টুনুদা-বিমল কর

লোকে বড় হলে গরু ধরে,আমি ন,দশ বছর বয়সে এক গরু ধরে ছিলাম।গরুর নাম টুনু।আমার মামাত বড় ভাই।টুনুদা বলে ডাকতাম।আমার বাবা তখন গোমোতে।রেলে চাকুরি করেন।আমরা থাকতাম রেল কোয়াটারে।বাড়ির সামনে বাচ্চা বাচ্চা পাহাড়,বা পাহাড়ের মতো উঁচু উঁচু ঢিবি।
একবার সিমা এলেন আমাদের বাড়িতে।মাস খানেক থাকবেন।শরীর খারাপ বলে জল হাওয়া বদলাতে এসেছেন।মামীর সঙ্গে টুনুদা আর লিলি।টুনুদা আমার চেয়ে দুই বছরের বড়,তার মানে বার তের বছর বয়স তার,আর লিলি আমার বয়েসী।গোমো জায়গাটা খুব সুন্দর ছিল তখন।ছবির মতো দেখাত।আমরা দিব্যি ছিলাম।
টুনুদা এসেছিল জামশেদপুর থেকে।এসেই আমাকে বলল,আমরা এক মাস থাকবো।তুই আমার চেনা হবি বুঝলি!না হলে নাক ফাটিয়ে দেব।আমি রোগা-পটকা ভীতু ধরেনের,আর টুনুদা গাট্টা-গোট্টা শক্ত ধরবের।দুটো ঘুসি মেরে আমার নাক ফাটিয়ে দিতে টুনি দার বেশি সময় লাগবে না।তবু রাগ করে চেলা হওয়া সাজে না,অহংকার লাগে।আমি,সত্যি বলছি,মাথা নেড়ে না বললাম।টুনুদা বলল কি!হবি?আয় পাঞ্জা লড়ি।
পাঞ্জায় আমি হেরে গেলাম।
টুনুদা বলল,আবার আয় ভেড়া লড়ি।মাথায় মাথায় ঠুকবি।কপালে গুতো মারবি।আমিও তোকে মারব।কামু—
ভেড়া লড়াইয়ে আমার হার হল।টুনুদার কী জোড় কপালের।এক একবার মারে-আর আমি তিন পা করে পিছিয়ে যায়।কপাল ফুলে গেল আমার টুনুদা বলল,দুইবার হেরেছিস,আর একবার।এবার লেগ ,ব্রেকিং মানে পা ভাঙা।তুই আমার পায়ে মারবি তোর পা দিয়ে আমি তোর পায়ে মারব।বসে পড়লেই হার।আয়।ঘরের মধ্যে দু,জনে লেগ ব্রেকিং চলাতে লাগলাম।এমন মার খালাম যে আমার পায়ের দফারফা হয়ে গেল।হেরে গেলাম।অগ্যতা টুনুদাকে গুরুপদে বরণ করে নিলাম।গুরু কে খুশি করার জন্য মায়ের খুচরা পয়সা থেকে দুটো পয়সা দিলাম জিলাপি খাওয়ার জন্য।এই টুনুদা যে কত বড় গুরু আজ বুড়ো বয়সে আমি সেটা বুঝতে পারি।
আমাদের বাড়িতে টুটপেস্ট বলে জিনিসটা ঢোকেনি তখন।কোন বাড়িতে বা ঢুকে ছিল?মাজন দিয়ে দাত মাজলাম।টুনুদার হাতে টুটপেস্ট দেখে অবাক হয়ে গেলাম,এটা কি টুনুদা
!রদফেন।
সেটা কি?
পাউরুটি দিয়ে খেতে হয়।খাবি?
খাব,গোমতে তখন হ্যাংলা সাহেব ছিল অনেক।পাউরুটিও তৈর হত।যেমন নরম তেমন মিষ্টি।টুনুদার কথা মতো পাউরুটি নিয়ে এলাম।টুনুদা রদফেন পেস্টলাগিয়ে দিল রুটিতে।খেতে তেমন আরাম লাগে ঝাজ লাগছিল।এমন সময় লিলি সেটা দেখতে পেল।দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে বলল,এ,মা!ওটা তো টুটপেস্ট,দাঁত মাজে,তুই রুটি দিয়ে পেস্ট খাচ্ছিস?কী ভূতরে!টুনুদার কি হাসি।হাসতে হাসতে চিৎপাত।আর একদিন টূনুদা আমার বলল।লাপ্পি খাবি?লাপ্পি আবার কি?অ্যাংলা মাদরাজিরা খায়।একবার খেলে আর ভুলতে পারবি না।তুমি ঠকাবে না তো?
ঠকিয়েছি কোথায়!পেস্ট দিয়ে পাউরিটি খেতে সবচেয়ে ভাল লাগে।আমি খায়,দাঁত মাজার জিনিস কেউ খায়!তুই একেবারে গাধা।খাবার জন্যই দাঁত।দাঁত না লাগিয়ে তুই খা তো,তোকে দশ টাকা দেব।বেশি তর্ক করলাম না।গুরুর সঙ্গে তর্ক করতে নেই।বললাম,লিপ্পি খাবি।খাব।বেশ,আজ সন্ধেবেলায় তোকে খাওয়াব।কাউকে বলবি না।বলতে ভুলে গিয়েছিল টুনুদা এসেছিল ডিসেম্বর মাসে।তখন একেবারে কনকনে শীত।কিন্তু খাওয়া দাওয়ার দারুন মজা তখন।রোজই মামীমা খাবার করছে আর আমরা খাচ্ছি।সন্ধেবেলায় লেপের তলায় বসে আমরা বাচ্চারা খুব গল্প করছি,আর খুব খেলছি।দারুন খেলা জমে উঠেছে।কচা ক্কচ,কাটা কুটি,লিলি চেচাচ্ছে,ঝুনি কাঁদছে।টুনুদা তার শেষে গুটি ঘরে তুলে দিয়ে লাফ মেরে উঠে পড়ল।বলল,নে তোরা শেষ কর,আমি আসছি।মামী মা আর বাবা গিয়াছেন কাছাকাছি একটা বাড়িতে বেড়াতে আমরাই রাজত্ব করছিলাম।ঝনু আমার বোন,প্রায় উঠে যাচ্ছিল তার শেষ গুটি নিয়ে,লিলি কচাং করে কেটে দিল।ঝুনু একেবারে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।এমন সময় টুনুদা এসে হাজির।বলল।নে লিপ্পি খা।বস্তু টা ভাল করে দেখলাম না।আমার শেষ গুটিটা নিয়ে পোঁ পোঁ করে পালাচ্ছিস।লিলি আমার তাড়া করছে।টুনুদা একটা কাপ এগিয়ে দিল।কাপের মধ্যে কালো মতন জলজল কিছু যেন রয়েছে।তার মধ্যে একটা বড়া।আমি সো করে একটা টান মারলাম কাঁপে।মন্দ লাগল না।সামান্য তেতো তার সঙ্গে টকমিষ্টি।ছক্কা চালতে চালতে আমার চুমুক দিলাম।এবার ঝজটা জিবে লাগল।তার পর বড়া টা মুখে করে নিলাম।মুখে দিয়েই কেমন গাঁ গলিয়ে গেল।পাছে বিছানায় বমি করে ফেলি তড়াক করে লাফ মেরে এক ছুটে বাইরে।
বমি হল না।বড়া তো খাইনি।মুখে ছিল।বাইরে গিয়ে ফেলে দিলাম।মুখ ধুয়ে ঘরে এলাম আবার।বিচ্ছিরি লাগছিল।ঝনু জানতে চাইল-কী খেলি রে?বললাম লিপ্পি।
লিপ্পি কি?ঝনু জিজ্ঞেস করল।টুনুদা বলল,মাদরাজিরা খায়।খাবি?এতে ভাল ভাল জিনিস রয়েছে।তেতুল লঙ্কা চেরতার,মধু,কাচা কলা আর তেলাপোকা সেদ্ধ।তার সঙ্গে জিনজার।মানে আদার রস।টুনুর কথা শুনে ঝুনু নাক মুখ চাপা দিয়ে বমি করতে ছুটল।আমার যে কি অবস্থা কি ব্লব!এই টুনুদাই জামসেদপুরে ফিরে জাওয়ার আগে আমার খুব দুঃখ করে বলল,চেলা,আমি তোর সঙ্গে শুধু থাট্টা করলাম।তোকে আবার সত্যি সত্যি একটা ভাল জিনিস খাওয়াব।আমি বললাম না টুনুদা টুটপেস্ট আর পাউরুটি খেতে খারাপ নয়।টুনুদা বলল,এবার তোকে ডিম ছানা খাওয়াব।ডিম ছানা আবার কি জিনিস?শুনে আমার চোখ ছানা বড় হয়ে গেল।কিন্তু আমি বললাম, ডিম থেকে তো ছানা হয়।টুই কিছু জানিস না।ডিম ছানা হল সার্কের ট্রাপিজ খেলোয়াড়দের খাবার।ট্রাপিজ খেলা দেখেসিস,আকাশে লাফালাফি করে।
একবার দেখেছি।
তা হলে বোঝ,কতো গায়ের জোর হয় ডিম ছানা খেলে।তুমি আবার ঠকাবে?না,ভদ্রলোকের এক কথা।তুই আমার চেলা,তার উপর ভাই।তোকে একটা ভাল খাবার কা
খাইয়ে যাব যাবার আগে।তুই পরশুদিন গোটা চারেক ডিম জোগাড় কর।
টুনুদা কে পুরোপুরি বিশ্বাস হল না।আবার খানিক টা বিশ্বাস হল।হাজার লোক চলে যাচ্ছে জামসেদপুরে,যাবার আগে কি আর শয়তানি করবে!অনেক কষ্ট করে দুটো ডিম জোগাড় করে দিলাম টুনুদাকে।টুনুদা আমাদের বিলাস পাঁড়ের ফাঁকা ঘরে গিয়ে কাঠকুটো জ্বালিয়ে ডিমের বড়া মতন ভাল করে ভাজল।রং হল মালপোঁর মতো লালচে কাল।শাপলা পাতায় করে খেতে দিল আমাকে।খেলাম খানিক টা ভয়ে ভয়ে।খেতে খুব খারাপ লাগছিল তা নয়-তবে তেতো তেতো লাগছিল।
বললাম জিনিসটা কি বললেন না?শুনবি? তা হলে শোণ—তোকে শিখিয়ে রাখি।ডিম ফেটিয়ে তাতে নুন দিবি,লঙ্কা কুচিয়ে,পেঁয়াজ দিবি,সোডা দিবি,আর একটা আধ আঙ্গুলের একটা টিকটিকের বাচ্চা—?কি হল রে?আমার যা হয়ে ছিল তা আজও মনে আছে আমার।তিন দিন একটানা বমি করেছি।আর টুনুদার পিঠের ছাল বলে আর কিছুই ছিল না।অবশ্য বেচারি সত্যই আর টিকটিকের ছানা দেয়নি।কিন্তু কে আর সে কথা শুনছে।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!