আমাদের বাড়ির নাম চাপরাশী বাড়ি। বড় বাড়ির বড় দরজা। সে আমলে আমাদের বাড়ির অনেক নাম-ডাক ছিল। বাড়ির একপাশে একটি কোমর বাঁকা নারিকেল গাছ। আমার জেঠামশায় রেঙ্গুন থেকে গাছটির বীজ এনে লাগিয়েছেন। নারিকেল গাছটির নিচে অসংখ্য ঝোপঝাড়। সেখানে আছে কয়েকটি ডমুর গাছ। একটি গাছে বাসা বেঁধেছে দুটি টুনটুনি পাখি। টুনটুনি দম্পতি বাসা থেকে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ বের হয় আর ঢোকে। লেজ নাচায়। শিস দেয়। গান গায়। কখনো একটা বাহিরে বের হয় তো আর একটা বাসার ভেতর থাকে। ডিমে তা দেয়।
আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম। একদিন স্কুলে যাবার সময় আবিষ্কার করলাম টুনটুনি পাখির বাসাটি। তখন থেকে স্কুলে যাওয়া-আসার সময় টুনটুনি পাখি দু’টোকে আমি দেখতাম। অনেক অনেক দিন প্রায় আধঘন্টা পর্যমত্ম দাঁড়িয়ে টুনটুনি পাখি দু’টির কান্ডকারখানা প্রত্যক্ষ করতাম। পাখি দু’টিকে দেখতে আমার খুবই ভাল লাগত। মাঝে মাঝে ছোট্ট পাখি দু’টির কারিগরি জ্ঞান দেখে আমি অবাক হয়ে যেতাম। তখন খুশিতে আমার চোখ জোড়া নেচে উঠত। উত্তেজনায় আমি সাপের মত ফোঁসফোঁস করতাম। নাক দিয়ে ঘাম বের হত। বুক আমার ধড়পড় ধড়পড় করত। দাঁত দিয়ে বের হত হাসির ঝিলিক।
আমি পাখি দু’টোকে দেখতাম আর ভাবতাম, আমার এই পাখি দেখার গোপন খবর বুঝি এখনো কেউ জানেনা। এ রকম মনে করতেই পাশে তাকিয়ে দেখি আমাদের বাড়ির ইদুও আমার মত পাখি দু’টিকে দেখছে।
একদিন স্কুলে যাবার পথে পাখি দু’টিকে দেখছি। আজ কেন জানি প্রতি দিনের চেয়ে একটু বেশি সময় নিয়েই পাখি দু’টিকে দেখতে লাগলাম। আমাকে এমন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমার মা পেছন থেকে হাঁক ছাড়লেন।
-ও রিয়াদ, ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছিস? স্কুলে যাবি না?
মায়ের ডাক শুনে আমি আর দেরি না করে স্কুলে চলে গেলাম। মা যদি পাখি দু’টির বাসার খবর জেনে যান। স্কুল থেকে বাড়িতে আসতে দুপুর গড়িয়ে গেল। যখন বাড়ি ফিরলাম তখন সূর্য ঘড়িয়ে বিকাল। বিকালের সোনারোদ আমার জামার উপর খেলা করত। মা আমাকে ভাত খাইয়ে দিয়ে বললেন,
-বাপ যা এখন গিয়ে একটু ঘুমা। রাতে পড়তে হবে।
মায়ের কথা মত আমি চুপ করে চকিতে শুয়ে থাকতাম কিন্তু আমার চোখজোড়ায় ঘুম আসত না। আমি তখন নারিকেল তলার ঝোপের কথা ভাবতাম। আমার দৃষ্টিজোড়া তখন পড়ে থাকত ডুমুর গাছের টুনটুনি পাখির বাসায়। এরপর মা যখন বাইরে যেতেন তখন আমি পা টিপে টিপে ঘর থেকে বের হয়েই দেŠড় দিতাম। এক দেŠড়ে চলে যেতাম টুনটুনি পাখির বাসার কাছে। পাখি দু’টির গান শুনে আমি বিমোহিত হয়ে যেতাম। এরপর সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে আমি বাসায় ফিরে আসতাম।
একদিন ভাবলাম, আর দূর থেকে দেখা নয়। পাখি দু’টিকে আমি ধরব। বুকে জড়াব। আদর করব। এভাবে ভাবতে ভাবতে আমার দিন কাটতে লাগল।
একদিন পাখি দু’টিকে ধরার জন্য আমি বাসা থেকে বের হলাম। সেদিন ছিল শুক্রবার। মানে স্কুল ছুটির দিন। তাই আমার হাতে পর্যাপ্ত সময়। পাখি ধরার জন্য অন্য একটা ডুমুর গাছে প্রথমে কয়েকবার রিহার্সেল করে নিলাম। বাসার কাছে গিয়ে পাখি দু’টি বাসায় আছে কিনা তা যাচাই করার জন্য কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। প্রায় দশ মিনিট পর একটি পাখি বাসা থেকে বের হল। পাখিটি বের হওয়াতে আমি নিশ্চিত হলাম একটি পাখি বাসায় আছে তাই অপেক্ষা করতে লাগলাম বের হওয়া পাখিটি ফিরে আসা পর্যমত্ম। পাখিটি বাসায় ঢুকলেই আমি আমার অভিযান পরিচালনা করব। আমি বাসাটির দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকলাম। ভাবলাম, এত ছোট একটা পাখি কেমন করে এমন সুন্দর বাসা বুনল!
এসব ভেবে আমি কোনো কূল কিনারা করতে পারি না। সাদা সাদা সুতো দিয়ে সেলাই করা বাসা। কী অসাধারণ! নান্দনিক কারুকার্যময় রচনাশৈলী। যারা টুনটুনির বাসা দেখেনি তাদের কাছে আমার গল্প গল্পের মতই লাগবে। হ্যাঁ গল্পইতো তাইনা। মৃদু বাতাসে বাসাটি দুলে দুলে উঠছে। বাসাটি যখন দোলে যখন সাথে আমার মনও দুলে উঠে। আনন্দ, ভয়, উত্তেজনা আর শিহরণে আমার নাকের ডগা দিয়ে চিকন চিকন ঘাম বের হতে লাগল। একহাত দিয়ে ঘাম মুচছি আর গুটি গুটি পায়ে অগ্রসর হচ্ছি বাসার দিকে। বাসার নিকটে গিয়ে দেখলাম, বাসার দু’টো মুখ। একটি সামনে অন্যটি পেছনে। পেছনের মুখটি সামনের মুখ থেকে তুলনামূলক ছোট। ভাবলাম, এই টুনটুনিটি ধরতে আমাকে দু’টো হাতই ব্যবহার করতে হবে। বাম হাত বাসার পেছনে ডান হাত বাসার সামনে দিয়ে চেপে ধরব। যাতে হাত ফসকে পালিয়ে যেতে না পারে। সেদিন সত্যি সত্যি আমি পাখি দু’টোকে ধরলাম। ধরে কোঁচড়ে করে বাসায় নিয়ে এলাম। লুকিয়ে রাখলাম যাতে কেউ না দেখে। তিনদিন পর মা দেখে ফেললেন। ইতোমধ্যে পাখি দু’টি অনেক শুকিয়ে গেছে।
মা পাখি দু’টিকে দেখেই বললেন,
-বাবা পাখি দু’টোকে ছেড়ে দাও। বনের পাখি বনেই সুন্দর মানায়। পাখি প্রকৃতির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। মা আরো বললেন, জানো বাবা, আমাদের মহানবী (সা.) পাখিকে কষ্ট দিতে নিষেধ করেছেন।
মায়ের কথা শুনে আমি পাখি দু’টোকে ছেড়ে দিলাম। আমার সামনে দিয়ে পাখি দু’টি উড়ে বাঁকা নারিকেল গাছের ঝোপের নিচের বাসায় চলে গেল। আমি এক দৃষ্টে পাখি দু’টির উড়ে যাওয়ার দৃশ্য অবলোকন করলাম। আনন্দে আমার মন নেচে উঠল। সেই থেকে আমি কখনো আর পাখিকে কষ্ট দিইনা। পাখি শিকার করিনা। পাখির ডিম নষ্ট করিনা। পাখি ধরি না।