ঝাউদীঘির আতঙ্ক [১ম অংশ]

স্টেশনমাস্টারের কথায় রীতিমতো চমকে উঠলাম। ইনামগড়ের রায় চৌধুরীদের জমিদার বাড়িটি নাকি অভিশপ্ত। রাতের বেলা তো দূরের কথা স্থানীয় লোকজন দিনের বেলাও নাকি ওদিকে ঘেঁষে না। আমি খানিকটা বিমূঢ় বোধ করলাম। কারণ একটু পরই আমার রায়চৌধুরীদের জমিদারবাড়ি তে যাওয়ার কথা। আমি স্টেশনমাস্টারের মুখের দিকে তাকালাম। মাঝবয়েসি ভদ্রলোক । শিক্ষিত, ভদ্র চেহারা। এমন মানুষের তো কাউকে মিছিমিছি ভয় দেখানোর কথা না। আমি যদিও অভিশপ্ত ভুতুরে হানাবাড়িতে বিশ্বাস করি না। তাই সদ্য পরিচিত ভদ্রলোকের সামনে ভদ্রতা করেই চুপ করে রইলাম। স্টেশনমাস্টার চা খেতে দিয়েছেন। তাতেই চুমুক দিলাম।
স্টেশনমাস্টার রফিক উদ্দীন সরকারের মাথায় মস্ত টাক। গায়ের রং যথেষ্ট ফরসাই বলায় যায়। ছোটখাটো গড়ন। পরনের পাজামা-পাঞ্জাবি দেখলেই বোঝা যায় স্টেশনমাস্টারটি অত্যন্ত সাদাসিদে । আধঘন্টা আগে যখন আমি ইনামগড় স্টেশনে নামলাম তখন তিনিনিজে থেকেই আলাপ করতে এলেন। তার ঘরে ডেকে বসালেন। তারপর প্রাথমিক কুশল বিনিময়ের পর চা খেতে দিলেন।
আমি যখন ইনামগড় স্টেশনে নেমেছি বেলা তখন তিনটা। ঝকঝকে দিনের আলো ছড়িয়ে ছিল। স্টেশনটি অবশ্য নিজর্নই ছিল। আমি সামান্য অস্বস্তির মধ্যেই পড়ে গিয়েছিলাম। আমার জন্য একজন কেয়ারটেকার অপেক্ষা করার কথা। স্টেশনে সেরকম কাউকে অবশ্য দেখতে পেলাম না।
আমি পুরাতত্ত্বের ওপর কিছু বই লিখেছি। বইগুলি দেশিবিদেশি পুরাতাত্ত্বিক মহলে বেশ প্রশংসিত হয়েছে। দিন কয়েক আগে পুরাতত্ত্ব অধিদপ্তর থেকে আমাকে একটি চিঠি পাঠিয়েছে। আমি যেন সংরক্ষণ এবং পর্যটনের সম্ভাবনা বিবেচনা করে ইনামগড়ের রায়চৌধুরীদের জমিদারবাড়িটির ওপর একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দিই। এ কারণেই আমার আজ ইনামগড়ে আসা।
স্টেশনমাস্টার বললেন, সাতচল্লিশে পার্টিশনের পর হেমেন্দুবিকাশ রায়চৌধুরীর বংশধরেরা ইন্ডিয়া চলে যায়। তারপর থেকেই ইনামগড়ের জমিদার বাড়িটি পরিত্যক্ত পড়ে আছে।
আচ্ছা। বলে আমি চায়ে চুমুক দিলাম। তারপর স্টেশনমাস্টার কে জিজ্ঞেস করলাম, তখন ঝাউদীঘি নিয়ে কি যেন বলবেন বললেন?
স্টেশনমাস্টার ম্লান হেসে বললেন, আমি এই ইনামগড়ে এসে যা শুনেছি তাই আপনাকে বলছি। এখানে এসেই শুনেছি রায়চৌধুরীদের ওই জমিদারবাড়িটি অভিশপ্ত। জানি যে একুশ শতকে এই সব কথা বিশ্বাস করাকঠিন। আর আপনি যখন শিক্ষত মানুষ।
আপনি কখনও গিয়েছেন জমিদারবাড়িতে? আমার প্রত্নবিদের মন প্রশ্নটা করে বসল।
সর্বনাশ! বলেন কী আমি যাব ঐ অলুক্ষে হানাবাড়িতে?
তাহলে তা সবই শোনা কথা?
হ্যাঁ। তা বলতে পারেন। সবই শোনা কথা। স্টেশনমাস্টার যেন সামান্য মিইয়ে গেলেন।
বললাম, বলুন তাহলে শুনি, আপনি কি শুনেছেন। হাতে যখন সময় আছে।
স্টেশনমাস্টার বললেন, বলছি, শুনুন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। এ অঞ্চলে খুব খরা হল।মাঠঘাট, খালবিল, নদীনালা সব শুকিয়ে কাঠ। পানির অভাবে ঘরে-ঘরে কান্নার রোল। তৃষ্ণার্ত প্রজারা ভাবল- একটা জলাশয় থাকলে এত দুর্ভোগ ভোগ করতে হত না। কিন্তু কথাটা তারা রগচটা জমিদারের কানে তুলতে সাহসপেল না। জমিদার হেমেন্দুবিকাশ রায়চৌধুরীর স্ত্রী চিত্রলেখা দেবী ছিলেন ভারি দয়ালু মহিলা । নিয়মিত ধ্যান-দান করতেন। প্রজাদের সুখদুঃখের খোঁজখবর করতেন। তো, চিত্রলেখা দেবীর কাছেই প্রজারা একটি দীঘি খননের অনুরোধ করে। স্ত্রীর সানুনয় অনুরোধ নাকি জমিদার হেমেন্দুবিকাশ রায়চৌধুরী উপেক্ষা করতে পারেন নি। জমিদারবাড়ির পিছনে ছিল বিশাল একটি ঝাউবন । সেই ঝাউবনে জমিদার হেমেন্দুবিকাশ রায়চৌধুরী দীঘি খননের জন্য জমি দান করে দিলেন। শত শত মাটি-কাটিয়ে মজুর দিনরাত কোদাল দিয়ে মাটি কাটতে লাগল, তাতে একটা গভীর খাত তৈরি হল ঠিকই- কিন্তু পানি উঠল না। জমিদার হেমেন্দুবিকাশ রায়চৌধুরী মাটি-কাটিয়ে মজুরদের মাটি কেটে আরও গভীরে যেতে নির্দেশ দিলেন। তারপরও পানি উঠল না দেখে অসন্তুষ্ট জমিদার এক তান্ত্রিক যোগী তলব করে জলশূন্য দীঘির পাড়ে ‘জলধি পূজার’ আয়োজন করলেন । তারপরও পানি উঠল না। হেমেন্দুবিকাশ রায়চৌধুরী মাটি-কাটিয়ে মজুরদের মাটি কেটে আরও গভীরে যেতে নির্দেশ দিলেন। শত শত শ্রমিক খাদের তলায় কোদাল দিয়ে মাটি কেটে চলেছে। টুকরি করে মাটি ওপরে এনে ফেলছে। হঠাৎ এক বিকেলে পানি উঠে গভীর খাতটা ভরে গেল। মুহূর্তেই সব মজুর তলিয়ে গেল।
আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম। হতভাগ্য শ্রমিকদের ভাগ্য চিরকালই মন্দ। এদের মধ্যে বিশ্বজুড়ে খনিশ্রমিকদের অবস্থাই সবচে করুন সম্ভবত।
স্টেশনমাস্টারের টেবিলের ওপর একটা মেরুন রঙের পুরাতন ফ্লাক্স। তিনি ফ্লাক্স খুলে কাপে চা ঢাললেন। তারপর সিগারেট ধরালেন। বাতাসে তামাকের গন্ধ ছড়াল । স্টেশনমাস্টারের চেয়ারের ঠিক পিছনেই একটি জানালা। জানালার কাঁটাতারের বেড়ায় রঙনের গুল্ম। বেড়ার ওপাশেশালগাছের ঘন জঙ্গল চোখে পড়ে। অনেক কাক ডাকছিল। রোদের রং ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। চৈত্রবেলার নির্জন অপরাহ্ন। স্টেশনটা কেমন সুমসাম করছে।
চায়ের কাপে ছোট্ট চুমুক দিয়ে বললাম, তারপর কি হল?
একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে স্টেশনমাস্টার বললেন, ইনামগড়ের মানুষ খরায় অসহ্য বোধ করছিল। দীঘি পানি তে ভরে উঠলে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেল। টলটলে পানির দীঘির চারধারে ঝাউগাছ । তাতে দীঘির নাম লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে গেল- ঝাউদীঘি।
আর মৃত মাটি-কাটিয়ে মজুররা? ওদের লাশ পাওয়া যায়নি?
না।
না। আশ্চর্য!
স্টেশনমাস্টার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, লাশ হয়তো সেভাবে খোঁজাও হয়নি । সেকালে দরিদ্রশ্রেণির মানুষের মৃত্যু নিয়ে কে অত মাথা ঘামাত বলুন?
হুমম। আমি মাথা নাড়লাম। মনে মনে বললাম … দরিদ্রশ্রেণির অবস্থা এই একুশ শতকেও তো বিশেষ বদলায়নি।
প্রবীণ স্টেশনমাস্টারের মুখ কেমন গম্ভীর হয়ে উঠেছে। বোঝাই যাচ্ছে ভদ্রলোক এখনি পিলে চমকানো কোনও তথ্য দেবেন। এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে স্টেশনমাস্টার বললেন, তারপর কী হল শুনুন। জমিদার হেমেন্দুবিকাশ রায়চৌধুরীর অনিদ্রা রোগ ছিল। মাঝরাতে শয়নকক্ষের বাইরের অলিন্দে পায়চারি করছিলেন। ভীষন গরম। চৈত্রমাসের শুরু। হঠাৎ তিনি ঢলে পড়ে গেলেন। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
মারা গেলেন? কি হয়েছিল? আমি ভুঁরু কুঁচকে জিগ্যেস করলাম

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!