জোলেখার প্রেম-পর্ব ৬
জোলেখার প্রেম-পর্ব ৫ -পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এই বলে ইউসুফ (আঃ) উন্মাদের ন্যায় দরজার দিকে ছুটলেন। জোলেখাও অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় তাঁকে ধরার জন্য পিছনে ছুটলেন। আল্লাহর হুকুমে ইউসুফ (আঃ) কে দরজার সম্মুখীন হতেই তালাবদ্ধ দরজাগুলো এক এক করে খুলে গেল। জোলেখা ইউসুফ (আঃ) কে ধরতে না পেরে তাঁর জামার পিছন থেকে শক্ত করে ধরলেন। তে ইউসুফ (আঃ) এর গতির কোন পরিবর্তন হল না বটে তবে ইউসুফ (আঃ) এর জামা ছিঁড়ে জোলেখার হাতে থেকে গেল।
হযরত ইউসুফ (আঃ) ও জোলেখা যখন ছুটাছুটি করে সদর রাস্তায় এসে পৌঁছলেন, তখন তাঁরা উভয়েই আজিজ মেছেরের সম্মুখীন হলেন। উভয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। জোলেখা আত্নরক্ষার উদ্দেশ্য নারী সুলভ বুদ্ধিমত্তার আশ্রয় নিলেন এবং কান্নার ভান করে আজিজ মেছেরের নিকট বললেন। “আমাকে তুমি আচ্ছা এক গোলাম উপহার দিয়েছ। আমি তোমার কথা অনুসারে বিগত সাত বছর যাবত তাঁকে আদর-যত্ন করে আসছি। দাস-দাসীর ন্যায় কোন আচরণ তাঁর সাথে করি নাই। অত্যন্ত আপন জনের ন্যায় স্নেহ দিয়েছি। এমনকি তাঁর পরিচর্যার নিমিত্ত দাস-দাসী নিয়োগ করেছি। এখন পরিণামে সে আমার ইজ্জত হরণ করতে উদ্দত হয়েছে। এমন নাছার গোলামকে অতি সত্ত্বর কয়েদখানায় প্ররণ কর।”
হযরত ইউসুফ (আঃ) জোলেখার বক্তব্য শুনে অবাক হলেন এবং বিনম্র কন্ঠে বললেন, “শ্রদ্ধেয় আজিজ মিছির সাহেব, জোলেখা আপনার নিকট যে কথা বলেছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি তাঁর প্রতি কোনরূপ বদনজর করি নি বরং তিনি আমাকে এমনভাবে উৎত্যাক্ত করেছেন যাতে আমার ঈমান বাঁচান কঠিন হয়েছে। আজকে তিনি আমাকে তার হপ্তমহলে ডেকে নিয়ে অন্যায় কাজে প্রবৃত্ত হওয়ার জন্য আমার উপর কঠিন চাপের সৃষ্টি করে। তখন আমি নিজেকে হেফাজত করার উদ্দেশ্যে সেখান থেকে দৌড় দেই। জোলেখা আমার জামা টেনে ধরে। জামার ঐ অংশ ছিঁড়ে তার হাতে থেকে যায়। আমি আল্লাহর অসীম কৃপায় তার কবল থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হই। এ সময় সদর রাস্তায় আপনার সম্মুখীন হই।”
আজিজ মিছির হযরত ইউসুফ (আঃ) ও জোলেখার বিপরীতমুখী বক্তব্য শুনে চিন্তিত হলেন এবং মনে মনে ভাবলেন হযরত ইউসুফ (আঃ) অনন্য সাধারণ ছেলে। দীর্ঘ সাত বছরের মধ্যে তাঁকে একটি মিথ্যা কথা বলতে কেউ শুনে নি। তাঁর চরিত্র অত্যন্ত নির্মল বলে মহলের সমস্ত লোক আলোচনা করে থাকে। ধর্মানুরাগ তাঁর জীবনের বৈশিষ্ট্য বলে সকলে জানে। অতএব এই ছেলের প্রতি জোলেখার অভিযোগ সত্য বলে মনে হয় না।
এভাবে দীর্ঘ সময় চিন্তা ভাবনা করার পরে তিনি হযরত ইউসুফ (আঃ) কে বললেন তোমার বক্তব্যের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য একজন সাক্ষী প্রদান কর। হযরত ইউসুফ (আঃ) আজিজ মেছেরের কথার জবাবে বললেন, তবে চলুন হপ্ত মহলের অভ্যন্তরে চলুন। হপ্ত মহলের অভ্যন্তরে গিয়ে তিনি যে দৃশ্য দেখলেন তাতে হযরত ইউসুফ (আঃ) এর প্রতি তার আর কোনরূপ সন্দেহ থাকল না। তিনি যখন সাক্ষী চেয়েছেন তখন সাক্ষীর ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
তাই তিনি হযরত ইউসুফ (আঃ) কে বললেন “তোমার সাক্ষী কোথায়?” হযরত ইউসুফ (আঃ) চতুর্দিকে তাকিয়ে দোলনায় রক্ষিত একটি শিশুকে দেখিয়ে বললেন, “ঐ শিশুর নিকট জিজ্ঞাসা করুন কে অপরাধী।” আজিজ মিছির একটু হেসে বললেন এবার বুঝতে পারলাম, তুমি অপরাধী। না হয় একটি ছয় মাসের শিশুকে সাক্ষী হিসেবে কেন প্রস্তাব করলে। শিশু কি কথা বলতে পারে? না ওর কোন জ্ঞান বুদ্ধি আছে? তখন আল্লাহর নির্দেশে শিশুর জবান খুলে গেল। সে আজিজ মিছিরকে লক্ষ্য করে বল, “হযরত ইউসুফ (আঃ) ও জোলেখার অপরাধ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আপনি লক্ষ্য করে দেখুন, হযরত ইউসুফ (আঃ) এর জামাটি কি সম্মুখ দিয়ে ছেঁড়া না পিছন দিক থেকে ছেঁড়া। যদি সম্মুখ দিক দিয়ে ছেঁড়া থাকে তবে হযরত ইউসুফ (আঃ) দোষী। আর যদি জামাটি পিছন দিক থেকে ছেঁড়া থাকে তবে জোলেখা দোষী – এটাই চূড়ান্ত সাক্ষ্য।”
আজিজ মিছির শিশুর বক্তব্য শুনে অবাক হলেন এবং তদানুসারে অনুসন্ধান করে দেখলেন হযরত ইউসুফ (আঃ) এর জামার পিছন দিক থেকে ছেঁড়া। তখন তিনি জোলেখাকে দোষী সাব্যস্ত করে কঠোর ভাষায় তাকে তিরস্কার করলেন এবং হত্যা করার কথা প্রকাশ করলেন। তখন শিশুটি দোলনা থেকে পুন সজোরে বলে উঠল, “আজিজ সাহেব আপনার সিদ্ধান্ত ভুল। এতে চতুর্দিকে আপনার ও আপনার বংশের কলঙ্ক ছড়িয়ে যেতে পারে।” তখন আজিজ মেছের জোলেখাকে বললেন, “আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। তবে তোমার অপরাধ ক্ষমা করার প্রকৃত মালিক মহান আল্লাহ। অতএব সেই মহান সত্ত্বার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর।” অতঃপর হযরত ইউসুফ (আঃ) কে বললেন, তুমি নিরাপদে তোমার দায়িত্ব কর্তব্য পালন কর এবং ঘটনাটি ভুলে যাও।
হযরত ইউসুফ (আঃ) পরে আজিজ মেছেরের নিকট জোলেখার মনের চাহিদা সম্বন্ধে পরিস্কার ভাবে বলেছিলেন যে, জোলেখা তাঁকে অবৈধ যৌন সঙ্গমে বাধ্য করার জন্য বিভিন্ন কৌশল ও অদম্য চেষ্টা আরম্ভ করেছিল। যার সম্মুখে সততা নিয়ে বেঁচে থাক তাঁর পক্ষে ভীষণ কষ্টকর হয়েছে। অতএব এ ধরনের বিপদের সম্মুখীন তাঁকে যেন না হতে হয় তার উপযুক্ত ব্যবস্থা করার আবেদন পেশ করেন। এ জন্য যদি তাঁকে কারাগারে প্রেরণ করা প্রয়োজন হয় তবুও তাতে তিনি সম্মত আছেন। আজিজ মেছের এ কথার উওরে বলে দিলেন যে তোমার প্রভুই তোমাকে এ কলঙ্কের বিপদ থেকে রক্ষা করবেন। তুমি তাঁর নিকট প্রার্থনা কর।
সূত্রঃ কুরআনের শ্রেষ্ঠ কাহিনী