এক বিকেলের ডোবার ক্ষণে ধানহাটি থেকে ঘর্মাক্ত মুখে বেরিয়ে আসছিলেন দেওয়ান বর্মণ। ঘাড়ের গামছায় ঘাম মুছতে মুছতেই সামনে পড়ল টুনুমুনু এক্কার। কালো পেশল শরীরে ঢেউ তুলে ধামসা-মাদলের তালে দুলতে দুলতে সে প্রবেশ করছে মোরগলড়াইয়ের আসরে, হাড়িয়াহাটের পর্বে। দেওয়ানের চোখে এক মুহূর্তের দ্বিধা—টুনুমুনুকে কি তিনি গ্রহণ করবেন, না কি তার জোতজমির তিন নদী পাঁচ বনের বিস্তৃত ভেতর থেকে ছিটকে দেবেন? তবু প্রবীণ চোখের কুঞ্চন সত্ত্বেও তিনি মুখভরা হাসি নিয়ে এগিয়ে আসেন, পানের পিক ঠোঁটে, আর টুনুমুনুর হাততালির আহ্বানে টেনে যান উৎসবের বর্ণাঢ্য আবহে। চারপাশের নদী-ফরেস্ট, হাতিমাহুতের গান, মনকেমনের দিন, সব কিছুর মধ্যেই যেন বিষাদ ও একাকীত্ব চুঁইয়ে নামে। জোতজমির খালবিল, বাড়িঘর, গানবাজনা, হাসি-তামাসার জটিলতায় দাঁড়িয়ে দেওয়া বর্মণ দোদুল্যমান হয়ে থাকেন, অথচ শেষমেশ উৎসবমুখর আবহমানের ভেতরে নিজেকে সঁপে দেন।
তারপরও একা বসে ভাবনায় ডুবে যান তিনি—নির্মাণ আর বিনির্মাণের দ্বন্দ্বে। স্মৃতি ভেসে ওঠে—মেঘা বর্মণ, যিনি এই জোতজমির গোড়াপত্তন করেছিলেন। তখন হাটে-মাঠে ঘুরে বেড়াত বাঘ, আতঙ্ক ছড়িয়ে দিত তার নখ-লেজ, অথচ একইসঙ্গে মাঠে ফলত রবিশস্যের লকলকে সম্ভার। মাঘকুয়াশায় দলাদলা একাকীত্ব, গানের সুরে জন্মজন্মান্তরের স্মৃতির ভাঙন, বজ্রবিদ্যুৎসহ ঝরতে থাকা বৃষ্টি—সব মিলে দেওয়ান যেন বুঝতে পারেন, কীর্তনের সুর প্রতিষ্ঠা পেলেও কোথাও কোনো স্থায়ী স্বীকৃতি মেলে না। নদীর সাঁকো পেরিয়ে ছায়াছন্নতায় ডুবে থাকা বিষণ্ণ মানুষগুলো গান গাইতে গাইতে হয়ে ওঠে আত্মগত, অন্যমনস্ক।
এমন সময় হাজার হাতির মিছিল অর্থহীন হয়ে পড়ে, চিলাপাতার জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা বাইসনের পাল ফের মিলিয়ে যায় গভীর বনে। নদী পেরিয়ে ছুটে চলা জীবনের দোলাচলে আকাশ-নদী-বৃক্ষের বিস্তারে সোনাভাবীর হাসি নতুন প্রাণ জাগায়। কাঠের বাড়ির সিজিলমিছিল, বুকভরা শ্বাসে বাঁচতে চাওয়া, মহল্লায় মহল্লায় মাদল-ধামসার উচ্ছ্বাস—সবই জেগে ওঠে। টুনুমুনু, শনিচরী, ফাগুলাল, চুনিয়া, মালতিরা কিংবদন্তির ঢেউয়ে ভেসে ওঠে। করম পূজার মাঠে অন্ধকার নামে, জোনাই জ্বলে। মোরগলড়াই শেষে চিলবানুস ওরাও ফিরে আসে, অথচ তার পীঠে জেগে থাকে চিতার থাবার আঁচড়। পুরনো পৃথিবীর বাঘ-মানুষের লড়াই আবারও কিংবদন্তির জাল বুনে চলে, আর চিলবানুস হয়ে ওঠে ‘বাঘুয়া’।
অতিকথার এই পৃথিবীতে মাদলধামসা, উৎসব-আনন্দ, ভয়-বিষাদ সব মিলে গড়ে তোলে এক অবিরাম প্রবাহ। দেড়শো ঘোড়া, তিরিশ হাতির দেওয়ান আর টুনুমুনু এক্কার সম্পর্কও অবধারিতভাবে সেই প্রবাহের ভেতরেই বাঁধা পড়ে থাকে। জীবনের অন্তর্গত আনন্দ-বেদনা, বাড়িঘর, হাটগাঁ, গানকিসসা মিলেমিশে রূপ নেয় এক অনন্ত আবহমান জগতে।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।