গ্রামটির নাম শালবাগ। এই গ্রামের কোথাও একটিও শালগাছ নেই। এই গ্রামের নাম কেন শালবাগ হলো আজতক কেউ সঠিক করে বলতে পারে না। গ্রামটিতে শাল গাছ না থাকলেও এর সৌন্দর্য কম নয়। এর পাশ দিয়ে কর্ণফুলি নদীটা বয়ে যাওয়ায় তার রূপও যেন বেড়ে গেছে অনেকগুণ। দিনরাত নদীর কলকল ধ্বনি। নদীর ওপর ঝাঁক ঝাঁক পাখির ওড়াওড়ি। কার না ভালো লাগে?
বাহার আলীর চৌদ্দ পুরুষ ধরে এই গ্রামেই ব্যবসা। দুঃখ কষ্টের সংসার। বাপের এক বিঘা জমি আছে ঠিকই কিন্তু ধান গম কিছুই হয় না। গত বছর শহর থেকে তরমুজের বিচি এনে লাগিয়েছিল জমিতে। তরমুজও হয়েছিল প্রচুর। কিন্তু বিধি বাম। তরমুজ একটুও মিষ্টি ছিল না। লাল টকটকে তরমুজ মিষ্টি হয় না-ব্যাপারটা বাহার আলীর কাছে অবোধ্যই রয়ে গেল।
শালবাগ গ্রামটায় এখনো বিদ্যুৎ আসেনি। কতো লোকে ওয়াদা করে গেছে বিদ্যুৎ দেবে দেবে। কেউই দেয়নি। পনের বছরের জীবনে কত বড় বড় লোকের ওয়াদা শুনেছে বাহার আলী কিন্তু কেউ ওয়াদা রাখেনি। এই কর্ণফুলিটা কোনমতে বাহার আলীর জীবন সংসারকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
সকাল বিকাল দুই টাইম জাল নিয়ে বের হয় সে। সকাল বেলা যা পায় তা-ই মাকে রান্নার জন্য দেয়। বিকালেরটা বাজারে নিয়ে যায়। কোনদিন দশ বিশ পায় আবার ভাগ্য ভালো হলে কোনদিন ত্রিশ চল্লিশও পায়। বাহার আলীর বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে কোনমতে দিন চলে যায় তার।
একদিন বাহার আলীর মাথায় হঠাৎ নতুন বুদ্ধি গজায়। রাত্রে মাছ মারতে গেলে কেমন হয়? যেমন ভাবনা তেমন কাজ। ও ঠিক করে আজ রাতেই মাছ মারতে যাবে কর্ণফুলিতে। রাতে নিশ্চয় মাছেরা নদীর তীরের কাছ ঘেঁষে ঘুমায়। এই বুদ্ধিটা তার মাথায় এতোদিন কেন আসেনি ভেবে কূল পায় না বাহার আলী।
বাহার আলীর শরীরের একটা সমস্যা ছাড়া আর অন্য কোন সমস্যা নেই। সাত বছর বয়সে তার গলার ডান পাশে একটা ছোট টিউমার দেখা দেয়। প্রথম প্রথম সে ভেবেছিল হয়তো একদিন চলে যাবে। কিন্তু চলে আর যায়নি। দেড় বছর না যেতেই টিউমারটা বড় হয়ে যায়। মাথাটা নাড়াচাড়ায় তার বেশ কষ্ট হয়। একদিন বাহার আলীর বাবা তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। ডাক্তার বলল- শহরে নিয়ে অপারেশন করতে হবে। অনেক টাকা লাগবে। পঞ্চাশ হাজারও লাগতে পারে। এতো টাকা পাবে কোথায় বাহার আলীর বাবা? যার নুন আনতে পান্তা ফুরোয়? এরপর ডাক্তারি চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে বাহার আলীর বাবা। আল্লাহ্র ওপর ছেড়ে দেয় সবকিছু।
অন্য রাতের চেয়ে এই সময়টা তার কাছে কেমন কেমন লাগে। আকাশে জোছনার চাঁদ থাকায় চারপাশে দিনের মতই মনে হয়। রাতের ছমছমানি পরিবেশ নেই। জালটা কাঁধে নিয়ে নদীর পাড় ঘেঁষে হাঁটতে থাকে বাহার আলী। কিছুদূর হেঁটে একটা জায়গায় এসে থামে। জালটা খুলে। চারপাশে সুনসান নীরবতা। একটুও শব্দ নেই কোথাও। জালটা কনুইয়ে পেঁচিয়ে মারবে- এই সময় পেছন থেকে শব্দটা আসে। খুট করে একটা শব্দ। শব্দটার সাথে সাথে একদলা বাতাসও তার গা ছুঁয়ে চলে যায়। বাহার আলী অনুভব করে বাতাসের সাথে একটি মিষ্টি গন্ধও চারদিক ছড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশের কোন ফুলের চেয়েও এই গন্ধ অনেক মিষ্টি। এমন মিষ্টি গন্ধ বাহার আলী আর কোনদিন পায়নি।
বাহার আলী পেছনে ফিরে তাকায়। তাকিয়ে তার পিলে চমকে যায়। শরীরে একটু একটু কাঁপুনি শুরু হয়। মেয়েটি বাহার আলীর অবস্থা দেখে হাসে।
মেয়েটি ধীরে ধীরে তার ডানা দু’টো গুটাতে থাকে। যেভাবে পাখিরা তাদের ডানাগুলো শরীরে গুটিয়ে ফেলে।
বাহার আলী ধরা গলায় বলল- কে তুমি? এতো রাত্রে এখানে কেন?
‘আমাদের কোন দিন রাত নেই। আমরা দিনে যেমন দেখতে পাই, রাত্রেও পাই।’
‘তুমি কি পরী? মানুষ হলে তোমার ডানা হবে কেন?’
‘তুমি ঠিকই বলছো। আমি পরী। কখনো কখনো আমরা তোমাদের দেশে আসি।’
‘তোমাদের দেশ কি আলাদা? আমেরিকার পাশেই তোমাদের দেশ?’
‘না আমরা অন্য জগতে থাকি।’
‘অন্য জগত মানে? দুনিয়ায় কি আরো জগত আছে?’
‘আছে। দুনিয়ার তুলনায় তোমাদের দেশটা একটা বালিকণার মতো। আমাদের দেশ তোমাদের দেশের চেয়ে অনেক বড়, অনেক শান্তিময়।’
‘তুমি এখানে এসেছো কেন?’
‘তোমার কাছে এসেছি?’
‘আমার কাছে? কেন, কেন?’
‘তুমি রাত্রে জাল ফেলো না।’
‘জাল ফেলবো না? কেন ফেলবো না?’
‘রাতে মাছেরা ঘুমায়। বাচ্চা কাচ্চা বুকে নিয়ে ঘুমায়। পৃথিবীর সব প্রাণীর ঘুম নিদ্রা আছে। ওদেরও আছে। ঘুমের ভেতর কাউকে জাগাতে নেই।’
‘তাহলে আমরা খাবো কি? তুমি জানো কাল বিকেলে আমি একটুও মাছ পাইনি। কাল বাবার কাশিটাও বেড়েছে। টেবলেট কিনতে পারিনি। তুমি আমাকে বাধা দিও না।’
‘তুমি আমার সাথে যাবে?’
‘কোথায়?’
‘আমাদের দেশে। বাবাকে তোমার অসুবিধার কথা বুঝিয়ে বলবো। বাবা আমার সব কথা শোনে। তোমার লাভ হবে।’
‘আমি কীভাবে যাবো?’
‘তোমাকে নিয়ে যাওয়াটা খুব সহজ। আমার কাছে তুমি একগ্রাম ওজনের চেয়েও কম।’
‘বলো কী?’
‘হাত ধরো। ধরো না!’
বাহার আলী পরীর দেশে গিয়ে অবাক। হাজার হাজার পরী এসে তাকে ঘিরে ধরলো। কেউ কেউ তার গায়ে সুগন্ধি ছিটাতে লাগলো কাছে দূর থেকে। চারদিকে পূর্ণিমার জোছনার মতো আলো। বাহার আলীর অবাকের বৃত্তটা আস্তে আস্তে বড় হতে থাকলো।
একটু পরে রাজমুকুট পরা একটা লোককে আসতে দেখা গেলো। মুকুটপরা লোকটার পেছনে পেছনে পরী মেয়েটি।
মুকুটপরা লোকটি বলল- ‘তোমার নাম বাহার আলী?’
‘জ্বী।’
‘তোমার কি খুব অভাব?’
‘জ্বী।’
‘কাজ করতে পারো না?’
‘গলার টিউমারের জন্য ভারী কাজ করতে পারি না।’
‘ও আচ্ছা।’
পরী মেয়েটি বলল- ‘তুমি ওকে এ তো প্রশ্ন করছো কেন বাবা?’
‘প্রশ্ন করতে পারবো না?’
‘না।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। কবিরাজ……’
দুড়দাড় করে অন্যপাশ থেকে দু’জন পরী দৌড়ে এলো। তারা দু’জন রাজার সামনে এসে দাঁড়াল।
‘জ্বি জাহাপনা।’
‘বাহার আলীর গলার টিউমারটা খুলে ফেলো। বাংলাদেশে সে চিকিৎসা করতে পারেনি। গরীব মানুষ।’
দু’জন কবিরাজ পরী বাহার আলীর গলায় আলতো হাত ছোঁয়া মাত্রই টিউমারটা খুলে গেলো।
সাথে সাথে বাহার আলীর হাত দু’টো গলায় চলে গেলো।
সত্যিই তার গলা থেকে টিউমারটা চলে গেছে। মুহূর্তে বাহার আলী তেত্রিশ কোটিবার আল্লাহ্র কাছে শুকরিয়া আদায় করলো।
রাজা ফের বলল- ‘বাহার আলী আর কী চায় মা মণি?’
‘ওকে অনেক অর্থ দাও বাবা।’
‘কতো দেবো?’
‘আর যেন অভাব না থাকে।’
রাজা তিন মুঠো হীরে মুক্তো হাতে দিয়ে বলল- ‘এগুলো নাও। কাল থেকে তোমার কোন অভাব থাকবে না।’
রাজা বলল, ‘মা-মণি তুমিই কি ওকে ওর দেশে দিয়ে আসবে?’
‘আমি এনেছি, আমিই তো ওকে রেখে আসবো। এটাই তো তোমার দেশের নিয়ম।’ ঠিক আছে, তুমিই ওকে নিয়ে যাও। তাড়াতাড়ি এসো।’
বাহার আলীকে নিয়ে পরী মেয়েটি আবার আকাশে ওড়াল দিলো। সেকেন্ডের ভেতরই বাহার আলী ঘরে পৌঁছে গেলো।
বাইরের প্রচন্ড চেঁচামেচিতে বাহার আলীর মা জেগে গেলো। বাহার আলীর বৃদ্ধ পিতাও জেগে খুক খুক করে কাশতে থাকলো। বাহার আলী আধো ঘুমে বাইরের চেঁচামেচি কান পেতে শুনতে থাকলো।
এক সময় বাহার আলীর অলক্ষে একটা হাত গলার নিচে চলে গেলো। না, টিউমারটা আগের জায়গায় আছে। একটু আগে সে যে জগতে ছিল সেটা ছিল স্বপ্নের জগত। স্বপ্নের জগত যে এতো মজার হয় বাহার আলীর আগে তা জানা ছিল না।
চেয়ারম্যান সাহেবের গলা শুনে সে ধড়মড় করে ওঠে বাইরে বেরিয়ে পড়লো। তাদের ওঠোনে লোকে লোকারণ্য। চেয়ারম্যানের পেছনে কয়েক জন পুলিশ। পুলিশ দেখে বাহার আলীর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যেতে থাকলো।
একজন পুলিশ অফিসার বাহার আলীর সামনে এসে দাঁড়াল। তার হাতে একটা কাগজ। এটা কিসের কাগজ? সমন টমন নয় তো? বাহার আলী কিছুতেই হিসেব নিকেশ মেলাতে পারল না।
পুলিশ অফিসার বলল- ‘তোমার নাম কি বাহার আলী?’
‘জ্বী।’
‘পিতার নাম?’
‘নগর আলী’
‘কাল তোমাকে শহরে যেতে হবে।’
‘শহরে যেতে হবে? আমি তো চুরি ডাকাতি করিনা হুজুর। আমি যা পাই তা-ই-মা-বাবাকে নিয়ে খাই।’
‘তুমি চুরি ডাকাতি করো কে বলল?’
‘তাহলে শহরে যাবো কেন?’
‘অপারেশনের জন্য।’
‘কিসের অপারেশন?’
‘টিউমারের। বিদেশ থেকে একটা মেডিকেল টিম এসেছে। এই টিমে পৃথিবীর নামকরা ডাক্তাররাও আছে। ওদের অপারেশনে তুমি একদম ভালো হয়ে যাবে। কাল তোমার জন্য গাড়ি আসবে। সাতদিনেই ভালো হয়ে যাবে।
‘এই সাতদিন ওরা খাবে কী?’
‘কোন চিন্তা করতে হবে না। এক মাসের ঘর-খরচও দেয়া হবে। রাজী?’
‘জ্বী রাজী।’
বাহার আলীর দু’চোখ ফেটে পানি এলো। এই পানি কষ্টের নয়, সুখের। বাহার আলীর হাতে পয়সা নেই। পয়সা থাকলে সে এক্ষুনি একটা সাদা কবুতর কিনে আকাশে উড়িয়ে দিত।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।