পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে জমিদারমশায় প্রথমেই কি দেখলেন? তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়েই চানু ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে, আর তার ঘোড়ার পিছনে পিছনে অপর পাঁচটা ঘোড়াও চলেছে।
জমিদারমশায় অবাক হয়ে রইলেন। মনে মনে বললেন, ‘গোল্লায় যা তুই চানু, আর যাদের চোখে ধুলো দিয়েছিস সে বেচারারাও গোল্লায় যাক।’ আস্তাবলে গিয়ে সহিস বেটাদের জাগতে জমিদারমশায়কে বেগ পেতে হয়েছিল।
সকালবেলা জমিদারমশায় খেতে বসেছেন, চানুকেও ডেকে এনেছেন, খেতে খেতে চানুকে বললেন, ‘কতগুলো বোকা পাঁঠার চোখে ধুলো দিয়েছ্ এতে তেমন বাহাদুরি নেই। আচ্ছা, আজ বেলা একটা থেকে তিনটে পর্যন্ত আমি ঘোড়ায় চড়ে বাড়ির সামনে ঘুরে বেড়াব। নিও দেখি বাপু আমার ঘোড়াটা চুরি করে! তা হলে বুঝব তুমি বাহাদুর এবং আমার জামাই হবার উপযুক্ত।’
চানু মাথা নিচু করে উত্তর করল, ‘যে আজ্ঞে, একবার চেষ্টা করে দেখব এখন।’
একটার পর থেকে জমিদার ঘোড়ায় চড়ে পাইচারি করে একেবারে কাহিল হয়ে পড়লেন। তিনটে বেজে গেল, চানুর টিকিটিও দেখতে পেলেন না্ মনে করলেন এবারে বাড়ি ফিরে যাবেন, এমন সময় তাঁর একটা চাকর পাগলের মত ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসে হাজির-‘কর্তা শিগগির বাড়ি যান, মা ঠাকরুনকে বুঝি বা আর দেখতে পেলেন না। সিঁড়ির উপর থেকে তিনি পড়ে গেছেন। বোধ করি হাত-পা সব ভেঙে গেছে, তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। আমি চললাম ডাক্তারের বাড়ি।’
জমিদারের হোঁচট খেতে খেতে বাড়ি এসে উপস্থিত। এসে দেখলেন, সাড়া শব্দ কিছু নেই, সব চুপচাপ। ব্যস্ত সমস্ত হয়ে বাড়ির ভেতরে গেলেন, সেখানে বসবার ঘরে গিন্নি আর মেয়ে দিব্যি আরাম করে বসে আছেন। ততক্ষণে জমিদারমশায়ের চৈতন্য হল। তিনি বুঝতে পারলেন, এ-সব চানু বেটারই চালাকি-বেটা তাঁকে আচ্ছা ঘোল খাইয়েছে।
খানিক পরেই দেখলেন, চানু তাঁর ঘোড়ায় চড়ে বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছে। সেই চাকর বেটার কিন্তু আর কোন উদ্দেশ পাওয়া গেল না। চাকর তার জন্য একটুও কেয়ার করে না, নাইবা করল তার চাকরি-চানু যে তাকে দশটা মোহর দিয়েছিল, তা দিয়ে তার অনেক দিন চলবে।
পরের দিন চানু এসে জমিদার বাড়ি উপস্থিত। জমিদার বললেন, ‘তুমি বাপু এবারে নেহাত ফাঁকি দিয়েছ, ওতে তোমার উপার আমার বড্ড রাগ হয়েছে। যা হোক আজ রাত্তিরে যদি আমাদের বিছানার থেকে চাদরখানা চুরি করতে পার, তা হলে কালকেই বিয়ের আয়োজন করব।’
চানু বলল, ‘আজ্ঞে আচ্ছা, একবার চেষ্টা করে দেখব। কিন্তু এবারেও যদি ফাঁকি দেন তা হলে কিন্তু আপনার মেয়েকেই চুরি করি নিয়ে যাব।’
রাত্রে জমিদার আর তাঁর গিন্নি শুয়েছেন। দিব্যি জ্যোৎস্না। কাঁচের জানালার ভিতর দিয়ে চাঁদের আলো এসে ঘরে পড়েছে। জমিদারমশাই দেখলেন, হঠাৎ যেন একটা মাথা জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখতে যাচ্ছিল, তাঁদের দেখতে পেয়েই আবার সরে পড়ল।
জমিদার গিন্নিকে বললেন-‘দেখলে ত? এ বেটা নিশ্চয় চানু।’ তারপর বন্দুকটা হাতে করে নিয়ে বললেন, ‘দেখো, আমি বেটাকে এখনি চমকে দিচ্ছি।’
বন্দুক দেখেই জমিদার গিন্নি ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘কর কি, চানুকে গুলি করবে না কি?
জমিদার বললেন, ‘আরে না, তুমি কি পাগল হলে নাকি? বন্দুকে কি আর গুলি পুরেছি-শুধু বারুদ।’
খানিক পরেই আবার জানালায় মাথা উঁকি মারল, দড়াম করে জমিদার বন্দুক ছুঁড়ে দিলেন-সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেলেন, ধপ করে কি নীচে পড়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লেগেছে।
জমিদার গিন্নি চেঁচিঁয়ে উঠলেন, ‘হায় ভগবান, বেচারি বোধ করি মরে গেছে, আর নাহয় জন্মের মত খোঁড়া কানা হয়ে থাকবে।’
জমিদার মশায় কেমন জানি থতমত খেয়ে গেয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলেন- দরজা খোলাই পড়ে রইল।
জমিদার মশায় বোধ করি তখনো বাইরের জানালার কাছে পৌঁছান নি, কিন্তু গিন্নিঠাকরুণ শুনলেন, কর্তা ফিরে এরে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলছেন, ‘শিগগির বিছানার চাদরখানা দাও। বেটা মরেনি বোধ হয়, কিন্তু বেজায় রক্ত পড়ছে-একটু পরিস্কার করে বেঁধে টেঁধে ওকে নিয়ে আসব।’
গিন্নিঠাকরুন একটানে চাদরখানা বিছানা থেকে তুলে দরজায় ছুঁড়ে দিলেন। চাদর নিয়ে জমিদারমশায় আবার ছুটলেন। কিন্তু কি আর্শ্চয, সেই মুহূর্তেই তিনি ফিরে এসে ঘরে উপস্থিত-সে সময়ের মধ্যে বাগানে জানালার কাছে গিয়ে ফিরে আসা একেবারে অসম্ভব।
ঘরে ঢুকেই জমিদার রেগে মেগে বলতে লাগলেন-‘বেটা পাজি চানু, তোকে ফাঁসি দেওয়া দরকার।’
কর্তার কথা শুনে গিন্নি অবাক হয়ে বললেন-বেচারির বেজায় লেগেছে আর তুমি কিনা তাকে গালাগালি দিচ্ছ!
‘ওর বাস্তবিক লাগাটাই উচিত ছিল। বেটার বদমাইশি দেখেছ? খড় দিয়ে একটা মানুষ বানিয়ে সেটাকে কাপড়-চোপড় পরিয়ে এনে জানালায় ধরেছিল।’
‘কী ছাই মাথা মুণ্ডু বলছ, আমি বুঝতেই পারছি না। খড়ের মানুষ হলে তার রক্ত মুছবার জন্য আবার বিছানার চাদর চেয়ে নিয়ে গেলে কেন?
‘বিছানার চাদর-বলছ কি! আমি ত বিছানার চাদর-টাদর চাইতে আসি নি।’
‘চাদর চাইতে আস আর না আস, আমি সে-সব কিছু জানি না। তুমি এস দরজায় দাঁড়িয়ে চাদর চাইলে, আর আমিও তোমাকে দিয়েছি।’
গিন্নির কথা শুনে জমিদার মশায় মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন-‘কি ভীষণ শয়তান রে বাবা চানু্ ওর সঙ্গে আর পেরে উঠব না। কাল সকালেই বিয়ের বন্দোবস্ত করতে হবে দেখছে।’
এরপর চানুর সঙ্গে জমিদার মশায় কন্যার বিয়ে হয়ে গেল বিয়ের পর চানু খুব ভাল হয়ে গেল। তার মত জামাই সচরাচর মেলে না। জমিদার মশায় এবং তাঁর গিন্নি শতমুখে চানুর সুখ্যাতি করেন আর লোকের কাছে বলেন- ‘আমার ঝানু চোর চানু।’
গল্পের প্রথম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।