জ্বীনদের গায়েবী সংবাদের সমাপ্তি
শেষ নবীর আগমন ও আবির্ভাবের কথা আহলে কেতাবগণ স্ব স্ব ধর্মগ্রন্থের মারফত পূর্ব হতে জানত। আরবের অপরাপর লোকগণের মধ্যেও কিছু লোক ভবিষ্যৎবাণী করে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর আগমনের পুর্বাভাস দিয়েছিল। জ্বীনের মারফত তাঁর এ ধরণের কিছু ভবিষ্যৎবাণী সম্পর্কে অবগত হত। জ্বীন জাতির নিয়ম ছিল তার একজনের কাঁধে আর একজন দাড়ায়ে আকাশ পর্যন্ত পৌঁছে যেত। আকাশের মধ্যে ফেরেশতাগণ মানুষের ভবিষ্যৎ ফয়সালা সম্বদ্ধে যখন কোন কথাটি তার নিম্নে জ্বীনকে অবগত করাত। এভাবে সর্ব নিম্নে দণ্ডায়মান জ্বীন সে কথাটি তার নিকট বসে থাকা গণকের কানে পৌছাত। যারা জ্বীন হাসিল করে থাকে তাদের নিকটই এ ধরণের জ্বীনদের আগমন হত। সে গনক ব্যক্তি একটি কথা যোগ করে মানুষকে শুনাত। তারা জ্বীনদেরকে বিভিন্ন নামে ডাকত। যে সকল জ্বীন ময়দানে জঙ্গলে থেকে বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করতঃ পথচারীকে বিভ্রান্ত ও দিশাহারা করত, তাদেরকে গাওল বলত। যে সকল জ্বীন লোকালয়ে বাস করত তাদেরকে আমের এবং যারা শিশুদেরকে যন্ত্রণা দিত তাদেরকে রূহ বলত। যারা দুষ্ট প্রকৃতির ছিল তাদের নাম শয়তান এবং সর্বাধিক দুষ্ট ও মানবের ক্ষতি সাধনকারী জ্বীনগণকে ভূত বলত।
হযরত রাসূল (সাঃ) নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্ব পর্যন্ত তারা আকাশে যেয়ে ফেরেশতাগণের আলোচনা হতে কিছু সংবাদ শ্রবণ করে অর্ধশ্রুত বা অস্পষ্টশ্রুত খবর ভবিষ্যৎ ভক্তদের নিকট বলতে পারতো। মহানবী (সাঃ)-এর উপর যখন অহি নাজিল হওয়ার সময় নিকটবর্তী হল তখন আসমানে যাওয়ার পথ তাদের জন্য রুদ্ধ হয়ে গেল। তারা আসমানের কথা চুরি করার উদ্দেশ্যে উপরে আরোহণ করতে চাইলে ফেরেশতাগণ তাদেরকে উজ্জল নক্ষত্রের তেজপুঞ্জ নিক্ষেপ করতে থাকেন। যার ফলে কেউ বোধ শক্তিহীন বা বিকলাঙ্গ হয়ে যায়। সর্বপ্রথম যেদিন তাদের এ অবস্থা হল সে দিন তার বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে সারা পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে। যাতে তার কারণ উদ্ঘাটন করা যায়। এভাবে নছীবীন এলাকার একদল জ্বীন মক্কায় গমন করলে বতনে নখলা নামক স্থানে পৌঁছে দেখতে পেল মহানবী (সাঃ) ফজরের নামাজে আল্লাহর কালাম তেলোওয়াত করতেন।
হযরত রাসূলে পাক (সাঃ) সাহাবায়ে কেরামের এক জামায়াত নিয়ে তবলীগের উদ্দেশ্যে ওকাজ বাজারে যাওয়ার সময় বতনে নখলাতে এক মাত্র অবস্থান করেছিলেন। তাই সেখানে ফজরের নামাজে তিনি ইমাম হয়ে যখন আল্লাহর কালাম তেলোওয়াত করছিলেন তখন উক্ত জ্বীনগণ পবিত্র কোরআনের আয়াত শ্রবণে বিমোহিত হয়ে বলল যে, আসমানের পথ রোধ হওয়ার একমাত্র কারণ তাই। তারা বুঝতে পারল সেদিন হতে আসমানী সংবাদের পরিসমাপ্তি ঘটল। তারা হযরত (সাঃ)-এর উপর ঈমান আনল এবং ইসলামের শীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করল। তাদের এ ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করে সূরায়ে জ্বীন অবতীর্ণ হল। তাদের সংখ্যা ছিল নয়। ঐ রাত্রটি ইসলামের ইতিহাসে লাইলাতুল জ্বীন নামে পরিচিত। তাদের আমন্ত্রণে পরবর্তী পর্যায়ে আরও তিনশত জ্বীন রাসূল (সাঃ)-এর খেদমতে হাজির হয়ে ইসলাম গ্রহণ করল। এ সকল জ্বিনের বাসস্থান ছিল সিরিয়ার নছীবীন নামক স্থানে।
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) জীবনের প্রথম থেকেই শিরক হতে পবিত্র ছিলেন।
হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর জন্মকালে কা’বাগৃহে তিনশত মূর্তি ছিল। কোরাইশগণ এসব মূর্তির পূজা করত। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর বংশের লোকই সে ঘরের মোতাওয়াল্লী ছিল। কিন্তু তাঁকে কোন সময় এ সব মূর্তির সামনে মস্তক নত বা জাহেলিয়াতের কোন অনুষ্ঠান যোগদান করাতে পারেনি। তিনি কখনও ঐ জড়পিণ্ডগুলির নিকট যান নি।
দেবদেবীর নামে উৎসর্গকৃত খাদ্যদ্রব্য হতেও তিনি সর্বদা দূরে ছিলেন। একবার ঐ খাদ্য তাঁর সামনে পেশ করা হলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।
এমনিভাবে জেহেলিয়াতের অন্যান্য কুসংস্কার হতেও তিনি সর্বদা দূরে থাকতেন। আরবের প্রথা ছিল তারা দিবসে কাজকর্ম করে রাত্রে একত্রিত হয়ে গল্প গুজব করত। নবীজী একবার এ ধরণের গল্প শুনার জন্য কোন এক স্থানে রওয়ানা দিলেন পথিমধ্যেই গভীর নিদ্রায় অভিভূত হয়ে পড়েন। ফলে তাঁর আর সেখানে যাওয়া হল না।
এমনিভাবে একবার কোন বিবাহের দাওয়াতে রওয়ানা দেয়ার পর যখন তিনি কা’বাগৃহের বারান্দায় পৌঁছালেন তখন তাঁর চোখে তন্দ্রাভাব এসে যায় এবং সকাল পর্যন্ত ঘুমাইয়ে থাকেন। যেহেতু তিনি ছিলেন আল্লাহ পাকের খাছ রহমত তাই নবুয়তের পর্ব হতেই আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সর্বপ্রকার গুনাহের কাজ হতে রক্ষা করেন। তাঁর প্রবৃত্তি ও প্রকৃতিতে এমনভাবে গঠন করেন যেন আসমানী অহী তথা শরিয়াতের গুরুভাব বহন করতে সক্ষম হয়। এ জন্য পাপের কলংক তাঁর জীবনের ত্রিসীমায় আসতে পারে নি।
নিজ হস্তে নির্মিত পাথরের মূর্তির সম্মুখে মস্তক অবনত করা যে মানবতা ও বিবেক বুদ্ধির অবমাননা এ সত্য রাসূল (সাঃ)-এর নবুয়তের পূর্বের অনেক সত্যান্বেষণকারীর অন্তরে জাগ্রত ছিল। তারা সত্য ধর্মের অনুসন্ধান করেও কোন সন্ধানে পেল না। কেউ কেউ খৃষ্টান ধর্ম অবলম্বন করল। যেমন ওরাকা ও ওসমান। যায়েদ নামক জনৈক সত্যের অনুসন্ধানকারী মরণকালে বলেছিল, হে আল্লাহ! কিভাবে উপাসনা করলে তোমাকে পাওয়া যায় যদি জানতে পারতাম তা হলে আমি অবশ্যই সে পথ অবলম্বন করতাম।