ঝাউদীঘির আতঙ্ক [৩য় অংশ]

একতলার একটি কক্ষে কারুকাজ করা দেয়াল দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দেখে রঙ্গশালা মনে হল। ঝটপট বেশ ক’টা ছবি তুলে নিলাম। বেশ ধনী ছিল রায়চৌধুরী পরিবার । বিস্তর জমিজমা বাদেও লবনের মতো লাভজনক ব্যবসা ছিল সম্ভবত।
দোতলায় উঠবার কাঠের সিঁড়িটি ভাঙা। দোতলার দরজা-জানালাগুলিও ভাঙা । বেশ বুঝলাম সংস্কার কাজে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরকে বেশ খরচ করতে হবে। দোতলার একটা কক্ষে সুন্দর একটি দেয়াল আয়না দেখে থমকে দাঁড়ালাম। সেই ঘরেরই মাঝখানে সেগুন কাঠের একটি পালঙ্ক, একটি টেবিল ও দুটি চেয়ার রয়েছে। টেবিলের ওপর পুরনো আমলের একটি হারিকেন আর চিমনি। দেওয়ালেএক মহিলার সাদাকালো ছবি টাঙানো।ভারি শ্রীময়ী চেহারা । কার ছবি? হেমেন্দুবিকাশ রায়চৌধুরীর স্ত্রী চিত্রলেখা দেবীর নয় তো? চারিদিকে তাকিয়ে ভাবলাম এই কক্ষটিই কি জমিদার হেমেন্দুবিকাশ রায়চৌধুরীর শয়নকক্ষ?
হ্যাঁ, তাইই।
কক্ষের ওপাশেই বিশাল অলিন্দ।
অলিন্দে পা রাখতেই এক ঝাঁক পায়রা উড়াল দিল। বেশ প্রশস্ত অলিন্দ। এখানেই চৈত্রের এক মাঝরাতে জমিদার হেমেন্দুবিকাশ রায়চৌধুরী পায়চারি করছিলেন। সে সময় কী দেখে তিনি ঢলে পড়ে মারা গিয়েছিলেন। হঠাৎই আমার মনে পড়ল আজ তো চৈত্রমাসের দু তারিখ! আশ্চর্য!
অবশ্য এসব ভাবনা আমার মাথা থেকে উবে গেল। যখন আমি টলটলে ঝাউদীঘির দিকে তাকালাম। তাকিয়েই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আমার সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। বিশাল দীঘি। আয়তকার। টলটলে কালোপানি, তাতে তিরতিরে ঢেউ। দীঘির কোথাও এতটুকু কচুরিপানা চোখে পড়ল না। দীঘির তিন দিকেই নিবিড় ঝাউবন। মনে পড়ল ঝাউবনের মাঝখানেদীঘির জন্য জমি নির্ধারণ করা হয়েছিল।
পিছনে পায়ের শব্দ হল।
ওসমান গাজী । হাতে চায়ের কাপ। খুশি হলাম। এই জিনিসটা আমার আবার ঘন্টায় ঘন্টায় চাই। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে চমকে উঠলাম। চিনে মাটির তৈরি অদ্ভূর সুন্দর কাপ। উনিশ শতকে বনেদী পরিবারে যে রকম কাপ ব্যবহার করা হত, ঠিক সেরকম। পিরিচের এক কোণে হালকা লাল রঙের ছোপে ‘চিত্রলেখা’ শব্দটা লেখা। অবাক হয়ে বললাম, এইকাপ তুমি কই পেলে ওসমান গাজী?
একতলার সিন্দুকে ছিল হজুর। বৃদ্ধ কেয়ারটেকারের কন্ঠস্বর কেমন ফ্যাসফ্যাসে।
সিন্দুকে ছিল মানে? সিন্ধুক তো তালা মারা দেখলাম। তুমি … তুমি চাবি পেলে কই?
কথাটা ওসমান গাজী এড়িয়ে গেল। বরং জিজ্ঞেস করল, রাতে কি খাইবেনহজুর?
বললাম, রাতে আমি তেমন কিছু খাই না। যা হয় একটু কিছু কররো। রুটি করতে পারবে?
পারুম হজুর ।
বেশ। আর শোন রাতে আমি ওই ঘরেই থাকব। ওই ঘরে চেয়ার টেবিল আছে। রাতে আমাকে লেখালেখির কাজ করতে হবে। বলে এতক্ষণে চায়ে চুমুক দিলাম। মুহূর্তেই বিস্মিত এবং মুগ্ধ হয়ে গেলাম। চায়ের স্বাদ দুর্দান্ত । চায়ের পাতা অত্যন্তদামী মনে হল। দুধও খাঁটি। আশ্চর্য! এই ঈশ্বর পরিত্যক্ত জায়গায় ওসমান গাজী এত সব রাজকীয় উপাচার পেল কী ভাবে?
আমি ওই ঘরে থাকব শুনে ওসমান গাজীর মুখের ভাব কেমন যেন বদলে গেল।
বললাম, আমি এখন গোছল করব।
আমি পানি আইনা দিতেছি হজুর ।
না, না। তোমাকে পানি আনতে হবে না। আমি দীঘি তে গোছল করব। যা গরম পড়েছে। বলে চায়ের কাপটা ওসমান গাজীর হাতে দিয়ে নীচে নেমে এলাম।
টিনসেডের বারান্দায় বেঞ্চির ওপর সুটকেশটা পড়েছিল। ওটা খুলে জামাকাপড় সব বের করে নিলাম। দীঘিতে যাওয়ার পথটা লেবুবনের ভিতর দিয়ে । গোধূলি বেলা। এমন সময় পাখপাখালি তারস্বরে চেঁচায়। তাই করছিল তারা। লেবুবনে কেমন আলোআধাঁরির খেলা। জ্বোনাক পোকারা জ্বলছিল আর নিভছিল। ঝিঁঝিরা ডাকছিল কাকপাখিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।
দীঘির ঘাটে এসে দাঁড়াতেই কেমন একটা শিরশিরে অনুভূতি টের পেলাম। অন্তত দেড়শ বছরের পুরনো ঘাট। এখানে সেখানে ফাটল ধরেছে। ফাটলে ঘাস। আর সিঁড়ির ধাপে শ্যাওলা। সাবধানে পানিতে নেমে ডুব দিলাম। শীতল পানির ছোয়ায় পরম শান্তি পেলাম। তারপর অনেক ক্ষণ ঘাটে বসে গা ঘঁষলাম। মনে হলপানির তলার থেকে কারা যেন আমাকে দেখছে। পাত্তা দিলাম না।
ফিরে আসার আগে দীঘির জলে ভুস করেএকটা টুকরি ভেসে উঠল।
সেই শিরশিরে অনুভূতি টের পেলাম।
ওসমান গাজী টিনসেডের বারান্দায় টেবিলের ওপর খাবার সাজিয়েছে । টেবিলের ওপর একটা হারিকেন জ্বলছিল। উষ্ণ কোমল গরম পানিতে আমার হাত ধুইয়ে দিল ওসমান গাজী। তারপর খেতে বসে ভারি অবাক হয়ে গেলাম। রুটি ছাড়াও ভাত করেছে ওসমান গাজী । রুইমাছ ভাজি, মাছেরডিমের বড়া, রুই মাছের বলে মনেই হল, রুই মাছের দো পেঁয়াজা, মুড়ি ঘন্ট, কইমাছ ভাজা, কইমাছগুলি সাইজে অনেক বড়, অত বড় সাইজের কইমাছ আজকাল পাওয়ার কথা না; চিংড়ি মাছের বড়া, আমের আচার, গুড়ের পায়েস এবং দইমিষ্টি। আশ্চর্য! ওসমান গাজী এত সব রাঁধল কখন। কথাটা যে ওসমান গাজী কে জিজ্ঞেস করব সে উপায় নেই । আশেপাশে বুড়োকে কোথাও দেখতে পেলাম না। আশ্চর্য! কোথায় গেল ভুতুরে বুড়ো? একটু আগেই তো আমার হাত ধুইয়ে দিল।
অগত্যা নিরবে খেয়ে উঠলাম। রান্নার স্বাদ একেবারে অন্য রকম। এক সময় উনিশ শতকের বনেদি বাঙালি বাড়ির রান্নার ওপর বিস্তর পড়াশোনা করেছি। রান্নার স্বাদ অনেকটা ও রকম বলেই কেন যেনমনে হল।
কিন্তু তা কিভাবে সম্ভব?
খাওয়ার পর সুটকেশটা নিয়েই দোতলায় উঠে এলাম । প্রত্নতাত্ত্বিকের সুটকেশ বলে কথা। ভারী ভারী সব বই আছে ওতে। এতসব ভুতুরে ব্যাপারের মধ্যেও আমি ভুলে যাইনি যে আমাকে ইনামগড়ের রায়চৌধুরীদের জমিদারবাড়িটির সংরক্ষণ এবং পর্যটনের সম্ভাবনা বিবেচনা করে প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরে একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দিতে হবে।
ডেল নোটবুকটা রাখলাম টেবিলের ওপর । বসলাম জমিদার হেমেন্দুবিকাশ রায়চৌধুরীর শয়নকক্ষের অর্জুন কাঠের চেয়ারে । তারপর প্রাথমিক কিছু কথা টাইপ করতে শুরু করলাম। টেবিলের ওপর হারিকেন জ্বলেছিল। নিজেই জ্বালিয়ে নিয়েছি। তেল ছিল বলে অবাক হয়নি। এই ভুতুরে হানাবাড়িতে পা রাখার পর থেকে কত কিছু যে ঘটছে! তখন দীঘির জলে একটা টুকরি ভেসে উঠল কেন? একটা হাতও দেখলাম বলে মনে হল।
সেই শিরশিরে অনুভূতি টের পেলাম।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!