সুরুজ মিয়া স্ত্রী’র পেছনে পেছনে হাঁটে । তার মুখটা সব সময় আকাশের দিকে তাকানো থাকে । স্ত্রী জোছনা দুর্বল পায়ে সামনে সামনে হেঁটে চলে । সুরুজ মিয়া ক্লান্ত গলায় বলে,
– আর কত পথ জোছনা! ও জোছনা! আর কত পথ!
জোছনা সাড়া দেয় না । জোছনা সাড়া দিতে পারে না । কারন সে বধির । কানে শুনে না । স্বামীর কথা তার কান পর্যন্ত পৌছায় না । সে তার অন্ধ স্বামী কে পথ দেখিয়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায় । আরেকটু গেলেই আউলিয়ানগর রেলস্টেশন ।
জোছনা হেঁটে চলে । তার আঁচলের কোন ধরে অন্ধ সুরুজ মিয়া হেঁটে চলে পেছন পেছন । সুরুজ মিয়া সুর করে গান ধরে,
– আল্লাহ্ খোদা মেহেরবান
– একটা টেকা ভিক্ষা দিয়া যান
– আমি অন্ধ ফকির ভাইজান
– একটা টেকা ভিক্ষা দিয়া যান
জোছনার কানে সুরুজ মিয়ার গলার স্বর অল্প অল্প পৌছায় । ইশ যদি কানটা ভাল থাকত সে মানুষটার গান প্রাণ ভরে শুনত । তবু অল্প অল্প শুনেও সে খুশি । মানুষটাকে দেখলে বড় মায়া লাগে । কি সুন্দর মুখটা! চক্ষু দুইটা নাই ।
তারা দুজন সারা দুপুর রেলস্টেশনে ভিক্ষা করে । সন্ধ্যা সন্ধ্যা বাড়ি ফিরে । সুরুজ মিয়া জোছনাকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা দিয়ে বলে,
– সন্ধ্যা হয়ে গেছে নি?
– হ
– আসমানে চান আছে? চান?
– হ
সুরুজ মিয়ার বড় খুশি খুশি লাগে । তার চক্ষু দুইটা অন্ধ । তবু আসমানে যেদিন চান উঠে তার বড় ভাল লাগে । মনটা ফুরফুরা লাগে । সুরুজ মিয়া রাতে খাবার পর ঘুমায় না । বউ এর মুখটার উপর হাত রাখে । কি সুন্দর চক্ষু! নাক মুখ! না জানি মেয়েটা কত সুন্দর!
সুরুজ মিয়ার স্ত্রী কে দেখতে মনটা বড় আনচান করে । কিন্তু সে কোন দিন তার স্ত্রীকে দেখতে পারবে না । তার চোখে কোন দিন আলো আসবে না । সুরুজমিয়া বালিশে মাথা রেখে জেগে থাকে । রাত গভীর হতে থাকে । জোছনা আঁচ করতে পারে মানুষটার মন খারাপ । মানুষটার মন খারাপ হলেই তার মুখে হাত বুলায় । চোখে নাকে । মানুষটার আশা একটা নাকফুল বানিয়ে দিবে । টাকার জন্য পারছে না বানাতে ।
জোছনা স্বামীর মন ভাল করতে গান শুনাতে বলে । যদিও সে বধির । কানে ঝাপসা ঝাপসা শব্দ আসে গানের । তাই ভাল লাগে । সুরুজ মিয়া গানে টান দেয়,
– দেখব বলে তোরে পাখি
– চাইছিলাম চক্ষু মেলিয়া
– আন্ধার রাতে একলা পথে
– কোথায় গেলি হারাইয়া…
আবছা আবছা গান শুনতে শুনতে জোছনা এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে । রাত গভীর হতে থাকে । জোছনায় চারদিক ঝলমল করতে থাকে । সুরুজ মিয়ার খুব ইচ্ছা করে জোছনা দেখতে । তার অন্ধ চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে…
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।