গল্পের পঞ্চম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
বললাম—ছেলেবেলায় এয়ার গান ছুঁড়েছি। রাজাবাহাদুর হেসে উঠলেন—তা বটে। আপনারা কবি মানুষ। অস্ত্রশস্ত্রের ব্যাপার আপনাদের মানায় না। আমি অবশ্য বারো বয়সেই রাইফেল হাতে তুলে নিয়েছিলাম। আপনি চেষ্টা করে দেখুন না, কিছু শক্ত ব্যাপার নয়।
উঠে দাঁড়ালেন রাজাবাহাদুর। ঘরের একদিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁকে অনুসরণ করে আমি দেখলাম—এ শুধু লাউঞ্জ নয়, রীতিমত একটা ন্যাচারাল মিউজিয়াম এবং অস্ত্রাগার। খাওয়ার টেবিলেই নিমগ্ন ছিলাম বলে এতক্ষণ দেখতে পাইনি, নইলে এর আগেই চোখে পরা উচিত ছিল।
চারিদিকে সারি সারি নানা আকারের আগ্নেয়াস্ত্র। গোটাচারেক রাইফেল, ছোট বড় নানা রকম চেহারার। একটা হুকের সঙ্গে খাপে আঁটা এক জোড়া রিভলবার ঝুলছে; তার পাশেই দুলছে খোলা একখানা লম্বা শেফিল্ডের তলোয়ার—সূর্যের আলোর মতো তার ফলার নিষ্কলঙ্ক রঙ। মোটা চামড়ার বেল্টে ঝকঝকে পেতলের কার্তুজ—রাইফেলের রিভলবারের। জরিদার খাপে খান তিনেক নেপালী ভোজালি। আর দাওয়ার গায়ে হরিণের মাথা, ভালুকের মুখ, নানারকমের চামড়া—বাঘের, সাপের, হরিণের, গো-সাপের। একটা টেবিলে অতিকায় হাতীর মাথা—দুটো বড় বড় দাঁত এগিয়ে আসছে সামনের দিকে।। বুঝলাম—এরা রাজাবাহাদুরের বীরকীর্তির নিদর্শন।
ছোট একটা রাইফেল তুলে নিয়ে রাজাবাহাদুর বললেন—একটা লাইট জিনিস। তবে ভালো রিপিটার : অনায়াসে বড় বড় জানোয়ার ঘায়েল করতে পারেন।
আমার কাছে অবশ্য সবই সমান। লাইট রিপিটার যা, হাউইটজারও তাই; তবু সৌজন্য রক্ষার জন্য বলতে হল—বাঃ, তবে তো চমৎকার জিনিস।
রাজাবাহাদুর রাইফেলটা বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে : তাহলে চেষ্টা করুন। লোড করাই আছে, ছুড়ুন ওই জানালা দিয়ে।
আমি সভয়ে তিন পা পেছিয়ে গেলাম। জীবনে বেকুবি অনেক করেছি। কিন্তু পরিমাণটা বাড়াতে আর প্রস্তুত নই। যুদ্ধ ফেরত এক বন্ধুর মুখে তাঁর রাইফেল ছোঁড়ার প্রথম অভিজ্ঞতা শুনেছিলাম—পড়ে গিয়ে পা ভেঙ্গে নাকি তাঁকে এক মাস বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়েছিল। নিজেকে যতদূর জানি—আমার ফাঁড়া শুধু পা ভাঙার ওপর দিয়েই কাটবে বলে মনে হয় না।
বললাম, ওটা এখন থাক, পরে হবে না হয়। রাজাবাহাদুর মৃদু কৌতুকের হাসি হাসলেন। বললেন, এখন ভয় পাচ্ছেন, কিন্তু একবার ধরতে শিখলে আর ছাড়তে চাইবেন না। হাতে থাকলে বুঝবেন কত বড় শক্তিমান আপনি। ইউ ক্যান ইজিলি ফেস অল রাস্কেলস অব—অব—
হঠাৎ তাঁর চোখ ঝকঝক করে উঠল। মৃদু হাসিটা মিলিয়ে গিয়ে শক্ত হয়ে উঠলো মুখের পেশীগুলো : অ্যান্ড এ রাইভাল—
মুহূর্তে বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল আমার। রাজাবাহাদুএর দুচোখে বন্য হিংসা। রাইফেলটা এমন শক্ত মুঠিয়ে বাগিয়ে ধরছেন যেন সামনে কাউকে গুলি করবার জন্য তৈরি হচ্ছেন তিনি। উত্তেজনার ঝোঁকে আমাকেই যদি লক্ষ্য ভেদ করে বসেন তাহলে—
আতঙ্কে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি। কিন্তু ততক্ষণে মেঘ কেটে গেছে। রাজা-রাজড়ার মেজাজ! রাজাবাহাদুর হাসলেন।
—ওয়েল, পরে আপনাকে তালিম দেওয়া যাবে। সবই তো রয়েছে, যেটা খুশি আপনি ট্রাই করতে পারেন। চলুন, এখন বারান্দায় গিয়ে বসা যাক।, লেটস হ্যাভ সাম এনার্জি।
প্রাতরাশেই প্রায় বিন্ধ্য পর্বত উদারসাৎ করা হয়েছে আর কী হলে এনার্জি সঞ্চিত হবে বোঝা শক্ত। কিন্তু কথাটা বলেই রাজাবাহাদুর বাইরের বারান্দার দিকে পা বাড়িয়েছেন। সুতরাং আমকেও পিছু নিতে হল।
বাইরের বারান্দায় বেতের চেয়ার, বেতের টেবিল। এখানে ঢোকবার পরে বিচিত্র রকমের আসনে বসেছি যে আমি প্রায় নার্ভাস হয়ে উঠেছি। তবু যেন বেতের চেয়ারে বসতে পেয়েই খানিকটা সহজ অন্তরঙ্গতা অনুভব করা গেল। এটা অন্তত চেনা জিনিস।
আর বসবার সঙ্গে সঙ্গেই বোঝা গেল এনার্জি কথাটার আসল তাৎপর্য কী। বেয়ারা তৈরিই ছিল, ট্রেতে করে একটি ফেনিল গ্লাস সামনে এনে রাখল—এ্যাল্কোহলের উগ্র গন্ধ ছড়িয়ে গেল বাতাসে।
রাজাবাহাদুর স্মিত হাস্যে বললেন—চলবে? সবিনয়ে জানালাম, না।
—তবে বিয়ার আনবে? একেবারে মেয়েদের ড্রিঙ্ক! নেশা হবে না।
—নাঃ থাক। অভ্যেস নেই কোনোদিন।