ঝ রা মু কু ল— মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান

কিছুক্ষণ আগে সূর্য অস্ত গেছে। সোনালী আভা তখনও পশ্চিম আকাশের গায়ে লেগে আছে। কামাল হারিকেনটা জ্বালিয়ে জানালা খুলে বই বের করে পড়তে বসেছে। কিন্তু পড়তে মন বসছে না। খোলা জানালা দিয়ে দূর আকাশের অসংখ্য তারকারাজী দেখা যাচ্ছে। শরতের স্নিগ্ধ বাতাস ঝির-ঝির করে বয়ে চলেছে। হঠাৎ পাশের বাড়ি থেকে রেডিওতে গান ভেসে আসে ‘‘স্মৃতির বেদনা…. আজ কেমনে ভুলি।’’ কামালের শূন্য দৃষ্টি চৌকির উপর গিয়ে পড়ে। আজও ওর ঘর-বিছানা, পড়ার টেবিল, বই-পুস্তক যেন হুঁ হুঁ করে কাঁদে।

পাশের দেয়ালের বাঁধানো ছবি খানার উপর দৃষ্টি পড়তেই কান্নায় ভেঙে পড়ে কামাল। কামালের বড় আপার ছেলে স্নেহের মুকুল আজ আর নেই। চিরতরে বিদায় নিয়েছে পৃথিবীর বুক থেকে। যতবার মুকুলের কথা মনে হয়, ততবার নিজেকে সংবরণ করতে পারে না। কামালের চোখের জল আর বাঁধা মানতে পারে না। মন কোন এক দূর-দূরান্তে ছুটে যায়। দগ্ধ হৃদয় যেন কথায় টন টন করে উঠে। মুকুলের মিষ্টি মিষ্টি কথাগুলো মনে হলে কামাল ভুলে যায় লেখাপড়া, ভুলে যায় আহার নিদ্রা। হারিয়ে যায় বিগত দিনের স্মৃতির মধ্যে। তখন দূরের আকাশের পানে চেয়ে থাকে। মনে করে মুকুল অসীম আকাশের গায়ে তারকারাজির সাথে মিলে মুখ টিপে টিপে হাসছে। কামাল বড় আপার বাড়ি থেকে লেখাপড়া করে স্কুলে। সে জন্যে মুকুলের সাথে ভাব করতে ওর বেশী সময় লাগেনি। শেষে এমন হয়ে গেল যে, কামাল ছাড়া কিছুই বুঝতো না। সময় অসময় বিরক্ত করে তুলতো। বই পড়ছে, কোথা থেকে চুপি চুপি এসে চোখ টিপে ধরতো। অমনি মুকুলের হাত ধরে সামনে নিয়ে বলতো- ‘‘দুষ্টু ছেলে একটু বাইরে যাও, না হয় চৌকির উপর বসে বসে সুন্দর ছবি দেখ বইতে কেমন।’’ অমনি একটা বই নিয়ে ছবি দেখতে আরম্ভ করতো। স্কুল থেকে বাড়ি এলেই দেখত মুকুল অপেক্ষা করছে। ওর একান্ত প্রিয় ছিল চকলেট। যখন একটা একটা করে মুখে তুলে দিতো, তখন এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতো কামালের দিকে।

জানালার পাশে চেয়ারে বসিয়ে সোহাগ করে বলতো- ‘‘আমার সোনা মণি একটা গজল গাওতো, অমনি আরম্ভ করে দিতো। কোন গজলের এক লাইন, আবার কোনটার দুই লাইন গাইতো। তার বেশী বলতে পারতো না। তবে সব চেয়ে আশ্চর্য ছিলো ওর স্মরণ শক্তি। দুই-তিন বার বলে দিলেই মনে করে রাখতে পারতো। একদিন মুকুলের টেবিলের উপর থেকে কাঁচের একটা জগ ফেলে দিয়ে ভেঙে ফেলে। তার জন্য ওর মা একটু ধমক দেয়। কামাল সে সময় বাড়িতে ছিল না। কিছুক্ষণ পর এসে দেখে কামালের বিছানায় দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছে। ওর গায়ে হাত রাখতেই ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠে বলে ‘‘মামা আম্মু বকেছে।’’ কামাল ওর আপাকে বলে ‘‘আপনি মুকুলকে ধমক দিতে পারলেন।’’

এই বলে বেশ একটু বকলো। তারপর মুকুলের হাত ধরে বাড়ির বাইরে নিয়ে এলো। এমনি করে দুষ্টুমি আর মান-অভিমানের ভিতর দিয়ে চলে যাচ্ছিল দিনগুলো। অন্য দিনের মতো সে দিন স্কুল ছুটির পর মুকুলের জন্য চকলেট নিয়ে বাড়ি আসার জন্য পথে নামতেই পায়ে হোঁচট খায় কামাল। অমনি কি এক অজানা আশঙ্কায় মনের মধ্যে দুরু দুরু করে উঠে। বড় রাস্তা থেকে বাড়ির পথে পা বাড়ায়। তখন হঠাৎ কান্নার আওয়াজ কানে আসতেই এক দৌড় দেয় কামাল। বাড়ি পৌঁছে ওর ঘরে প্রবেশ করে যা দেখলো, তাতে আকাশ ভেঙে মাথায় পড়লো। মুকুলের মায়ের বুক ফাটা আর্তনাদ যেন বাতাসে মিশে দিক দিগন্তে হাহাকার ছড়িয়ে দিচ্ছে। সবার কাঁদনে সারা বাড়ি শোকের ছায়া নেমে আসে।

কামাল স্কুলে যাবার পর মুকুল বার কয়েক পাতলা পায়খানা ও বমি করে। কাল রাক্ষসী ডাইরিয়ায় মুকুলকে আক্রান্ত করে। মুকুল চোখ মেলে একবার মায়ের দিকে চাইলো। ঠোঁট দু’টো ফাঁক করে মনে হয় কি যেন বলতে যায়। ওর মা এক চামচ পানি তুলে মুকুলের মুখে দিলো। তারপর কামালের নয়ন মণি, স্নেহের দুলাল বড় আপার একমাত্র সন্তান চার বছরের মুকুল শান্ত হয়ে আস্তে আস্তে চোখ দু’টো বন্ধ করে ফেলে। তারপর কামালের বিছানায় গভীর ঘুমে এলিয়ে পড়ে। সে ঘুম অনন্ত কালের ঘুম। যে ঘুম থেকে কেউ কোন দিন জেগে উঠে না। বাগানের ফলবান গাছে ফল না আসতেই অকালে ঝরে গেল একটি ‘মুকুল’!!

আরো পড়তে পারেন...

সুবর্ণগোলক—-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

কৈলাসশিখরে, নবমুকুলশোভিত দেবদারুতলায় শার্দ্দুলচর্ম্মাসনে বসিয়া হরপার্ব্বতী পাশা খেলিতেছিলেন। বাজি একটি স্বর্ণগোলক। মহাদেবের খেলায় দোষ এই-আড়ি…

বসন্ত এবং বিরহ—-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

রামী। সখি, ঋতুরাজ বসন্ত আসিয়া ধরাতলে উদয় হইয়াছেন। আইস, আমরা বসন্ত বর্ণনা করি। বিশেষ আমরা…

গর্দ্দভ– বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

হে গর্দ্দভ! আমার প্রদত্ত, এই নবীন সকল ভোজন করুন।১ , আমি বহুযত্নে, গোবৎসাদির অগম্য প্রান্তর…