কাঙ্খিত সেই বাসর রাত এলো। দুরু দুরু বুকে ঝট করে তোমার ঘোমটা খুলতেই বুকটা ছ্যাঁক করে লাফিয়ে উঠলো। আল্লারে! যে হলদে পাখির মতো রাঙা ঠোঁট, টিকেল নাক আর আধ-বোজা ডাগর চোখে এক ঝলক রূপের চমক… আমায় আকুল করলো। আমি কানের কাছে মুখ নিয়ে বলেছিলাম, তুমি আমার রাঙা বউ। এসব মনে পড়ে তোমার? সচকিত হয়ে এদিক-সেদিক তাকালেন শুনু পন্ডিত। অথচ ময়নার মা তার কাছে নেই। যাকে বলেছিলেন হারানো দিনের স্মৃতিকথা। যে একটু আগে উঠে গেল। উঠবেনই বা না কেন, সারাদিনই তো কানের কাছে ঘ্যানর-ঘ্যানর, প্যানর-প্যানর। সবই তো সামাল দিতে হচ্ছে ময়নার মা’কে। যেদিন চাকুরী থেকে অবসরে এসেছেন শুনু পন্ডিত, সেদিন থেকেই ময়নার মায়ের কান দুটো ময়নার বাপের কাছে ইজারা দিয়েছে। তাই ময়নার বাপের সব কথা না শুনে উপায় কি? ময়নার মা’য় উঠে গেলেও ময়নার বাপে থেমে থাকেনি।
তিনি বিস্মিত কন্ঠে বললেন, এ্যাঁ, কাকে বলছি এসব কথা! কখন চলে গেল ময়নার মা? যাক গে যেয়ে। এরপর ঘরসংসার শুরু। দেয়ালে টাঙানো আমার সন্তানদের ছবি। যাদেরকে মানুষ করতে আমার বুকের রক্ত পানি করেছি। প্রথমই ঘর আলো করতে এলো মেয়ে সন্তান। আলতারাঙা ঠোঁটের জন্য ওর দাদী নাম রেখেছিলেন ময়না। প্রতিভা ছিল দারুণ। বড় হয়ে অনেকগুলো পাশও দিয়েছিল। কিন্তু সে প্রতিভা এদেশের কল্যাণে আসেনি। স্বাধীনতার পর থেকেই স্বনির্ভর কৃচ্ছ্রতা এবং সৃজনশীল কর্মপরায়ণতার অভাবে সব ভেস্তে গেল। আমার মেয়ে ময়না বিকিয়ে গেল আমেরিকায়।
সে এখন আমেরিকারই নাগরিক। তাই বলে টাকাও পাঠায় না এদেশে। কী লাভ হলো? কী পেলাম মেধা পাচার করে? শুনু পন্ডিত একা একা বিড়বিড় করে কথাগুলো বলতে বলতে খবরের কাগজটা হাতে তুলে নিলেন। তিনি নদীর ধারে হিজল গাছটার দিকে তাকালেন। খড়কুটো আর বাঁশের তৈরি টোঙঘরে তিনি ছাড়া আর কেউ নেই। বেশ গরম আর চারদিক নিথর। অদূরে মাঝে মাঝে স্কুলটায় ঘন্টার পর ঘন্টা বাজে। সবশেষে বাজবে ছুটির ঘন্টা। ততক্ষণে শুনু পন্ডিত টোঙঘরেই বসে থাকবেন। ছুটি শেষে দেখবেন স্কুল শিক্ষার্থীরা দলবেঁধে বাড়ি ফিরছে। এতেই তার উপচে পড়া আনন্দ। বিশাল সমতল মাঠের উপর দিয়ে সূর্য উঠে আবার অস্ত যায়। রাতের আধেক চাদের আকাশে সন্ধ্যাতারা জ্বলে উঠে।
গ্রামের ভেতর জনশূণ্য কুয়ার পাড়ে রাতে সমবেত শিয়ালের হুক্কা হুয়া চিৎকার শোনা যেত। বিক্ষিপ্তভাবে পাখির হট্টগোল, সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। দিনের বেলায় কেউ কেউ গরু-ছাগল চড়াত। সেই মাঠে শুনু পন্ডিত নিজের উদ্যোগে স্কুল খুলেছেন। চাকুরী থেকে অবসরের টাকায় এ স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত। স্কুলটির জন্যে তার মনের কোঠরে উদ্ভাসিত মায়া-মমতা। দুপুরের পর বিকেল বেলায় তার চোখে ঘুম নামে না। শিশুদের খেলার শব্দ তাকে কৈশরে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। হিজল গাছটা নড়ে ওঠে। নদীর দিক থেকে শীতল মোলায়েম বাতাস বয়ে যায়। শুনু পন্ডিত ঠা-া ও প্রসন্নতা অনুভব করে। স্কুলটি তখনও ছুটি হয়নি। সে খবরের কাগজ পড়তে নিবিষ্ট হয়। কিছুক্ষণ পরে ময়নার মা পন্ডিতের জন্য খাবার নিয়ে আসে। রুটি, হালুয়া আর চা… সাথে পান-সুপারী। সিরামিকের বড় এক মগ চা। ময়নার মা তার পাশে বসে হাতপাখার বাতাসে মাছি তাড়ায়, শুনু পন্ডিত সাগ্রহে খেতে থাকে। হালুয়া-রুটি সাবাড় করে চা-টা ফুঁ দিয়ে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে চুমুকের পর চুমুক দিয়ে শেষ করলো।
তারপর ময়নার মা’ র হাতে বানানো পানের খিলিটা মুখে পুড়ে দেয় সে। শক্ত সুপারীগুলো অধঃগামী করতে যথেষ্ট সময় লাগে তার। টোঙঘরের মাচানে গা এলিয়ে দিয়ে ময়নার মায়ের সাথে আবারও ঘ্যানর ঘ্যানর-প্যানর প্যানর শুরু করে দেন শুনু পন্ডিত। ময়নার মা জানতে চায়, ‘ বলি শোন, এই টোঙঘরে তুমি কতদিন যাপন করবে? আর আমারে তুমি কতদিন জ্বালাবে দিনে রাতে এই বুড়ো বয়সে? বাড়ি-ঘর থাকতে কোলার মাঝে এই টোঙঘরে তোমার খাবার, পড়ার পেপার সবকিছু নিত্য নিত্য আমি আর বইতে পারছি না। তারচেয়ে ঘরে চলো। এ কথা শুনে হঠাৎ ভীষণ হাসি পেল পন্ডিতের। বিমুখ বিকেলের রবি অস্ত যাবেই যাবে। কে ফিরাবে তারে ! তবু পন্ডিত নীতিতে অটল। ঘর ছেড়েছে, টোঙঘরই তার ঘর। খায়-দায়, ঘুমায় আর স্কুলের সৌন্দর্য উপভোগ করে শুনু পন্ডিত। তিনি অপেক্ষায় থাকেন, কখন বাজবে স্কুলের ছুটির ঘন্টা।
ময়নার মায়ের কথা শুনে তিনি বললেন, ‘ আমি হাসবো না কাঁদবো? বউসহ বাড়ি আসবে তোমার বড় ছেলে এই অজ পাড়া গাঁয়! কখনও নয়। বিশ্বাস না হয় লিখে রাখ চুনের ফোঁটায় , তোমার ঘরের বেড়ায়। যত্তোসব। বলি শোন, ময়নার মা । তোমার বড় ছেলে রিফাত এখন এস পি, মানে পুলিশ সুপার। দায়িত্ব নিয়ে দেশের সেবা করছে। অথচ যাকে বিয়ে করেছে, সে ঢাকা শহরের ধনাঢ্য ঘরের সন্তান। তোমার ছেলেকে টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে, কারণ তোমার খরচে পড়ালেও চাকরীটা তাদের দ্বারাই হয়েছে। অজ পাড়া গাঁয়ে মুর্খ সুর্খ মানুষের ভীড়ে তোমার পুত্রবধূর পায়ের ছাপ পড়বে না, ছাপছাপ জানিয়ে দিয়েছে তোমার ছেলেকে। আশা ছেড়ে দাও। ময়নার মা চোখ নামিয়ে নিচে তাকাল। চোখের কোণে বেদনার পানি টলটল করছে তার। ঈষৎ মেঘমুখে আবার সে টোঙঘরের বেড়ার সাথে টানিয়ে রাখা ছেলেদের ছবির দিকে তাকালো।
মেঝো ছেলে রিয়াজের মায়াভরা চেহারা। যেমন শান্ত তেমন বিনয়ী। শুনু পন্ডিত সেই ছেলেকে ইঙ্গিত করে বললেন, ময়নার মা আমার মাথা আছে বলেই মাথাব্যাথা হয়। কি আর বলবো। তোমার ছেলে রিয়াজের সৃজনশীল কাজে দারুণ উৎসাহ। বি এ জি করেছে। এম এ জি করেই বিজ্ঞান প্রযুক্তিতে ক্ষেত-খামারের ফলন বাড়াবে। বাংলার মানুষের খাদ্যের অভাব থাকবে না। কোথায়? সেসব তো কিছুই হচ্ছে না। সে না-কি কোথায় কোন কেরানীর চাকুরীতে দরখাস্ত করেছে। করুক গে। এলোমেলো ভাবনায় নিস্কৃতি পেতেই তো টোঙঘরে এলাম। নিস্কৃতি কি আমার আছে? আমি বরং খবরের কাগজ দেখি। শুনু পন্ডিত খবরের কাগজে দৃষ্টি নিবদ্ধ হলেন। ‘সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে রাজনৈতিক দল।’ শিরোনামের খবরে প্রতিবেদক লিখেছেন, হরতালের আগের দিনই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরের রাস্তার মোড়ে মোড়ে ককটেল বিস্ফোরণে আহত হয়েছে পথচারী।
দুর্বত্তরা পেট্রোল ঢেলে চলন্ত গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে, নারী-শিশুসহ নিহত অনেকে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ায় পুলিসসহ নিহত অনেকে। এই খবরটি শুনু পন্ডিতকে দারুণভাবে মর্মাহত করেছে। এ পোড়া কপাইল্যার দেশে তার ছেলে রিফাত এস পি। ছোট ছেলে সুমন রাজনীতিবিদ। তিনি বিড়বিড় করে বলছেন, হরতাল গণতান্ত্রিক অধিকার, কিন্তু আমার দেশে রাজনৈতিক ব্যাধি। যে হরতালের পক্ষে থাকবে সেই হরতাল করবে, অথচ মানুষ মেরে , গাড়ি পুড়িয়ে, ভয় দেখিয়ে হরতাল জোরজবরদস্তিতে পালন করানো আইনগত অধিকার হতে পারে না। কি জানি বাবা যদি লাইগ্যা যায়………….. শুনু পন্ডিত একটু স্বাভাবিক হতে চাইলেন। তিনি তাকালেন নিরুত্তর দাঁড়িয়ে থাকা হিজল গাছটার দিকে।
সবুজ পাতায় ঘেরা গাছটি কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিয়ে অক্সিজেন সরবরাহ করে বাঁচিয়ে রাখছে মানুষ। বোবা গাছটি মানুষের উপকারে আসে অথচ সৃষ্টির সেরা মানুষ হয়েও মানুষ মানুষকে পুড়িয়ে মারছে। কী আস্ফালন মানুষের, ভাবতে অবাক লাগে শুনু পন্ডিতের। তিনি দেখছেন কে যেন দৌড়ে আসছে টোঙঘরের দিকে। তার অনেক পেছনে লাশের কফিন বহন করে এগিয়ে আসছে কতগুলি মানুষ। দৌড়বিদ লোকটি আর কেউ নয়, শুনু পন্ডিতের ভাইয়ের ছেলে এনামূল। সে হাপাতে হাপাতে এসে হুমরি খেয়ে পড়ে গেল টোঙঘরের সামনে। শুনু পন্ডিত ধীরে ধীরে নিচে নেমে এলেন। এনামূলকে দু’ হাত ধরে দাঁড় করালেন। জিজ্ঞেস করলেন, কী বাবা কী হয়েছে? এনামূল শোকাবহ কণ্ঠে জবাব দিল, চাচার লাশ! লাশ, কার লাশ! শুনু পন্ডিত জানতে চাইলেন। কাঁপা কন্ঠে এনামূল বললো, ছোট ভাই সুমনের লাশ। শুনু পন্ডিত এনামুলের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, কী, তাহলে গুলী খেয়ে মরেছে আমার ছোট ছেলে সুমন! বুঝেছি, রাজনীতির বলীর পাঠা।
ততক্ষণে কফিনটা টোঙঘরের সামনে চলে এসেছে। শুনু পন্ডিত মনটা শক্ত করে বললেন, খবরদার। কফিন খুলবেন না, আমি ওর মুখ দেখতে চাই না। ‘ও’ ছিল কোনো এক নেতা নামক স্বার্থপরের লেলিয়ে দেয়া কুত্তা, সমাজের সন্ত্রাস। হরতালের নামে দেশ ও দশের সম্পদে অগ্নি সংযোগ, গাড়ি ভাংচুর আমি আশা করিনি। আপনারা কি শিক্ষা দিতে চান আমাকে… আমার মরা ছেলে দেখিয়ে ? যেখানে গুলী খেয়েছিল, সেখানে কি মাটি ছিল না ওর জন্য ? আমি ওর কবর খুড়বো ? অসম্ভব। ওর কফিন নিয়ে যান।
আপনারা যারা ওর কফিন বহন করেছেন… একটা কথার জবাব দিন, এই বেঈমানটা যখন গুলী খেয়েছে, তখন এর নেতা বা নেতার সন্তান অথবা তার কোনো নিকটাত্মীয় , কেউ কি গুলী খেয়ে মরেছে? আপনারা একটা কাজ করুন, এই ঘাতক বোকা ছেলে সুমনের লাশটা অবৈধ বিদ্রোহের জ্বলন্ত আগুনে জ্বালিয়ে দিন। বাংলার বুক থেকে চিরতরে বিদায় করে দিন ইতিহাসের পৈশাচিক মীর জাফর। পুত্রশোকে পাথর শুনু পন্ডিত কফিনটি রেখে উঠে গেলেন টোঙঘরে। পুত্রশোকে কাতর ময়নার মা হার্টফেল। স্কুলের শেষ ঘন্টাটি বেজে উঠলো। ছেলেমেয়েরা বাড়ি ফিরছে। শুনু পন্ডিত সেদিকে তাকিয়ে থাকলো মাছরাঙা পাখির মতো।