
আমি ঝালং। খুব সুন্দর একটা পাহাড়ি জায়গার নামে আমার মা রেখেছিল আমার নাম। ঝালংয়ে আমি অবশ্য কখনও যাই নি। মা হয়তো নিয়ে যেতো কোনও দিন-কিন্তু আমি যখন ক্লাস ওয়ান, আমায় ছেড়ে চলে গিয়েছিল মা। আমার মা বলতো ভালো মানুষ মরে গেলে স্বর্গে যায়, দুষ্টু লোক নরকে। মা খুব ভালো ছিল, তাই মা স্বর্গে গেছে আমি জানি। বাবা বলে যে মরা মানুষের ছবি বাড়িতে রাখতে নেই, তাই মায়ের কোনও ফটো নেই আমাদের বাড়িতে। আমি এখন এইটে পড়ি। সাদা আর আর আকাশী ইউনির্ফম আমাদের স্কুলের।
সামনের বার আমার শাড়ি হবে। স্কুলে যেতে আমার একটুও ভালো লাগে না। পেটে ব্যাথা, মাথায় ব্যাথা-এইসব বলে টলে আমি প্রায়ই বাড়িতে শুয়ে থাকি। স্কুলে যাই না। কী করবো বলো,বইয়ের পাতায় আমার কিছুতেই মন বসে না। প্রতিবার এনুয়াল পরীক্ষা বিচ্ছিরি রকম দিয়ে এসে চুপ করে বসে থাকি। তখন ঠাকুরকে ডাকি খুব করে। ঠাকুর কিন্তু ভালো, বাবার মতো রাগী নয়। আমার কথা শোনে-তাই হয়তো টেনেটুনে পাশ করে যাই প্রত্যেকবার। পাশ না করলে যে বাবা আমায় খুব বকবে! বাবা হাসিখুশি মানুষ, সহজে রাগে না।
তবে যদি কখনও বাবা রেগে যায় আমার খুব ভয় করে। তখন আমার পিঠে পড়ে দু-চার ঘা। মা যে বছর স্বর্গে চলে গেল তার পরের বছর এ বাড়িতে এসেছিল ভাল-মা। আর তার পরের বছর রিশপ হল। রিশপ ভারী মিষ্টি দেখতে। ফর্সা, কোঁকড়া চুল, স্বপ্নের মতো চোখ দুটো। পাহাড়ি জায়গার নামে আমার নাম ঝালং, তার সঙ্গে মিলিয়ে ভাল-মা ভাইয়ের নাম দিয়েছে রিশপ। রঙীন ছবির বইতে যেমন থাকে, রিশপ জায়গাটাও তেমন-খুব সুন্দর। রিশপ ছোট, ও এখন টু-তে পড়ে। গেলবার ওর জন্মদিনে বাবা আর ভাল-মা ওকে নিয়ে গিয়েছিল রিশপে।
তিনদিনের জন্য। তখন পাশের শুক্লা কাকিমার কোয়ার্টারে ছিলাম আমি। ওরা ফিরে আসার পর রিশপ জায়গাটার গল্প শুনেছি ভাইয়ের কাছে। ও তো ছোট, ভালো করে বলতে পারে না। তবে বুঝেছি যে রিশপ জায়গাটা সত্যি সত্যি দারুণ।
ভাই, বাবা আর ভাল-মায়ের সাথে শোয়। ওর কিন্তু লেখা পড়ায় খুব মন। ও একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। ভাল-মা সেদিন শুক্লা কাকিমার কাছে গল্প করছিল-খুব খরচ সেই স্কুলে। ঝকঝকে ইউনির্ফম ওদের স্কুলের। ভাইয়ের এখন মেরুন হাফপ্যান্ট আর সাদা শার্ট। আর মেরুন টাই। বুকে আবার সুতো দিয়ে কাজ করা একটা প্রদীপের শিখা। তার নিচে স্কুলের নাম লেখা। ভাই যখন টাই পড়ে তখন ধবধবে ভাইটাকে মনে হয় যেন একেবারে যেন বিলেতের কোন সাহেবের বাড়ির বাচ্চা। এবার ওয়ান থেকে টুয়ে ওঠবার সময় ভাই থার্ড হয়েছিল।
বাবা তাই ভাইকে খুব আদর করে। ভাল-মাও তো ভাইকে খুব ভালো বাসে। চুপচুপ করে ভাইকে ফ্রিজ খুলে এটা সেটা খাওয়ায়। মাছের ভালো টুকরোটা রাখা থাকে ভাইয়ের জন্য। আমিও ভাইকে খুব ভালোবাসি। স্কুলের টিফিনের পয়সা জমিয়ে ওর জন্য একটা ক্রিকেট খেলার ব্যাট নিয়ে এসেছিলাম গতবার ওর জন্মদিনে। বাবা পিঠ চাপড়ে বলেছিল, সাবাস মেয়ে। আমার খুব আনন্দ হয়েছিল।
আমাদের বাবা রেলে চাকরি করে তো, তাই আমরা রেল কোয়ার্টারে থাকি। আমাদের রেল কোয়ার্টারে এসেছ কখনও? ওমা, আসোনি? ওই তো স্টেশনের পাশে দেখ লাল রঙের একতলা ছোট্ট ছবির মতো বাড়িটাই তো আমাদের। ওই যে গো, যে বাড়িটার সামনের ফুল বাগানে গুচ্ছের গাঁদা ফুল ফুটে আছে। মরশুমি গোলাপও ফুটেছে কত দেখ। বিরাট একটা গুলমোহর গাছও রয়েছে, পাহারা দিচ্ছে আমাদের কোয়ার্টারটাকে। ফাল্গুন মাস পড়ে গেছে তো, লাল রঙের ফুল ফুটেছে, লাল হয়ে রয়েছে গাছটা।
আরও দু-তিনটে গাছ দেখ শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে গুলমোহর গাছটার পাশে। দাঁড়াও, চৈত্র মাস আসতে দাও, দেখবে ওগুলোর দুষ্টুমি। ঝড়ে ওরা পাগলের মতো নাচানাচি করতে থাকবে তখন। ওই দেখ গুলমোহরের পাশে ওটা কী গাছ বল তো? ঠি বলেছ, ওটা বাঁদড় লাঠি গাছ। আর তার পাশে দেখ হলদে ফুলের রাধা চূড়া। কি মিষ্টি দেখতে না! আর ওই যে একদম কোণার দিকটা তাকাও ওটা জারুল গাছ।
যখন বেগুনি রঙের ফুল ফুটবে ওর ডালে ডালে তখন তোমার চোখ একেবারে জুড়িয়ে দেবে ও। বাড়ির সামনের স্টেশনটায় সারাদিনে খুব বেশি ট্রেন যায় না। যখন ট্রেন আসে, আমি গুমগুম শব্দ শুনি, আমি ছুট্টে চলে যাই স্টেশনটায়। প্লাটর্ফম দিয়ে হাঁটি। জটলা হয়ে থাকে জানলা গুলোর সামনেটায়। সবাই যাচ্ছে এখানে-ওখানে আমার বয়েসি কত ছেলে মেয়েও তো আছে ওদের দলে। তাদের ছাড়তে এসেছে বাড়ির লোক।
সবাই চিতকার করছে নিজের নিজের বাড়ির মানুষের জন্য। সাবধানে যাস সোনাই…পৌঁছে ফোন করিস…অচেনা লোকের কাছ থেকে কিছু খাস না…হটপটটার মধ্যে মাংস আছে…আর ফয়েলে হাতে গড়া রুটি…গরম গরম খেয়ে নিস…বেশি রাত করিস না…তিন্নি দার্জিলিংয়ে এখন খুব শীত, সন্ধ্যের পর আর বাইরে বেরোবার দরকার নেই ঠান্ডা লেগে যাবে…তোমার টনসিলের দোষ আছে রাজ, পাহাড়ে গিয়ে আইসক্রিম একদম খাবে না বলে দিলাম…আর হ্যাঁ,ক্যামেরাটা সাবধানে রেখো, দামি জিনিস ভেঙে ফেলো না যেন…বনি জলদাপাড়ায় হাতির পিঠে চেপে যখন যাবে জঙ্গলে ঘুরতে,তখন গন্ডার দেখতে পাবেই, ফোটো তুলে রাখতে ভুলো না…চাপড়ামারির বাংলোটা খুব ভাল, এখন খুব ভাল ওয়েদার পাবে, ওখানকার কুকটার হাতের যা রান্না না দুর্দান্ত…বুঝলি তিতির পূর্ণিমার রাতে ওয়াচটাওয়ারে বসে রুপোলি রঙের মূর্তি নদী আর তার পাশের ছমছমে কালচে সবুজ গরুমারা জঙ্গল দেখবি যখন তখন বুঝবি কাকে বলে সৌন্দর্য…।
বাবা এখানকার স্টেশনবাবু। ছোট্ট স্টেশনের অফিস ঘরে বসে। ঘরটা আমাদের জন্মের আগে একবার চুনকাম করা হয়েছিল, তারপর আর বোধহয় রং হয়নি। দিনের বেলাতেই ঘরটা কেমন অন্ধকার ম্যাটম্যাটে। বাবার মাথার পেছনে বিরাট সাইজের একটা ঘড়ি। ওপরে ঘটাং ঘটাং করে একটা ফ্যান চলে সারাদিন। মাকড়সার জালে আর ঝুলে ফ্যানটা কালচে হয়ে গেছে। কেউ পরিষ্কার করার নেই। কখনও কখনও আমায় স্টেশনে ঘুরে বেড়াতে দেখে অবাক হয়ে বাবা বলে, ঝালং তুই ফাঁক পেলেই স্টেশনে চলে আসিস কেন রে? তোর পড়াশুনো নেই! খবরের কাগজে যে দেয় দেখিস না-দিনকাল খুব খারাপ কিন্তু এখন। কোন দিন তোকে ছেলে ধরা তুলে নিয়ে চলে যাবে-তারপর পাচার করে দেবে অন্য রাজ্যে, তখন মজাটা টের পাবি। ভিক্ষে করে খেতে হবে তারপর। ভাল-মা বিরক্ত হয়ে বলে এমন উড়ন চন্ডী মেয়ে জন্মে দেখিনি বাবা! লেখা নেই পড়া নেই সারাদিন শুধু টোটো কোম্পানি!আমি লজ্জা পাই। চুপ করে থাকি। আমি যে কেনো স্টেশনে আসি, ঘুরে ঘুরে বেড়াই ট্রেনের পাশ দিয়ে-সেটা অবশ্য কাউকে বলা যাবে না। এমনকি বাবাকেও না। ট্রেনে করে যারা ঘুরতে যায় সেই ছেলে মেয়েগুলোর সঙ্গে সঙ্গে আমিও যে একছুট্টে চলে যাই দার্জিলিংয়ের ম্যালে পেস্তা দেওয়া আইসক্রীম খেতে খেতে তাকিয়ে থাকি পশ্চিম দিকের পাহাড়ের আড়লে কমলা রঙের বিরাট উলের বলটার দিকে।
তিতির, তিন্নি, সোনাই, রাজ, বনিদের সঙ্গে সঙ্গে আমিও বেড়াতে চলে যাই কালিম্পং, লাভা, লোলেগাঁওয়ের পাহাড়ে। কখনও হারিয়ে যাই জলদাপাড়ার সবুজ শাল, সেগুন, মাদার,ডুমুর, অর্জুন,লালি আর দুধে-লালির ভিড়ে। হাতির দল নুন খতে আসে যে রাস্তা দিয়ে সেই চাপড়ামারির গা ছমছম পথে ঘুরে বেড়াই ক্যামেরা হাতে। তারপর গরুমারার গহীন বনের মধ্যে শিরশিরিয়ে বয়ে যাওয়া মূর্তি নদীর ঠান্ডা হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে থাকি আমি, রাজ, বনি, তিন্নি, সোনাই আর তিতির। মাঝে মাঝে কোথায় যাই জানো, ঝালংয়ে। কি সবুজ যে সেই জায়গাটা না দেখলে বুঝতে পারবে না। নদীর ধারে একটা জায়গা আছে খুব সুন্দর। কতরকম পাখি যে ডাকে, আর কি অদ্ভুত তাদের ডাক যে আমরা কান পেতে শুনি,তাদের কিচিরমিচির। রোদের তেজ থাকে না বেশি, তবুও ছোট্ট একটা ছবির মতো পাহাড় দাঁড়িয়ে থেকে ছায়া দেয় আমাদের।
বন্ধুরা যখন খেলতে থাকে, তখন আমায় দেখে মেঘের কাপড় সরিয়ে আকাশ থেকে নেমে আসে মা। আরে না ভাল-মা নয়, আমার নিজের মা। একমাত্র এই ঝালংয়ে এলেই দেখা হয় মায়ের সঙ্গে। ফিনফিনে জরির মতো পাহাড়ি নদীটার পাশে আমরা বসে থাকি চুপচাপ। মা একটা জাফরানি রঙের সিল্কের শাড়ি পরে থাকে বেশিরভাগ দিন। মায়ের চোখে ছায়া পড়ে ঝালং পাহাড়ের।
মায়ের গায়ের করবীফুলের গন্ধটা স্পষ্ট নাকে আসে আমার। কেউ কোন কথা বলি না আমরা মা-মেয়েতে। দু’জনে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকি দু’জনের দিকে। তাছাড়া কথা বলার দরকার কী, চোখ যখন কথা বলে তখন কি আর শব্দের দরকার হয়, বলো!