ছবদের আলী কি ভয় দেখায়? নাকি নৈতিক মনোবলশূন্য করতে চায়? বইয়ের পৃষ্ঠায় দৃষ্টি বোলানোর ফাঁকে, কিংবা পথে বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে যখন তার সাথে কথা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়-ছাত্র মঞ্জুর শাহী আনমনে ভাবে। ছবদের আলী ফুটপাতের জামাকাপড় ফেরিওয়ালা। বাড়ির মালিক ও তার একই জেলায় গাঁয়ের বাড়ি কিংবা পরস্পর পাড়া প্রতিবেশী হবার সুবাদে বাড়ির মালিকের বিশেষ অনুগ্রহে সে বাড়ির চিলেকোঠায় থাকে। পড়াশোনা তার না জানারই কথা। নৈতিক মনোবলশূন্য করার মতো জটিল বিষয় তার জ্ঞান গরিমায় ধরার কথা যেমন নয়, ও বিষয়ে পারদর্শী হবার সম্ভাবনাও ক্ষীণ, যদিও তার সম্পর্কে বিশেষ নানা কথাই এ বাড়িতে ভাড়া ওঠার অল্প কিছুদিনের মধ্যে মঞ্জুর শাহীর কানে উঠেছে । হতে পারে সেসব সত্যি। আবার এও হতে পারে, মানুষ আপন মনের কল্পনায় মনগড়া যা ভাবে, যৌক্তিক সংজ্ঞায় যার অভিহিতি কল্প-মিথ্যা, সেসব ঠিক তা-ই। তাছাড়া, মঞ্জুর শাহী এখানকার পরিসরে একান্ত সাদামাটা স্বচ্ছ চরিত্রের তরুণ । দু’চারটা ন্যায় নীতি বা প্রতিবাদের কথা সময় সময় তার মুখ দিয়েই বার হয়। তাহলে একজন ফেরিওয়ালা শ্রেণির লোক তাকে ভয় দেখাবে বা নৈতিক মনোবল শূন্যকরণে প্রবৃত্ত হবে কী হেতু? মঞ্জুর শাহী অনিচ্ছায় অবচেতনে ভাবে। এক গোলকধাঁধা যেন।
ছবদের আলী বরিশাল জেলার লোক। বয়সে মঞ্জুর শাহীর চেয়ে বছর দশেকের বড় হতে পারে। মধ্য তিরিশ হলেও চাঞ্চল্যে, অস্থিরতায় যেন বিশ পঁচিশকেও হার মানায়। একটা চরম স্ফূর্তিভাব সর্বক্ষণ তাকে যেন লাফাঙ্গা আর অতিকথক করে রাখে। বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায় সে কথা বলে। কথা বলার প্রারম্ভে প্রায়ই খ্রিক করে একটি বা দুটি হঠকারিতামুলক শব্দ করে নেয়। তার মনিব তথা বাড়ির মালিক একজন শিল্পপতি। ছবদের আলীর ভাষ্যে বাড়ির মালিকের ছেলে সিরাজুল বেশ কটা লঞ্চ এর মালিক, লঞ্চ ঘাটের বহু মারমারখা মাস্তান সন্ত্রাসীর সাথে তার ওঠাবসা, তাদের মধ্যে দাগী আসামি কিংবা খুনীটুনিও আছে। এদের মাধ্যমে সে চাইলে যে কোন সময় শহরে কিংবা বাইরে মারাত্মক ঘটনাও ঘটাতে পারে, খুনখারাবি পর্যন্ত। তার ভাষায়, ভাই, বো-জেন , মোগো মিঞাভাই তো খালি লঞ্চ দেহাশুনা লইয়াই দিন গুজরাণ থাহত না। লঞ্চ ঘাডত কতোক চান্দাবাজ ধান্দাল আছে নাহ, তাগোর ফোটকি দিতে কতক গুন্ডা সন্ত্রাসীরে পাগোটে পুরিয়া রাহে, আপনে বোজো? কোন সমেস্যা হইলে আপনে বাইয়েক বোলাইও। কোন সমেস্যা থাকিবে না। বাইয়েক দেখতি ভদ্দরনোক মনো হইলে কী হইবে, আদতে সে খাঁটি ঝাণ্ডামারা লোক আছে, আপনে কতা বোজো? কথা শেষে ছবদের আলী চোখ বড় করে তাকায়।
রহস্যময়তা আর দুর্বোধ্যতার সম্মিলিত ধোঁয়াশা মঞ্জুর শাহীকে আমুল আচ্ছন্ন করে রাখে। সে ছবদের আলীর এসব কথার ন্যূনতম আবশ্যকতা খুঁজে পায় না। তার নিজের কোন দুর্বল দিক নেই, কাউকে শায়েস্তা করার জন্য মাস্তান সন্ত্রাসী ডাকতে হবে, তেমন পটভূমিকাও জীবনে নেই। তাহলে রোজ রোজ এসব কথার ফেরি কেন? তাছাড়া, বাইরে কেমন কী তা না জানলেও কথিত সিরাজুলকে সে অত্যন্ত বিনয়ী তথা নমঃনমঃ করা মানুষ হিসেবে দেখে । সে নিয়মিত তার খোঁজখবর নেয়। বাড়িটিতে বসবাসে কোনও সমস্যা আছে কি নেই তা জানতে চায়। প্রায়ই রান্না করা খাবারদাবার পর্যন্ত পাঠায়। নেহায়েত সৌজন্যে মঞ্জুর শাহী ও রুমমেটরা তা গ্রহণ করে।
পুরনো ঢাকায় পুরনো ধাঁচের লিফটবিহীন ছ’তলা ভবনের দোতলার পার্শ্বকক্ষটির পরিসর বেশ বড়। ব্যাচেলর চার বাসিন্দার তিনজন চাকুরে- সর্বজ্যেষ্ঠ জন সুপারশপের ক্যাশিয়ার, একজন ফাইভস্টার হোটেলের ওয়েটার, অপর জন বিমা প্রতিনিধি। মঞ্জুর শাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র। মেসে নানা শ্রণির লোক থাকে। চাকরিজীবি আর ছাত্র- এ দুই-ই বোধকরি বহু শ্রেণির মধ্যে অভিজাত পরিগণিত। মেসটিকে তাই অভিজাত মেস বলা যুক্তিসঙ্গত। মেসে তার জীবন সুখকরও বলা যাবে না, আবার অসুখকরও বলা যাবে না। বিশ্ববিদ্যালয়, টিউশনি, খাওয়া পরা, হাঁটাহাটি, ঘুম – কোনমতে, কোনও ঘোরে দিন কেটে যায়।
সিংহ ভাগ সময় তার নির্জনতায় কাটে। বাকি তিনজন অফিসের উদ্দেশে সকালে বেরিয়ে যায়, ফেরে রাতে। কেউবা দুপুরে ভাতের তাগিদে এলেও পেট পুরে শীঘ্র বেরিয়ে যায়। মাঝেমধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য যে জায়গাটিতে ভর না করে তা নয়। ওপর থেকে মালিক-তনয়া তিন অপ্সরা সহোদরা নেমে আসে। বড়টি বিবাহিতা চঞ্চলা – দুই শিশুকন্যা সাথে থাকে। মেঝোটি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া-অতি গোমড়া, মৌনমুখ, গভীর চিন্তা মগ্ন প্রতীয়মাণ, নির্বাক; ছোটটি স্কুল শিক্ষার্থী, অতি চঞ্চলা, অতি কথক । অবুঝ শিশু দুটি প্রায়ই হাতের সম্মিলিত জোর ধাক্কায় লকবল ভেজানো দরজাটি খুলে দৌড়ে ঘরে ঢোকে, লাফিয়ে খাটে ওঠে, হি হি করে, লুটোপুটি খায়। অতি চঞ্চলা কনিষ্ঠ অপ্সরা তৎক্ষণাৎ তাদের পিছু ধাওয়া করে ঘরে ঢুকে তাদেরকে জাপটে ধরে আহলাদে কণ্ঠে চেঁয়ায়, ভা- ই- য়া, না বলে ঢুকে গেলাম, মাইন্ড? দেখছেন এদের কাণ্ড!
না না, সমস্যা নেই। নিয়ে যান। মঞ্জুর শাহী বইয়ের পৃষ্ঠায় মাথা ঝুঁকে থাকে।
দেখছেন ভাইয়া, কী রকম পাঁজি এরা! এখান থেকে যেতে চায় না। স্বর্গে আসছে, স্বর্গে। এরা আপনাকে খুব পছন্দ করে। দেখছেন, ভাইয়া?
একটা ধমক দেন তো। আচ্ছা, থাক, লাগবে না।
কনিষ্ঠা- তৃতীয়া শিশু দুটিকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে বেরোয়। এসময় বড় মেঝো যুগপৎ জানালায় মুখ ঠেকিয়ে চেঁচায়, ভাইয়া, ডিস্টার্ব হলো আপনার। নেভার মাইন্ড।
না না, সমস্যা নেই।
থাকায় কোন ঝামেলা নেই তো? ভাত রান্না হয়েছে?
না না, সমস্যা নেই। রান্না হয়েছে/ হবে এখনই।
যাই, ভাইয়া। একদিন দাওয়াত খাবো আপনার এখানে।
জি।
তাদের পুরান ঢাকাই উৎকট সাজগোছ – ঢেউ খেলানো ছাড়া রেশমী চুল, লাল কালো টীপ, ঝলমলে পরিচ্ছদ, উচ্চ মূল্য সুগন্ধির প্রকট বিস্তৃতি- মুহূর্তে জায়গাটিকে তুমুল রোমাঞ্চ আন্দোলনে বুদ করে যায়। সিঁড়িতে পা-জুতোর থপ থপ উচ্চশব্দ, হিন্দি চলচ্চিত্র কিংবা রক গানের সুর ধীরে ধীরে উর্ধ্বে হারায়।
ওদিকে কক্ষটির ঠিক বিপরীতেই নিচের পথে নিয়মিত থাকে বৈকালিক রোমাঞ্চ তোলপাড়। একদল স্কুল কলেজ পড়ুয়া তরুণী- কিশোরী মেয়ে, যারাও পুরনো ঢাকাই, হৈহৈরৈরৈ উটকো সুর গানে-ছন্দে রং ঢং তামাশায় জায়গাটিকে প্রকম্পিত করে রাখে। ওপাশের জানালা পথে কোনও হেতু দৃষ্টি পিছলে নিচে আছড়ালে তাদের পুরো দলটিকে আয়ত্ব করা চলে। সুশ্রী, হাইফ্যাশন, অস্থির, অতি কথক প্রত্যেকে। মাঝেমাঝে তাদের হৈ-হুল্লোড় হাঙ্গামা মাটিতে সমবেত ঝাঁক শালিকের প্রবল কলহের রূপ পরিগ্রহ করে। কোনও ফোঁকরে দৃষ্টি সেদিকে ধাবিত হলে স্পটতই তা নেহাৎ রঙ তামাশা বলে পরিগণিত হয়। মঞ্জুর শাহী ভাবে, কী এমন তাৎপর্য আছে ভর দুপুরে কিংবা ঝরা বেলায় ঘরবাড়ি ছেড়ে দলবদ্ধ পথে এসে এমন হাঙ্গামা বাঁধাবার?
একাকীত্ব কাটাতে আর সুস্বাস্থ্যের স্বার্থে মঞ্জুর শাহী পড়ন্ত বেলায় ভবনের ছাদে ওঠা ধরে। ছাদ বাগানের গাছগুলোর মধ্য দিয়ে হাঁটাহাঁটি করে। প্রথম প্রথম আশপাশের ভবনের ছাদগলো শূন্য দেখা যেত। দু’দিনের মাথায় সে নিচের ওই কোলাহলে মেয়ে-দলটিকে ওপাশের এক ভবনের ছাদে দেখতে পায়। ছাদে উঠেও তাদের কর্মকাণ্ড রাস্তাবৎ। বিস্ময়করভাবে তারা সেইসব গান সমবেত গায়, যেগুলো বাসাটিতে ওঠার প্রারম্ভিক পর্যায়ে কেউ শুনছে না ভেবে মঞ্জুর শাহী কক্ষের ভেতর একাকী গেয়ে থাকত । সে যখন অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকে তখন ও ছাদ থেকে এ ভাই, ও ভাই, হ্যালো-হাই, নানাবিধ শব্দপাত ভেসে আসে। সে তাকায় না ওদিকে। ওদিকে ঝাঁঝালো কণ্ঠ বাজে, দেখ দেখ, কী যে মুড না!
এরপর সমবেত গান:
রঙচটা জিন্সের প্যান্ট পরা – -অথবা,
টেলিফোন ধরি না / কবিতা পড়ি না
- – হ্যালো ম্যাকগাইভার
একসময় মেয়েগুলো কী কারণ নিস্তব্ধতায় ডোবে। সূর্যাস্ত হয়। মঞ্জুর শাহী ছাদ থেকে নেমে আসে।
আজকাল দিনগুলো মঞ্জুর শাহীর বড় মৌনতায়, গুরুগাম্ভীর্যে কাটে । বাসার ভেতর-পক্ষ যেমন দিন দিন তার খুব নিকট সীমায় ঢুঁ দিচ্ছে, বাইরের পক্ষটিও হয়ে উঠছে ক্রম বেপরোয়া। বাইরের পক্ষটি কাকতালীয় কিংবা উদ্দেশ্যমুলক হোক, রাস্তা হাঁটতে প্রায় দিনই তার পিছু নেয়। পরোক্ষভাবে এ, সে নানা কথা বলে পরস্পর হাসাহাসি করে: দেখ দেখ, কিভাবে হাঁটে; দুনিয়ায় যেন সে একা মানুষ। ভাব দেইখা এমন রাগ লাগে না, মনে হয় পেছন থেইকা মারি এক ধাক্কা, হিঃ হিঃ হিঃ প্রভৃতি।
এদের আচরণের হেতু বা উদ্দেশ্য নিয়ে মঞ্জুর শাহী তেমন একটা ভাবনাবিদ্ধ হয় না। সে কল্পনা করতে পারে , সে ঘুরে তাকিয়ে তাদের আচরণ বিষয়ে কোনও জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা আকাশ থেকে পড়ার ভাঁনে দু’চোখ কপালে তুলে চেঁচিয়ে বলবে, ভা-ই-য়া, আপনাকে কিছু বলি নাই তো! মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং!
তারপরও তাদের কর্মকাণ্ড স্বতঃস্ফূর্ত তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা উগড়ে দেয়। একদিন বাইরে থেকে বাসায় ফেরার পথে দলটির একজন এবং এক নবাগতাকে রাস্তা-কোণে দাঁড়ানো দেখতে পায় মঞ্জুর শাহী । গেইটে পা ফেলার সময় স্পষ্ট তার কানে এলো, কেমন রে? স্থায়ীজনের কণ্ঠ।
না-ই-স! যাবি? আমি দাঁড়াই। তুই সাথে গিয়ে ভিতরে শুয়ে থাকগা, হিঃ হিঃ হিঃ! নবাগতা বুঝি তাকে ধাক্কা মেরে বসল।
ছিঃ! এই, কী বললি? ইতর, ফাজিল, তুই-ই যা, তুই! তর মনে হয় খুব শখ লাগছে।
কণ্ঠগুলো অশ্রুত হয়ে আসে। মঞ্জুর শাহী মৃদু হেসে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে। আজকাল রোমাঞ্চানুভব তাকে তাড়া করে না। ভেতর পক্ষের, বার পক্ষের কারো আচরণ বিচরণই করে না। ক্যারিয়ার নিয়ে সে গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন। প্রেমটেম জাতীয় বিষয়াদি তার মস্তিষ্কে জায়গা করে নেয় না। আর সে ভালো করে জানে, যেখানে কোন পরিণতির উপযোগ, সম্ভাব্যতা নেই, সেখানে বেহুদা স্ফূর্তিতে গলা বাড়িয়ে যাওয়ার আবশ্যকতা কী? প্রতারণা, প্রবঞ্চনা তার ধাঁতে নেই। অতএব, যে যেমন খুশি লাফঝাঁপ দিক, নাচুক, তার তাতে কিছু যায় আসে না।
ওপর থেকে ইদানিং খোঁজ খবর কিংবা খাবার প্রেরণের মাত্রাটি ক্রমবর্ধমান। রাতে একত্র হলে অন্য তিন রুমমেট এ নিয়ে বেমালুম ঠাট্টা রসিকতা করে। তাদের জ্যেষ্ঠজন বিবাহিত ;বাকি দুজন সন্দেহভাজন বিষয়ে নিজেদেরকে আওতা বহির্ভূত গন্য করে। মঞ্জুর শাহীকেই এই সন্দেহবিদ্ধ বিষয়ের নায়ক বলে তারা ঘোষণা করে। কথিত মেঝো অপ্সরাকে তারা সন্দেহ আদালতের নায়িকার কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। মঞ্জুর শাহী হেসে ওড়ায়। এ নিয়ে এত ঠাট্টা রসিকতার কিছু নেই বলে সে অভিমত ব্যক্ত করে। বয়স উপযুক্ত ব্যাচেলর নারী পুরুষ থাকলে নারী বা পুরুষ কারো না কারো পক্ষ থেকে এগিয়ে যাবার বিষয়াদি অতি স্বাভাবিক, অতি জাগতিক ব্যাপার, যা অস্বীকার করা জগতকে, মনুষ্য সমাজকে অস্বীকারের নামান্তর বলে সে ঘোষণা করে।
দু’চারদিন তাদের ঠাট্টা রসিকতা বন্ধ থাকে, আবার কোনও ছলে কেউ না কেউ খোঁচা মারে।
এক রাতে তিনজনের সর্বকনিষ্ঠ জন বলল, আরে ভাই, সিরাজুল সাহেব তো নিয়মিত তোমার খোঁজ খবর করা ধরছে? তুমি যখন থাকো না, তখন তোমার টেবিলে বসে, অনেক্ষণ তোমার বই খাতা হাতাপাতা করে, আর নানা কথা জিগায়।
স্বাভাবিক ব্যাপার, কী হয়েছে তাতে?
সেদিন তো তোমার বইয়ের চিপা থেইকা এক কাগজ টাইনা বের করছে।
কী কাগজ?
ধ্বজভঙ্গের ওষুধের বিজ্ঞাপন।
মানে?
আছে না বিজ্ঞাপন?
হু, – ও- মনে পড়েছে।
বিজ্ঞাপনটা পড়ছে সে খুব মনোযোগ দিয়া, বুঝলা?
তাতে কী?
কিছু না, তবে তুমি ওই ওষুধ টষুধ খাও কিনা জিজ্ঞাসাবাদ করছে।
আপনি কী বলছেন?
বললাম খাও। ওষুধ আবার কে না খায়?
ভালো বলেছেন। আজকাল পথ হাঁটতে কিংবা রিক্সায় আসা যাওয়ার সময় নানা প্রকার লিফলেট হাতে ধরে থাকা ছেলেপুলে লিফলেট ছুঁড়ে মারে কিংবা জোর করে হাতে ধরিয়ে দেয়। সৌজন্য দেখাতে ধরি। কখনো কিছুদূর আসার পর না পড়েই মুচড়ে ফেলে দেই। কিন্তু ছবির ওই অদ্ভুতদর্শন অচেনা প্রাণীটা সম্পর্কে জানার জন্য এটা ইচ্ছা করেই এনেছিলাম। তবে এখনো পড়ে দেখা হয়নি।
হুম, বিজ্ঞাপনের ওই প্রাণীটার নাম গন্ধগোকুল । মারাত্মক উপকারী এক প্রাণী।
আমি ওটার জৈবিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে ও বাস্তবে ওটাকে দেখতে আগ্রহী।
হুম!
সিরাজুল কি আর সেইটা বুঝবে? তার মনে আছে নিশ্চয়ই অন্য ধাঁন্দা, বুঝ না?
আহা, তাতে কী যায় আসে?
আইচ্ছা, থাক এইসব বিষয়। তবে সিরাজুলের এইসব ইনকোয়ারি রহস্যজনক। সুন্দরী তিনটা নিয়মিত নামে না?
হুম।
ইদানিং মঞ্জুর শাহী শহরে অধিকাংশ দিনই প্রচুর হাঁটে। হেঁটে টিউশনিতে যায়, হেঁটে ফেরে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রায়শ হেঁটে ফেরে। হাঁটতেই তার ভালো লাগে। দুপুরবেলা হেঁটে ক্লান্ত অবসন্ন যেদিন ঘরে ফেরে, রান্না চড়াবার আগে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে নেয়। বিশ্রামের ফাঁকে কোন কোন দিন বিকালের ঘুমটা আগেই ঘুমিয়ে নেয়। মেসে চুরিচামাড়ি হবার মতো উল্লেখযোগ্য কিছু নেই, চুরির দৃষ্টান্ত নেই, চুরির সুযোগও না থাকার মতো। তাছাড়া, রুমমেটদের কে কখন আসে যায়, তার ঠিক নেই; তাই দরজা ধাক্কাধাক্কি, শব্দপাত বা বিরক্তি এড়াতে লকবল দরজাটা লকে টিপবিহীন ঠিক ভেজানো থাকে।
একদিন ঘুমঘোরে সে অতি সাধারণ তথা নৈমিত্তিকের মতো বিশেষ উত্তেজনা অনুভব করে। সে ঘুমাচ্ছন্নই ভাবছিল, অনুভূতিটা আকৈশোর অনুভব করে আসা তথা বরাবরের ন্যায় ঘুমঘোরের। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা আমূল পার্থক্যসূচক চলকে হোঁচট খেয়ে তার সম্বিৎ ফেরে। বিড়াল কিংবা অনুরূপ কোনও প্রাণীর কীর্তি কি না ভীতিতে সে তুমুল হকচকিয়ে লাফিয়ে বসে। ভীষণ বিস্মিত হয়। অপরাধী কোনও ইতর প্রাণী নয়, এক সভ্য জাগতিক সদস্য; এ ভবনেরই সিঁড়িকোঠার এক বাসিন্দা।
মঞ্জুর শাহী উপলব্ধি করে, তার সমস্ত বিশেষ উত্তেজনা এরই মধ্যে আড়ষ্টতায় পর্যবসিত হয়েছে। প্রিয় পাঠক, এখানে একটু থামা আবশ্যক। বর্ণনায় একটু ভিন্ন পথ নিই।
ধরুন, আমি যদি বাংলা সাধুভাষা যুগের কোন লেখক হতাম, এ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র মঞ্জুর শাহী বয়স পয়তাল্লিশ,পঞ্চাশের প্রৌঢ় হত, তবে আমার ভাষ্যে তার এবং সদ্য ধৃত অপরাধীর মধ্যে কথোপকথনটি হতো নিম্নরূপ :
মঞ্জুর শাহী যথাশীঘ্র যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত করিয়া খাটিয়ায় হেলানে নির্লিপ্ত উপবিষ্ট রহিল। পূর্বেই কহিয়াছি, যৌন উত্তেজনাকর অনুভূতিটি তাহার নিমিষেই কোথায় উধাও হইয়া তামাম দেহমনে কী এক আড়ষ্টতা বহিয়া আনিয়াছে। সে অপরাধী বালকের দিকে আড় চোখে চাহিয়া কহিল, ওহে বৎস, এ কী অনাসৃষ্টি তোমার শুনি! বলা নাই, কওয়া নাই, মৃতবৎ চিৎশায়িত এক প্রৌঢ়কে একাকী ঘুমন্ত পাইয়া এ কী অনাচার তোমার কহো! তুমি কতক্ষণ যাবৎ কতদূর কী করিয়াছ তাহা একান্ত তোমারই সর্বোত্তম জ্ঞাত। তবে ইহা শতভাগ নিশ্চিত, ঘোরতর আপত্তিকর কিছুই করিয়াছ। খোদাকে স্মরিয়া সত্যি করিয়া কহো কী হেতু উহা করিতে গিয়াছ। এও কহিয়া যাও কী হেতু তুমি এ হেন পাপপথে নামিয়াছ। তোমার কি আদৌ যৌবনের উন্মেষ ঘটিয়াছে যে এরূপ বিষয়ে কৌতুহলী হইতে হইবে?
কেহ কি তোমাকে এ হেন কুশিক্ষায় দীক্ষিত কিংবা অভ্যস্ত করিয়া তুলিয়াছে, পরিচালিত করিয়াছে, নাকি এ তোমার একান্ত নিজেরই মনের খেয়াল? ইচ্ছা করিলে তোমাকে ঘোরতর শাস্তি প্রদান করিতে পারি ; তোমার নামে শক্ত নালিশও আনিতে পারি। কিন্তু তাহা করিব না। শিশুদের প্রতি আমি আজন্ম দয়াশীল, অনুগ্রহপ্রবণ; তাদের কতজনের অকাল প্রয়াণে, অনাহারে, নিগৃহীতের সংবাদে আমি ঘোরতর অশ্রু বিসর্জন করিয়াছি! তুমি ইতিপূর্বে এ গৃহে কখনো কোন শুভ কর্মে অনুপ্রবিষ্ট হও নাই। যদি হইতে তাহা হইলে দেয়ালগাত্রের ওইসব মহান বাণী পাঠপূর্বক ( যদি তোমার ক্বচিৎ অক্ষর জ্ঞান থাকিয়া থাকে) তোমার মস্তিষ্কে এ হেন অপকীর্তির চিন্তন কোন ক্রমেই ঠাঁই করিয়া লইতে সক্ষম হইত না। অদ্যই তুমি প্রথম খাদ্য বহনের ন্যায় মহান উপলক্ষে যদি এ গৃহে পদার্পণ করিয়া থাকো, তবে তোমার এ হেন অমহান কীর্তি খানি কেন? যাও বাথকক্ষ হইতে পবিত্র হইয়া আসো; অতপর তোমার আনীত খাদ্যগুলি তুমিই ভক্ষণ করিয়া যাও। আমি কাহাকেও এ বিষয়ে ঘুণাক্ষরে কিছু কহিব না। এ বাটির আহার্য এরই মধ্যে ঢেঢ় গ্রহণ করিয়াছি। অদ্য জ্ঞাত হইয়াছি, তাহা আমার অদৃষ্ট হইতে বিগত বারের ভক্ষণের মধ্য দিয়াই পরিসমাপ্তির রেখা টানিয়া দিয়াছে। যাও, হস্ত বদন ধৌত করিয়া আসিয়া আনীত খাদ্য সামগ্রী ভক্ষণে লিপ্ত হও ।
কিন্তু বাস্তবতা হইতেছে আমিও সাধুভাষা যুগের লেখক নহি ,মঞ্জুর শাহীও বয়সে প্রৌঢ় নহে। আমি আধুনিক কালের লেখক, মঞ্জুর শাহী বয়স পঁচিশের টগবগে যুবক। কাজেই যাহা কিছু পরিপ্রেক্ষিত তথা বাস্তব সাজুয্যপূর্ণ, তাহাতেই প্রত্যাবর্তন করি:
মঞ্জুর শাহী ধৃত বালককে কড়া নির্দেশে বসিয়ে রাখল। সে সময় নিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাবলে নানা ভাবনাই তার মাথায় খেলতে পারত: কাজটি বালকের নিজ বুদ্ধির কি না, সিরাজুলের বিভিন্ন সময়ের আনাগোনা-আচরণ, ছবদের আলীর আচরণ-বিচরণ প্রভৃতি প্রভৃতি। কিন্তু কোন ভাবনাই তার মাথায় খেলল না। সে খাট থেকে নেমে দ্রুত বাথ কক্ষের দরজা খুলে ধৃত বালকের উদ্দেশে চেঁচাল, এইসব ইট-পাথরের ঢেলা, গোবরের শুকনো দলা, জালের কাঠি, গাছের সরু ডালের খণ্ড, তুই প্রায় দিনই ওপাশের রাস্তা থেকে ভেন্টিলেটর পথে নিক্ষেপ করিস। এসব একমাত্র তোরই কাজ। প্রায় দিনই আমি যখন বাইরে থাকি তখন অথবা যখন ঘুমিয়ে থাকি বা ওপাশে পড়ার টেবিলে ব্যস্ত থাকি, তুই-ই সুযোগ বুঝে এসব করিস। কেন এসব বদমাইশি করিস?
আমি করি নাই।
চুপ, মিথ্যাবাদী শয়তান, চুপ। একদম চুপ! গতকালই দুপুরে আমি ওপাশের থাই গ্লাস সরিয়ে জ্বলজ্যান্ত দেখেছি, তুই ভেন্টিলেটর পথে উপর্যুপরি ঢিল ছুঁড়ছিস। নিমিষে দৌড়ে ওপাশের বিল্ডিং এর পিছনে হাওয়া হয়ে গেলি। অপেক্ষায় ছিলাম গেটে কিংবা পথে তোকে ধরার। এতদিন ভাবতাম, ওপাশের মেয়ের দল দুষ্টামী বশত এসব করে। স্বচক্ষে না দেখলে তাদের ভুলই বুঝতাম; চিরদিন মিথ্যাটাকেই সত্য বলে জানতাম। তাদের বকাবকিও করে বসতে পারতাম।
হ্যাঁ, আমি আজ সবই বুঝতে পেরেছি। তুই এসব না করলেই কি ওপাশের মেয়েগুলোর সাথে আমার প্রেম জমে উঠত, বিয়েটিয়ে করে বসতাম? তোর মাথায় আদৌ এসব ধরবে কি না? খলনায়কের দল!
অন্যরা সবাই রাতে ফেরে। কেউ দুপুরে ফিরলেও এসব ঝামেলায় তাদের কিছু যায় আসে না। অথবা আমার অনুপস্থিতিতে তাদের কেউ যখন দুপুরে ফেরে তখন কোন সমস্যা দেখে না। নিশ্চিন্তে ভেন্টিলেটর খুলে চলে যায়। আর তখনই তোর পোয়াবারো!
প্রতিদিন আমাকে ক্লান্ত অবসন্ন অবস্থায় এসব সাফ করতে হয়। যা, বাথরুমে গিয়ে প্রতিটি ময়লা ধুবি। তারপর তোর আনা খাবার সিঁড়ি কোঠায় নিয়ে গিয়ে তুই-ই আত্মা সাতিয়ে খা!
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।