। বাড়িতে আসনের সময় পাও না মনে হয়?
হিরু হাই তুলে বলে, হ, আর কইও না। মাইঝা মিঞা যে কামে ঢুকাইলো… শালার দিন-রাইত এক হইয়া যাইতাছে। আইজও আসা হইত না, হুট কইরা চইলা আসছি।
মুচকি হাসে অর্জুন নাপিত। টেবিলে রেখে যাওয়া গরম আমিত্তিতে একটা কামড় দিয়ে গরম আমিত্তি মুখের ভেতরে নাড়াচাড়া করতে করতে অস্পষ্ট গলায় বলে, তুমার দিন-রাইত এক হইলে আজমত মিঞার অনেক সুবিধা ওস্তাদ… অনেক সুবিধা।
হিরু কথাটা শুনে অবাক হয়ে তাকায় অর্জুনের দিকে। বলে, ঠিক বুঝলাম না।
অর্জুন কপ করে আমিত্তিটা পেটে চালান করে দিয়ে বলে, বুঝবা, সময় আসলেই বুঝবা। গালের উপরে কেমনে ক্ষুর চালাইলে দাড়ি আরামে কাটব সেইটা আমিও একদিনে বুঝি নাই।
হিরু প্লেট থেকে একটা আমিত্তি হাতে নিয়ে বলে, শালা নাপিতের পো, তুমার খালি প্যাঁচ মারা কথা। কই আমি আর কই তুমার গালের দাড়ি…
অর্জুন আবার হাসে। মেজাজ খারাপ হয় হিরুর। দোকানের ছেলেটা চা রেখে যায়। হিরু খায় না। আমিত্তির রস লেগে আঠা হয়ে যাওয়া আঙুলটা ছেঁড়া কাগজে মুছে বলে, আমি যাই।

 
অর্জুন তাকায় হিরুর মুখের দিকে।
চেইতা গেলা মনে হয় আমার কথায়?
কথার ভিতরে এতো ত্যানা প্যাঁচানি ভালো লাগে না। আমি বাড়ি গেলাম।
চেইতা লাভ নাই ওস্তাদ। সব কথা ফট কইরা কওয়া যায় না; চোখ খুইলা দ্যাখতে হয়।
অর্জুন নাপিতের কথাগুলো আজ কেমন যেন লাগে হিরুর। লোকটা কিছু একটা বলতে গিয়েও চেপে গেল। রাগ হয় হিরুর। আর কথা না বাড়িয়ে দোকান থেকে বের হয়ে আসে। আগে সোজা বাড়ি যাবে বলে ঠিক করে হিরু। বিলকিসের সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয় না। সন্ধ্যা নেমে আসছে দ্রুত। হিরু বাড়ির দিকে পা চালায়।
সন্ধ্যাবেলা হিরু অর্জুনের সঙ্গে মদনের চায়ের দোকানে আরও কিছুক্ষণ গল্প করলেই বোধহয় ভালো করত। কিন্তু হিরুর তাড়া ছিল। বিলকিসকে খুব দেখতে ইচ্ছা করছিল। আসার সময় হাশিমপুর বাজার থেকে বিলকিসের জন্য একজোড়া ছোট্ট ইমিটিশনের কানের দুলও কিনেছিল।
ঘর অন্ধকার। সামনের খোলা জায়গায় দু-একটা জোনাকি পোকা এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। হিরু ভেবেছিল বিলকিস মিঞা বাড়ি থেকে ফেরেনি। তারপর ঘরের ভেতরে ঝটপটানির শব্দ, ফিসফাস কথা আর চাপা হাসি শুনেও হিরু হয়তো ভেবেছিল অন্যকিছু। হয়তো চোর ঢুকেছে ঘরে। উঠানে পড়ে থাকা একটা চলা হাতেও নিয়েছিল হিরু। কিন্তু দরজার কাছে পৌঁছানোর আগে হঠাৎ ঘরের ভেতরে আজমত মিঞার গলার আওয়াজ হিরুর পা দুটোকে গেঁথে দিয়েছিল মাটির সঙ্গে। নড়ার ক্ষমতা হারিয়েছিল হিরু। আজমত মিঞা তার ঘরে! আজমত মিঞার গলা দিয়ে অদ্ভূত শব্দ বের হয়। তারপর বিলকিসের হাসির আওয়াজের নিচে চাপা পড়ে যায়। এক ঝটকায় হিরুর চোখের সামনে ছোট একটা ঘর, একটা জাম্বুরা গাছ, গাছের তলায় পড়ে থাকা সাদা ফুল ভেসে ওঠে। তারপর ছবিটা কল্কি থেকে ছিটকে পড়া গাঁজার আগুনের মতো ছড়িয়ে যায় উঠানে। পিছিয়ে যেতে থাকে হিরু। পিছিয়ে যেতে থাকে ঘরের কাছ থেকে, এক বছর আগে লাগানো চারা গাছের কাছ থেকে। তার শরীরে তখন লাখো জোনাকি পোকা ছুটে বেড়াচ্ছে। পিছিয়ে আসতে আসতে হিরু এসে ঠেকে একটা শূন্য ধানক্ষেতে। তখন কি চাঁদ উঠেছিল আকাশে? হবে হয়তো। হিরু খেয়াল করেনি। তারপর একসময় উঠে হাঁটতে হাঁটতে হিরু চলে গিয়েছিল মিঞা বাড়িতে। ওষুধটা তো আজমত মিঞাকে দিতে হবে তার।
শুয়ে পড়েছিল আজমত মিঞা। হিরু খবর পাঠালে তড়িঘড়ি করে বের হয়ে আসে ভেতর বাড়ি থেকে। হিরু শান্ত গলায় বলে, আপনের জিনিস নিয়া আসছি।
নিঃশব্দে হাসে আজমত মিঞা। খপ করে হিরুর হাত থেকে প্যাকেটটা নেয়।
খুব কামের জিনিস। একলগে পাঁচটা বড়ি খাইতে হইব। আইজ রাইতে খাইবেন। কাইল থেইকা কাম শুরু।
কথাটা বলতে গিয়ে হিরুর গলা কাঁপে না। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আজমত মিঞার মুখের দিকে।
আজমত মিঞা মাথা নেড়ে পকেট থেকে দুটো একশ টাকার নোট বের করে হিরুর পকেটে গুঁজে দেয়।
হিরু আর বাড়িতে ফেরেনি। সোজা বাজারে গিয়ে মদনের চায়ের দোকানে একটা টুল পেতে শুয়ে পড়েছিল। তার কানে রিয়াজুলের কথাটা ধাক্কা দিচ্ছিল, ভাই, খুব খিয়াল কইরা কিন্তু। এই বড়ি পাঁচটা একলগে খাইলে মানুষ সোজা উপরে চইলা যাইব।
পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে হিরু চলে গিয়েছিল মিঞা বাড়িতে। যেতে তো হবেই তাকে। রিয়াজুলের ট্যাবলেটের ওপর অনেক ভরসা হিরুর। কান্নার আওয়াজ সে দূর থেকেই পেয়েছিল। মিঞা বাড়িতে মেয়ে-মানুষের কান্নার শব্দ। ভিড় সরিয়ে দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল হিরু। আজমত মিয়ার প্রাণহীন শরীর বিছানায় পড়ে আছে। মুখটা একদলা ফ্যানায় মাখামাখি।
হিরু ফিরেছিল আবার লঞ্চঘাটে। মদনের দোকানের সামনের চুলায় বড় কেটলিতে চায়ের পানি ফুটছে। গ্রামের অনেকেই তখনও খবরটা জানে না। হিরু খুব শান্ত ভঙ্গিতে উঠে গিয়েছিল একটা লঞ্চে। ওঠার সময় তখনও পকেটে থাকা কানের দুলটা ছুড়ে ফেলেছিল নদীতে। এ জীবনে আর দুল কিনতে চায় না হিরু।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!