ঝড়ো বাতাস –নরওয়ের রূপকথা

ছায়াঘেরা, মায়াঘেরা পাহাড়ের কোলে ছোট্ট সেই গ্রামটি একেবারে ছবির মতো । সেই গ্রামে থাকে এক দুঃখী বুড়ি-মা আর তার আদরের ধন ছোট্ট একটি ছেলে। মা-ছেলেতে কাজ করে। টেনেটুনে সংসার চলে। এক. বেলা ভালো খায় তো আরেক বেলা উপোস থাকে ।

একদিন মা বলল, বাছা, ঘরে একটুখানি আটা আছে। তাই নিয়ে এস। রুটি তৈরি করব ?

ছেলেটি মায়ের কথা শুনে ভারি খুশি হয়ে উঠল । গরম গরম রুটি খেতে ভারি মজা । সে দৌড়ে গেল ভেতরের ঘরে । একটি বড়বাটিতে করে আটা নিয়ে যেই না ছুটে আসতে লাগল মায়ের কাছে অমনি উঠোনের মধ্যে শো করে তেড়ে এল দুষ্টু বাতাস । হালকা ঝড়ের মতো সেই বাতাস এক ফুয়ে সব আটা উড়িয়ে নিয়ে গেল। তাই দেখে ছেলেটি হতভম্ব ।

 

আবার সে গেল ভেতরের ঘরে ।

নিয়ে এল আরেক বাটি আটা। ঝড়ো বাতাস আবার শো করে উড়ে এসে এক ফুয়ে সবটুকু আটা উড়িয়ে নিয়ে গেল ।

ঘরে আর কোনো আটা ছিল না।

ছেলেটির ভারি মন খারাপ হয়ে গেল। রুটি বানানো আর হল না। রাগে-কষ্টে সে থরথর করে কাঁপতে লাগল। মাকে বলল, মা, দেখলে তো কী কাণ্ডটা ঘটল । ঝড়ো বাতাস আমাদের সবটুকু আটাই উড়িয়ে নিয়ে গেল । ঝড়ো বাতাসকে আমি ছেড়ে দেব না। ওকে আমি দেখে নেব।”

রাগে গটমট করতে করতে ছেলেটি বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। ঝড়ো বাতাসকে উচিত শিক্ষা দিতেই হবে । একমনে সে হাঁটতে লাগল। দিন পেরিয়ে রাত এল । রাত পেরিয়ে সকাল এল। হাট পেরুল, মাঠ পেরুল। পাহাড়-নদী-বন পেরিয়ে শেষমেষ ছেলেটির সঙ্গে দেখা হল ঝড়ো বাতাসের ।

ঝড়ো বাতাস সারাক্ষণই মাতোয়ারা। একমুহূর্তও সুস্থির থাকতে পারে না বেচারা। ফোস ফোস করে কথা বলে। আর একটু পরপর প্রবল বেগে গর্জন করে।

ছেলেটিকে দেখেই রাগে জ্বলে উঠল ঝড়ো বাতাস। শো শো শব্দ করতে করতে বলল, “কোথেকে এসেছ তুমি? কী চাই তোমার?

ছেলেটি বলল, কিছুই চাই না আমি । আমি শুধু আমার আটা ফেরত চাই।’

‘আটা মানে, কিসের আটা? যে আটা তুমি হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়েছ সেই আটা।’ ছেলেটির কথা শুনে ঝড়ো বাতাস হো হো করে হেসে উঠল। তোমার আটা কোথায় উড়ে গেছে, সে কি আর আমিই ঠিকমতো জানি। সেই আটা ফেরত পাবে কী করে?”

তাহলে আমি রুটি খাব কোথেকে? আমার যে খুব খিদে পায়। আটা না থাকলে রুটি বানাব কেমন করে?

‘তোমার কি রুটি খাওয়ার খুব ইচ্ছে?

‘হ্যাঁ।’

‘তা হলে এই নাও একটা থালা । তোমাকে দিলাম।”

‘থালা নিয়ে আমি কী করব?’

“সেটাই তো মজা। থালাটা নিয়ে সামনে রাখবে। তারপর মনে মনে বলবে :

 

থালা থালা জাদুর থালা

দিলাম তোমায় ছুটি

খেতে আমার ইচ্ছে করে

গরম গরম রুটি ।

 

অমনি দেখবে তোমার সামনে থালাভর্তি রুটি এসে হাজির হবে। তখন তুমি মনের সুখে রুটি খাবে। যতবার ইচ্ছা ততবার তুমি রুটি খেতে পারবে।’

এ রকম একটা জাদুর থালা পেয়ে ছেলেটা মহাখুশি । আনন্দে বাকুমবুকুম। ছুটল সে বাড়ির দিকে । মাকে গিয়ে এক্ষুনি এই জাদুর থালার তেলেসমাতি দেখাতে হবে । ছুটতে ছুটতে পথে ঘন রাত্রি নেমে এল । চারপাশে অন্ধকার ।

ঠিকমতো কিছুই দেখা যায় না। সামনেই সে দেখতে পেল ভাঙাচোরা একটা বাড়ি। দেয়াল জুড়ে বড় বড় বট-বৃক্ষের ডালপালা। বিজন বনের এই বাড়িতে কোনো মানুষ থাকে কি? রাতটুকু কোনোমতে কাটিয়ে দেবে ভেবে ছেলেটি সেই পোড়োবাড়িতে প্রবেশ করল । ভেতরে ঢুকতেই দেখা হল এক লোকের সঙ্গে। ভয়ানক চেহারা তার। মাথায় জটাবাঁধা চুল। লাল দুটো চোখ । আর একেবারে পেটানো শরীর। লোকটা আসলে খুব ভালো লোক নয়। সে ছিল ডাকাত ।

ছেলেটি তাকে বলল, ভাই বিপদে পড়ে এখানে এসেছি। রাতটুকু কাটাবার জন্য আমি একটু আশ্রয় চাচ্ছি।

‘এখানে থাকতে পার তুমি । তবে ভাই খেতে-টেতে দিতে পারব না।’

‘সে নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। নিজের খাবার আমি নিজেই জোগাড় করে নিতে পারি ?

ছেলেটি তখন থালাটা বের করল তার থলে থেকে । মনে মনে বলতে লাগল :

 

থালা থালা জাদুর থালা

দিলাম তোমায় ছুটি

খেতে আমার ইচ্ছে করে

গরম গরম রুটি ।

 

অমনি থালাভর্তি খাবার এসে হাজির । শুধু রুটি নয়, রুটির সঙ্গে খাওয়ার মতো হালুয়া, ফলমূল, মিষ্টি কত কী খেয়ে আর শেষ হয় না।

দুজনেই পেট ভরে খেল । তারপর মনের সুখে ঘুমিয়ে পড়ল। ডাকাত কিন্তু চোখ বন্ধ করে রইল। সে ঘুমাল না। থালার জাদুকরি ক্ষমতা দেখে তার চোখ কপালে উঠেছে। কী করে থালাটা চুরি করা যায়– এই চিন্তা তার মাথায় ঘুরতে লাগল। ভোরবেলা সে আসল থালাটা চুরি করে একই রকম আরেকটা থালা ছেলেটির থলের মধ্যে রেখে দিল ।

পরদিন মনের আনন্দে ছেলেটি বাড়িতে পৌছল। তার মনে আনন্দ আর ধরে না। মাকে বলল, মা, মা, এই দেখ জাদুর থালা নিয়ে এসেছি আমি । ঝড়ো বাতাস আমাকে এই থালাটা দিয়েছে। এই থালার কাছে যা খেতে চাইবে তাই-ই পাবে।’

মা বললেন, না দেখলে বিশ্বাস করি কী করে বাবা?” ছেলেটি থালাটা সামনে নিয়ে মনে মনে মন্ত্র পড়তে লাগল।

কিন্তু নকল থালায় খানা আসবে কী করে? যতই মন্ত্র পড়ে কাজ হয় না কিছুই। ছেলেটি রাগে কাঁপতে লাগল ।

ঝড়ো বাতাস আমাকে ঠকিয়েছে। ঝড়ো বাতাস আমাকে ঠকিয়েছে। এবারে ঝড়ো বাতাসকে দেখে নেব।”

আবার দিনরাত হেঁটে, মাঠ-ঘাট পেরিয়ে, পাহাড়-নদী পেরিয়ে ছেলেটি গিয়ে পৌছল ঝড়ো বাতাসের কাছে ।

আবার কী চাও তুমি?

‘একখানা অকেজো থালা দিয়ে ঠকিয়েছ তুমি । এই থালায় একদানা খাবারও পাওয়া যায় না । আমার আটাই আমাকে ফেরত দাও।”

ঝড়ো বাতাস বলল, আটা তো পড়ে গেছে। সেই আটা তো আর ফেরত পাওয়া যাবে না। তার বদলে একটা ছাগল দিলাম তোমাকে ছাগলের সামনে

শুধু মনে মনে বলবে :

 

ছাগলছানা ছাগলছানা

তাক ধিনা ধিন তানা তানা

বুদ্ধি তোমার টন টন

টাকা ঝরুক ঝন ঝন ।

 

অমনি ছাগলের মুখ দিয়ে ঝনঝন করে টাকা ঝরবে। সেই টাকা দিয়ে যা খুশি তাই কিনে খেয়ো তুমি ।

ছেলেটি মহাখুশি হয়ে ছাগলটাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিল। এবারও রাত হয়ে এলে সে ডাকাতের বাড়ি গেল রাতটুকু কাটাবার জন্যে ।

ডাকাত এবার বলল,— রাত কাটাতে হলে আমাকে টাকা দিতে হবে। টাকা দাও, রাত কাটাও ’

ছেলেটি জবাবে বলল, টাকা কোনো ব্যাপার নয়।’

ছাগলটাকে সামনে এনে সে মনে মনে বলতে লাগল :

 

তাক ধিনা ধিন তানা তানা

ছাগলছানা ছাগলছানা

বুদ্ধি তোমার টন টন

টাকা ঝরুক ঝনঝন ।

 

অমনি ঝনঝন করে টাকা ঝরতে লাগল। তাই না দেখে ডাকাত খুবই খুশি ।

ছেলেটি ক্লান্ত শরীরে ধুপ করে শুয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে দু-চোখ জুড়ে নেমে এল ঘুম । ডাকাত কিন্তু ঘুমাল না। সে বুদ্ধি বের করতে লাগল— কী করে ছাগলটাকে চুরি করা যায়।

সে আগের মতোই গভীর রাতে অন্য একটি ছাগল রেখে দিল ছেলেটির পাশে । আসল ছাগলটাকে সে চুরি করে নিল ।

পরদিন বাড়ি পৌঁছেই ছেলেটি মাকে ডেকে আনল। আনন্দে-উচ্ছাসে তার আকুপাকু অবস্থা।

মা, মা । এই দেখ ঝড়ো বাতাস দারুণ একটা ছাগল উপহার দিয়েছে আমাকে । এর কাছে টাকা চাইলেই টাকা পাওয়া যায়। তাই দিয়ে যত খুশি খাবার কিনে খাব |’

মা মৃদুস্বরে বললেন, কোনো কিছুই সহজে বিশ্বাস করতে পারি না বাবা। না দেখলে বিশ্বাস করি কীভাবে?’

ছেলেটি বলল “এই দেখই না মজা ।” যতই মন্ত্র পড়ে কাজ হয় না। নকল ছাগল টাকা দেবে কী করে? তার মুখ দিয়ে একটা টাকাও পড়ল না। ছেলেটি রাগে গরগর করতে লাগল।

ঝড়ো বাতাস এবারও ঠকিয়েছে আমাকে । আমি আবার যাব তার কাছে। গিয়ে বলব, কী এমন দোষ করেছি আমি যে, আমায় তুমি ঠকাচ্ছ?

পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে ছেলেটি গেল ঝড়ো বাতাসের কাছে। বাতাস তো তাকে দেখেই ভয়ংকর রেগে উঠল।

‘আবার এসেছ তুমি? কী চাই তোমার?

কিছু চাই না আমি । বারবার তুমি আমায় ঠকাচ্ছ। তুমি আমায় পচা ছাগল দিয়েছ। একটা ফুটো পয়সাও পাওয়া যায় না তার কাছে।’

ঝড়ো বাতাস তখন কাতরভাবে বলল, কিন্তু তোমাকে দেয়ার মতো কিছুই যে নেই আমার । একটা শুধু লাঠি আছে। সেটাই তুমি নিয়ে যাও । আর মন্ত্রটা হচ্ছে :

 

তাক কুড় কুড় তাক

তাক কুড় কুড় তাক

মুণ্ডুটা দুই ফাঁক ।

 

ব্যস্– অমনি চোর-ডাকাতের মাথায় বেদম লাঠির আঘাত পড়তে থাকবে। আর যখন বলা হবে :

 

আয় রে লাঠি ফিরে আয়

দুষ্ট লোকে শাস্তি পায়।

 

তখন লাঠির আঘাত বন্ধ হবে । লাঠি আবার ফিরে আসবে তোমার হাতে ।

ছেলেটি মনের আনন্দে লাঠি নিয়ে বাড়ির পথে চলল। পথ চলতে চলতে আবার সন্ধ্যা নেমে এল । ছেলেটি এবারও ডাকাতের বাড়িতে আশ্রয় নিল । হাতে একটা সুন্দর লাঠি দেখে ডাকাতের খুব লোভ হল। ভাবল, বোকাটার কাছ থেকে থালা আর ছাগলছানা হাতিয়ে নেয়া গেছে। এখন লাঠিটা নিতে পারলেই হয়। ডাকাত মোলায়েম সুরে বলল,— ‘এস, এস বন্ধু। তুমি তো আমার চেনা অতিথি । যখন ইচ্ছে তুমি আসবে। খাবে, ঘুমাবে।’

ভরপেট খাওয়াদাওয়া করল দু-জনে। তারপর ঘুমাতে গেল ঢেঁকুর তুলতে তুলতে। এবার ছেলেটি কিন্তু ঘুমাল না। ঘুমের ভান করে পড়ে রইল চুপচাপ ।

ডাকাত গভীর রাতে পা টিপে টিপে এগিয়ে এল ছেলেটির পাশে । তারপর চোরের মতো সে হাত বাড়াল লাঠিটার দিকে । আমনি ছেলেটি বলল :

 

তাক কুড় কুড় তাক

তাক কুড় কুড় তাক

লাঠির ঘায়ে চোর ডাকাতের

মুণ্ডুটা দুই ফাঁক ।

 

বনবন করে লাঠি ঘুরতে লাগল। লাঠির আঘাত পড়তে লাগল ডাকাতের মাথায় । মাথা ফেটে দুই ফাঁক। ডাকাত বেচারা তখন মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে লাগল ।

‘বাবাগো, মাগো, বাঁচাও, বাঁচাও । তোমার পায়ে পড়ি। আমি মরে গেলাম গো । বাঁচাও আমাকে ‘

ছেলেটি তখন বলল, তুমি আমার লাঠি চুরি করেছ। নিশ্চয়ই তুমি আমার থালা আর ছাগলছানাও চুরি করেছ, শিগগির ওগুলো ফেরত দাও।”

“এখুনি, এখুনি আমি সব ফেরত দিচ্ছি। বাবাগো, বাঁচাও আমায় । মেরে ফেল না আমাকে ৷”

ছেলেটির তখন লাঠির আঘাত থামানোর মন্ত্র পড়ল :

 

আয় রে লাঠি ফিরে আয়

দুষ্ট লোকে শাস্তি পায়।

 

অমনি লাঠি ফিরে এল ছেলেটির হাতে। ডাকাত তখন প্রাণের ভয়ে থালা আর ছাগলটাকে এনে হাজির করল ছেলেটির সামনে ।

ছেলেটি তখন মহাখুশি। খুশিতে ডগমগ হয়ে রওনা দিল বাড়ির পথে । হাতে লাঠি, সাথে ছাগল আর থালা ।

সবকিছু পেয়ে মায়ের মুখে হাসি ফুটল । সবচেয়ে বড় কথা, মা আর ছেলের জীবন ভরে উঠল অনেক অনেক সুখ আর শান্তিতে |

 

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!