টোপ–নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়-২য় পর্ব

গল্পের ৩য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

পথের দুপাশে তখন নতুন একটা জগতের ছবি। সবুজ শালবনের আড়ালে আড়ালে চা-বাগানের বিস্তার, চকচকে উজ্জ্বলে পাতার শান্ত, শ্যামল সমুদ্র। দূরে আকাশের গায়ে কালো পাহাড়ের রেখা।

ক্রমশঃ চা-বাগান শেষ হয়ে এল, পথের দুপাশে ঘন হয়ে দেখা দিতে লাগল অবিচ্ছিন্ন শালবন। একজন আর্দালি জানাল হুজুর, ফরেস্ট এসে পড়েছে।

ফরেস্টই বটে।পথের ওপর সূর্যের আলো সরে গেছে, এখন শুধু শান্ত আর বিষণ্ন ছায়া। রাত্রির শিশির এখনও ভিজিয়ে রেখেছে পথটাকে। ‘রোজে’র নিঃশব্দ চাকার নিচে মড়মড় করে সাড়া তুলেছে শুকনো শালের পাতা। বাতাসে গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টির মতো শালের ফুল ঝরে পড়ছে পথের পাশে, উড়ে আসছে গায়ে।

কোথা থেকে চকিতের জন্য ময়ূরের তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে এল। দুপাশে নিবিড় শালের বন, কোথাও কোথাও ভেতর দিয়ে খানিকটা দৃষ্টি চলে, কখনো বুনো ঝোপে আচ্ছন্ন। মাঝে মাঝে এক এক টুকরো কাঠের গায়ে লেখা ১৯৩৫, ১৯৪০। মানুষ বনকে শুধু উচ্ছন্ন করতে চায় না। তাকে বাড়াতেও চায়। এইসব প্লটে বিভিন্ন সময়ে নতুন করে শালের চারা রোপণ করা হয়েছে, এ তারই নির্দেশ।

বনের রূপ দেখতে দেখতে চলেছি। মাঝে মাঝে ভয়ও যে না করছিল, এমন নয়। এই ঘন জঙ্গলের মধ্যে হঠাৎ যদি গাড়ির ইঞ্জিন খারাপ হয়ে যায়, আর তাক বুঝে লাফ মারে একটা বুনো জানোয়ার তাহলে—

তাহলে পকেটের ফাউন্টেন পেনটা ছাড়া আত্মরক্ষার আর কোনো অস্ত্রই সঙ্গে নেই।

শেষTটায় আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করে বসলাম,—হ্যাঁরে, এখানে বাঘ আছে?

ওরা অনুকম্পার হাসি হাসল।–হ্যাঁ, হুজুর।

—ভালুক?

রাজা-রাজড়ার সহবত, কাজেই যতটুকু জিজ্ঞাসা করব ঠিক ততটুকুই উত্তর। ওরা বলল—হ্যাঁ হুজুর।

—অজগর সাপ?

—জী মালিক।

প্রশ্ন করবার উৎসাহ ওই পর্যন্তই এসে থেমে গেল আমার। যে রকম দ্রুত উত্তর দিয়ে যাচ্ছে তাতে কোনো প্রশ্নই যে ‘না’ বলে আমাকে আশ্বস্ত করবে এমন তো মনে হচ্ছে না। যতদূর মনে হচ্ছিল গরিলা, হিপোপটেমাস, ভ্যাম্পায়ার কোনো কিছুই বাকি নেই এখানে। জুলু কিংবা ফিলিপিনোরও এখানে বিষাক্ত ব্যুমেরাং বাগিয়ে আছে কিনা এবং মানুষ পেলে তারা বেগুনপোড়া করে খেতে ভালবাসে কিনা এ জাতীয় একটা কুটিল জিজ্ঞাসাও আমার মনে জেগে উঠেছে ততক্ষণে। কিন্তু নিজেকে সামলে নিলাম।

খানিকটা আস্তেই গাড়িটা ঘস্‌ ঘস্‌ করে ব্রেক কষল একটা। আমি প্রায় আর্তনাদ করে উঠলাম,—কিরে, বাঘ নাকি?

আর্দালিরা মুচকি হাসল—না, হুজুর, এসে পড়েছি। ভালো করে তাকিয়ে দেখি, সত্যিই তো। এসে পড়েছি সন্দেহ নেই। পথের বাঁদিকে ঘন শালবনের ভেতরে একটুকু ফাঁকা জমি। সেখানে কাঠের তৈরি বাংলো প্যাটার্নের একখানি দোতলা বাড়ি। এই নিবিড় জঙ্গলের ভেতরে যেমন আকস্মিক, তেমনি অপ্রত্যাশিত।

গাড়ির শব্দে বাড়িটার ভেতর থেকে দু-তিনজন চাপরাসি বেরিয়ে এল ব্যতিব্যস্ত হয়ে। এতক্ষণ লক্ষ্য করিনি, এবার দেখলাম বাড়ির সামনে চওড়া একটা গড়খাই কাটা। লোকগুলো ধরাধরি করে মস্ত বড় এক ফালি কাঠ খাঁদটার ওপরে সাঁকোর মতো বিছিয়ে দিল। তারই ওপর দিয়ে গাড়ি গিয়ে দাঁড়াল রাজাবাহাদুর এন আর চৌধুরীর হান্টিং বাংলোর সামনে।

আরে, আরে কী সৌভাগ্যগ রাজা বাহাদুর স্বয়ং এসে বারান্দায় দাঁড়িয়েছেন আমার অপেক্ষায়। এক গাল হেসে বললেন, আসুন আসুন, আপনার জন্য আমি, এখনও চা পর্যন্ত খাইনি।

শ্রদ্ধায় আর বিনয়ে আমার মাথা নিচু হয়ে গেল। মুখে কথা জোগাল না, শুধু বেকুবের মতো কৃতার্থের হাসি হাসলাম এক গাল।

রাজা বাহাদুর বললেন—আগে স্নান করে রিফ্রেসড হয়ে আসুন, টি ইজ গেটিং রেডি। বোয়, সাহাবকো গোসলখানামে লে যাও।

চল্লিশ বছরের দাঁড়িওয়ালা বয় নিঃসন্দেহে বাঙালি। তবু হিন্দি, করে হুকুমটা দিলেন রাজাবাহাদুর, কারণ ওটা রাজকীয় দস্তুর। বয় আমাকে গোসলখানায় নিয়ে গেল।

গল্পের ৩য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

দুঃখিত!