ক.
সুগোল জাম্বুরা আর বিড়াল-বেলুনের সমার্থক ছিল দূর্গাবিষর্জন। আমার ইচ্ছে ছিল এই বিষয়টি নিয়ে কিছু কথা বলবার। কিন্তু আমার ছোট বোন, আমার পিঠেপিঠি টুনটুনি বোন এসে হাজির হয়। তাকে নিয়েও গল্প বলা যেতে পারে। কারণ, সে ভেবেছিল, ঈশ্বর হয়তো বাবার মতো মানুষ অথবা বাবাই ঈশ্বর। আশলে সেসময় এক-দুই-তিন করে ডিকবাজি দিচ্ছিল শৈশব। তাই আমি, আমার বন্ধু নুরুজ্জামান, ইউনুস কনটেকাটারের ছোট ছেলে জহুর তখন সবাই মিলে সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠিরে মার্তিল-মার্তিল। জহুর অথবা কে যেন বলে ওঠে, “চেলেঞ্জ!”
– অই গুলিটাকে লাগাইতে পারবি? পারবি না।
– তুই কি হাফিজ চাচার মতো বড় যে পারবি?
– বলতো দেশের সবচে বড় মানুষ কে?
আমি বলি “হাফিজ চাচা”। অন্যসময় সবাই সেটাই বলে। কারণ, আমরা সবাই জানি হাফিজ চাচার মতো লম্বা মানুষ পুরো নিউটাউনে আর একটিও নেই। কিন্তু সেদিন নুরুজ্জামান বলেছিল ভিন্ন কথা, বলেছিল-এরশাদ, পেসিডেন্ট।
তার কথাতে যুক্তি ছিল। আশলে আমি মেনে নেওয়া পক্ষে ছিলাম। তারপর আমার চুই-গুল্লি নিয়ে চম্পট দেয় কেউ। হয়তো আমারই সুহৃদ, বন্ধুজন! তবুও জহুর বলে, নুরুজ্জামান বলে-মাইরি আমি তোর চুই নেই নি।
মাইরি কেটে মিথ্যে বলা যায় না, সেটা আমাকে শিখিয়েছিল জহুর-নুরুজ্জামান। সেদিন সেই বিশ্বাস ভাঙে। ততোদিনে আমসুপারি টিফিনে আমার আস্তা টাকা বদল হয়ে গেছে জহুরের সাথে। আস্তা টাকার বিনিময়ে আমি পেয়েছিলাম একটা সিকি আর দুইটা দশপাই। তারপর যা হবার তাই, দোকানি আর দশটা সন্দেশ দেয়নি কোনদিন।
খ.
হাসুবুড়ার পুকুর, ডুমুরপাড়া ভাটাপুকুর পেরুলেই পরীরাজ্য পুলহাট। চিঠি এসেছে বারবার। পুলহাটের আকাশ দিয়ে চলে যায় চাটায়াল গুড্ডির উড়াল। প্যাক গুড্ডি ধরবে বলে পেছন পেছন বাছুর পালায়। তার সাথে মাঞ্জা কাটা সুতোয় উড়ে-উড়ে উড়ে গেলেও আমার ছিল লক্ষণরেখা। বাবার কড়া শাসনের দুপুর। তারপরেও একটা দিন দুপুরে জলপাই দীঘিতে চোখে-চোখে ভর করে লালপদ্ম। সাতালপাড়ার খেড়-পূজার বান খাওয়া খামালটার চোখ যেন আরো লাল হয়ে ওঠে! জানা হয় না, বাবার চোখ কি করে নিমিশেই খেয়াল বদলায়? তেমনি জানা হয না, লোডশেডিংয়ের সন্ধায়-নাজুপাঞ্চর কালো তিল কেনো যে এতো পিদিমজ্বলা জ্বলে! সেই তিলের কাছে তিশিক্ষেত হয়ে বসে থাকে অবাক-করা ফুল।
রাস্তায় ডাক দিয়ে যায় ভদু পাগলা
-পাখি লাগবো পাখি, একখান বনটিয়া? মুনমুনিয়া পাখি?
আমার একটা বনটিয়া পোষার ইচ্ছে ছিল, দ্বিতীয় শ্রেনী থেকে কড়া রোদ অবধি। পাখিওলা শুধায়, খাওয়া দিতে পারবা নি?
-কি খায় তোমার টিয়া?
-খায় তো অনেক কিছু, কিন্তু বেশি লাইক করে, পাকা মরিচ। টকটকা পাকা মরিচ!
আমি অবাক হই নাজুপাঞ্চ কি করে ঠোটে এমন লাল রং চাপল?
আমি বলি-ও টিয়া, টিয়া, কোথায় ছিলা এতোদিন? টিয়া কিছু বলে না। বলি না, আমিও। তাই দেখে সেদিনই বাবার কন্ঠে ডেকে ওঠে ঈস্রাফিলের শিঙার ডংকার। বাবা বলে-কৈ গেছিলি? বল জবাব দে। শত মারেও সত্য বলি না। আমি বলি, সাইদের সাথে ৮ নম্বরে খেলতে গেছিলাম। এখানেই তো ছিলাম, বাবু ভাইদেও বাড়ি। এভাবে অনেকদিন পরে খেয়াল হয়, আমিও মিথ্যে বলতে শিখে গেছি। আমারও মনে হয়-সব সময় মিথ্যে বলাটা খারাপ কিছু না। মাঝে মাঝে বলা যেতে পারে। গীতায় যেমনটা বলা হয়েছিল, অপ্রিয় সত্য বলো না, সেই রকম। তাই বাবা শুধালে বলি-ছিলাম ওখানে, ছিলাম সেখানে। আশলে তখনো আমি মিকাইলের জল-মেঘের মতো সরল। জলও একদিন জেনে যায় অবস্থা ভেদে আকার-আকৃতি বদলানোর জরুরী কৌশল।
গ.
এমনিভাবে বহুগুলো ভাসানের মেলা, অনেকগুলো ঈদগাহঞ্চর মাঠ এসে চলে যায়। ছোটবেলা হলে ভাবতাম, একটা কানিবুড়ি দিনগুলোকে তার ঝলার মধ্যে পুরে নিয়ে কাহারোলের জঙ্গলে চলে গেছে। কি অবাক রকমের শৈবব! শৈশব হয়তো একই রকম থাকে। এই যে আমার অনাগত মেয়ে তার আগত দাদার সাথে খুঁনসুটি করছে। তার দাঁড়ি ধরে ঝুলছে, জামার পকেটে কেঁচো কিংবা ঘুঘরী-পোকা ঢুকিয়ে রাখছে। বাবা তাই দেখে চমকে যায়। বলবে, কে করছে এই কাজ? তুমি? তুমি?
আমি জানি না বিষয়গুলো ঠিক কেমন? মেয়ে বলেছিল কি?
– আমি না, আমি না।
তারপর সে হাসবে। হিহিহিহি। কাল আজ হবে। আজ কাল হয়। তাই আজ এতোদিন পর অথবা এতোদিন আগেই সান্ধ্য-খিড়কি পথে বাবা আমার মেয়েকে শেখাচ্ছেন টিয়েপাখির পাঠ :
– মিথ্যে বলো না টুনি…নাইলে আল্লা ঠোট কেটে নেবে।
মেয়েও আদুরী। মাথা ঝাকাচ্ছে। সত্যি তাই? মেয়ে বারবার অবাক হয়
– ঠোট কেটে নিবে?
– হে কুচুৎ করে কেটে নেবে!
তখন হয়তো মেয়ে বলে-“বাবা, দাদু কি বলতে জানো”? আর আমি দেখি, ছোট ছোট পায়ে কি মমতার টান! বাড়িয়ে দেয়া হাত। আহারে… মেয়ে, কেনো বড় হবি? কেনো বড় হবি? এরকম একবার বাবার কথা শুনে আমি বলেছিলাম-ফালতু কথা। ফালতু কথা। বাবা বলে-না মোটেই না, তুমি এর হাতেনাতে ফল পাবে। আমি তোমাকে তাই দন্ড দিচ্ছি। তখন পাশে আমার বোন তাকিয়ে ছিল বিড়াল-বিড়াল চোখে অথবা সে একদিন তাকিয়ে থাকবে। তার পাশে আমার মেয়ে। ঠিক তখনই, আমি সত্যি সত্যি একটা ঠোটকাটা টিয়ে পাখি হয়ে যাব। ফলে আমি চেচাইদেখো আমরা একটা ঠোটকাটা টিয়ে পাখি হয়ে গেছি। দেখো… দেখো। কিন্তু আমার কথা কেউ শুনে পাবে না।
বাবা, মা, আমার বোন, জহুর, নুরুজ্জামান, অথবা তিশিফুল নাজুপা ওরা কি ছল করেনি কখনো? আমি তো জানতাম, তারা আমার চেয়ে কোনো অংশে কম ছল করবে না। কিন্তু আপনারা জেনে নিন, তারা কেউ দন্ডিত হয়নি। কারণ, তাদের সবার ঠোট অক্ষত থাকবে। কেবল আমিই একটা ঠোটকাটা টিয়ে পাখি হয়ে গেছিলাম। হয়তো গতকাল হয়ে যাওয়া আগামীকালে। আজ তাই আমি লেজ নাড়াচ্ছি অথবা আপনারা টের পাবেন না। হয়তো তিন তীথি আগেই তেমনটি হয়ে গেছে, আমি সেঁধিয়ে গেছিলাম ফণিমনষা-সন্ধার আরো দূরতম কোনো অজ্ঞাত কোটরে অথবা আজ থেকে তিন তীথি পরে তেমনটা ঘটবে। তেমনটি ঘটবেই। লেজ নাড়িয়ে আমাকে পালিয়ে যেতেই হবে উঠোনের তারা-ধরা আমলকির ডালে। আমাকে যেতেই হবে। পাছে আমার মেয়ে যদি আমাকেই ঈশ্বর ভেবে বসে!
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।