(২) “পাপা আমি জেলিকে খেতে দেব?” “হ্যাঁ হ্যাঁ দাও, একটুখানি জলের উপর ছড়িয়ে দিবি, ঠিক আছে?” “ঠিক আছে” জলে খাবার ছড়িয়ে দিতে দিতে রাতুলের উত্তেজিত কিন্তু চাপা কণ্ঠস্বর। “জানিস আজ বাবা মা চুপি চুপি ঝগড়া করছিল। মা-এর চোখে জল ছিল। আচ্ছা জেলি তুই যদি কাঁদিস তাহলে আমি কি করে বুঝতে পারব? তুই তো সব সময় জলের মধ্যে থাকিস”। “রাতুল শুতে এস।” “যাই, মা ডাকছে। তুই ঘুমিয়ে পড়। গুড নাইট।” রাতে বড় অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখল রাতুল। দেখল একটা ছোট্ট ফিশ ট্যাঙ্ক-এর মধ্যে আটকে আছে সে। যেখানে নড়াচড়া করার সামান্য জায়গাটুকুও সে পাচ্ছে না। আর সামনে তাকাতেই তার দৃষ্টি আরও হতবাক হয়ে উঠল। জেলি জলের মধ্যে নেচে বেরাচ্ছে। কিছুদিন আগেই ও যে হিন্দি গানটা টিভিতে শুনেছে সেই তালেই জেলি-র কোমর দুলছে। আর এদিকে রাতুলের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে এই ছোট্ট পরিসরে। রাতুল কিছু বুঝতে না পেরে জেলিকে একবার খুব জোরে ডাকল। কিন্তু তাতেই কিছুটা জল তার মুখের ভেতর ঢুকে গেল। রাতুলের মনে হচ্ছিল এবার সে মরে যাবে। শেষবারের মতো মতো পা-টাকে ঠেলে বাইরে বেরতে চাইল। কিন্তু একি, এখানে দরজা কোথা থেকে এল। দরজাটা দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল। রাতুলের খুব জোর কান্না পেল। কিন্তু তার পরক্ষণেই দেখল বড় দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে যাচ্ছে। জেলি এসে দরজাটা খুলছে। কিন্তু ওখান থেকে রাতুলকে বের না করে জেলি আবার চলে গেছে নাচতে। আবার সে কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে নাচছে। (৩) বাড়ির দরজায় ঢুকতে ঢুকতে সারমেয় ধ্বনি কানে আসল রাতুলের। বাড়ির উঠানে একটা বড় গাড়ি দাড়িয়ে আছে। তার মানে কি বড় মানি এল। দ্রুত পা চালিয়ে ঘরে প্রবেশ রাতুলের। পিছনে স্কুলের ব্যাগ হাতে রাতুলের বাবা। প্রবেশদ্বার পার করতেই মা-এর কণ্ঠস্বর আর মাসির ফিসফিস কানে এল। কিন্তু সেই সব ধ্বনি ছাপিয়ে যাচ্ছিল গোল্ডির আওয়াজ। রাতুলের তক্ষুনি মনে পড়ল জেলির কথা। রাতুলের প্রায় দৌড়ে ঘরে ঢুকে দেখল গোল্ডি আকুইরিয়ামের সামনে দাড়িয়ে গলার বাগিয়ে হাকাচ্ছে। রাতুল পলকের মধ্যে দুটো হাত ছড়িয়ে রক্ষনাত্মক ভঙ্গিতে আকুইরিয়ামের সামনে দাড়িয়ে পড়ল। “এই গোল্ডি যা, যা বলছি, বের এখান থেকে”। “পাপা দেখ না গোল্ডি জেলিকে ভয় পাওয়াচ্ছে”। ওপ্রান্ত থেকে কোন ইতিসূচক সাড়া এল না। “যা গোল্ডি, যা” এবার রাতুল সাহস করে গোল্ডির কলার ধরে ঘরের বাইরে নিয়ে আসল। সোফায় পা মেলে রাতুলের মা ও মাসি বসে গল্প করছে। “বড় মানি তুমি গোল্ডিকে আর আনবে না, দেখ কি ভাবে জেলিকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে”। বিস্ময়সূচক চিহ্ন নিয়ে রাতুলের মাসি তার বোনের দিকে তাকাল। “আরে পল্লব ওকে একটা মাছ এনে দিয়েছে” “ও আচ্ছা” “ঠিক আছে বাবাই আমি গোল্ডিকে বকে দেব, ও এইরকম আর করবে না”।
(৪) “এই তুই আমার পেন্সিলটা কেন ভাঙলি?” “তুই আমার রাবারটা দেওয়ালে কেন ঘষলি?” “বেশ করেছি” “আমিও তাহলে বেশ করেছি” “দাঁড়া আমি তাহলে মিসকে বলছি” “কুন্তল, পারিজাত নিজের নিজের জায়গায় বস। বি কোয়াইট।” “তো এই স্টোরির-র মরাল হল, কোন অ্যানিম্যালস্দের দের বন্ধ করে রাখা উচিত না। যেমন আমরা বার্ডস কেইজ-এ বন্ধ করে রাখি”। রাতুল খুব সুন্দর করে নিজের নামটা কপির উপর লিখছিল, অন্যমনস্ক হয়ে। হঠাৎ করে তার কান খাড়া হয়ে গেল। “কিন্তু সেটা আমাদের করা উচিত না. “উই শ্যুড নট কেইজ এনি অ্যানিম্যালস্।” রাতুলের সামনে জেলির ছোট্ট পরিসরটা ভেসে উঠল। আচ্ছা আন্টি বলছে, কোন অ্যানিম্যালস্কে কে আটকে রাখতে না। আচ্ছা জেলি তো ফিশ, জেলি কি তাহলে অ্যানিম্যাল? সেদিন যে টিভিতে দেখচ্ছিল, মাছগুলো কি সুন্দর বড় সমুদ্রে খেলে বেরাচ্ছিল? কই অ্যাকোয়ারিয়ামে তো মাছ দেখাল না। তাহলে কি আমিও জেলিকে আটকে রেখেছি? ওই যে আন্টি যে স্টোরিটা বলেছিল সেই কিং-এর মতো? কিন্তু জেলি আমার বন্ধু। “কিরে রাতুল টিফিন-এ কি এনেছিস?” রাতুল এতক্ষণ জানলার দিকে তাকিয়ে বাইরের বড় গাছটা দেখছিল। কিন্তু ঠিক তা দেখছিল না। অনিমেষ দু’হাতে টিফিন বক্সটা ধরে রাতুলের সামনে দাড়িয়ে আছে। “দাঁড়া দেখছি” বলে রাতুল নিজের ব্যাগ গহ্বরে হাত ঢোকাল। “ইস… মা আবার সাদা সাদা স্যান্ডউইচ দিয়েছে, ছ্যাঃ নে তুই খেয়ে নে”। “কেন তুই খাবি না?” “না, এই নে”। “এই নে, আমার মা বেগুন ভাজা আর রুটি দিয়েছে। তুই এইটা খা”। রাতুল একবার টিফিন বক্স টা দেখল, তারপর আর সেদিকে আর হাত বাড়াল না। অনিমেষ যেমন আমার বন্ধু, জেলি বড় সমুদ্রে থাকলে তারও অনিমেষ-এর মতো অনেক বন্ধু হত। তাহলে ও ঠিক ওই স্বপ্নের মতো কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে ওদের সাথে নাচত।
(৫) “রাতুল তুমি এখানে নামছ?” “হ্যাঁ আমি এখান থেকেই চলে যাব”। “কিন্তু তোমার বাড়ি তো একটু এগিয়ে”। “মা আজ বাড়ি থাকবে না, তাই এই পিসির বাড়ি যেতে বলেছে”। “ঠিক আছে” ধ্যাৎ কিরকম মিথ্যে কথা বলতে হল। বললেই পারতাম যে পুকুরে মাছ দেখতে যাচ্ছি। তাহলে কি বাসকাকু বকত? কালো জল কোথাও কোথাও হালকা মনে হচ্ছে সূর্যের আলোতে। পুকুরের চারিপাশে বেড়ার ঘেরাটোপ। শুধু দুটো জায়গা খালি। রাতুল তার মধ্যে একটি জায়গা বেছে নিল পর্যবেক্ষণের জন্য। তার গলায় ঝোলানো জলের বোতল আর পিঠে ছোট্ট নীল ব্যাগটাও স্থির। রাতুলের চোখের কালো মণি এপাশ থেকে ওপাশ ঘুরে বেরাচ্ছিল। ওই যে ওই যে একটাকে দেখলাম। ওই যে ছোট্ট কালো সুতোর মতো। নড়ে নড়ে চলছে। “এই এই কোথায় যাচ্ছিস?” ওই তো কত গুলো একসাথে আসছে। আচ্ছা এইখানে জেলিকে ছেড়ে দিলে কেমন হয়? সবার সাথে বেশ বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলবে। জেলি এখানে বেশ ভালই থাকবে, জায়গাটাও বেশ বড়। রাতুল ভেবে দেখল এধার থেকে ওধার দৌড়ে গেলে রাতুলকে দু’বোতল জল খেতে হবে। তাই সেই চিন্তা রাতুল মনে থেকে বের করে দিল। রাতুলের মনের মধ্যে খেয়ালের বাজির ফাটছিল। এখানে থাকলে রাতুল রোজ এসে একবার জেলিকে দেখে যেতে পারবে। কিন্তু বাসকাকুকেও তো তাহলে রোজ মিথ্যে কথা বলতে হবে। সে না হয় দেখা যাবে। চারিদিক ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে রাতুলের পা জোড়া এবার বাড়ির দিকে চলতে শুরু করল। (৬) বাইরে বৃষ্টিটা আরেকটু কালো হয়ে নামল যেন। শব্দটা জানলার ফাঁক দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকছিল। কিন্তু সেই শব্দ কোন ভাবেই রাতুলকে নড়াতে পারছিল না। তার দুটো চোখ কখন থেকে সেই এক জায়গায় বসে আছে। তার নড়চড় নেই। একটা কাঁচের বাক্স, টলটল করছে নীল জল, আর তার মধ্যে লাল রঙের ছোট্ট একটা প্রানি। যেদিন বাবা জেলিকে এনেছিল, সেদিন বাবার সাথে আরও একজন কাকু এসেছিল। অনেক কিছু কাজ করেছিল যেমন অ্যাকোয়ারিয়ামটাকে সাজানো, লাইট লাগানো। জেলি ওই কাকু টার হাত থেকে টপ করে ডাইভ মেরে জলে নেমেছিল। জেলি সেই একই রকম দেখতে লাগে যেদিন থেকে তাকে আনা হয়েছিল। আচ্ছা জেলি কি বড় হচ্ছে না? নাকি রাতুলের ছোট্ট ছোট্ট চোখে সেটা ধরা পড়ছে না। জেলি না থাকলে ওই কাঁচের বাক্সটা খালিই থাকবে। জেলি না থাকলে রাতুল তার কথা বলার সঙ্গীটাও হারাবে। তাহলে কাকে বলবে সে দেবলিনার কথা, তার স্কুলএর দুষ্টু বন্ধুদের কথা, মা-এর বন্ধুটার কথা। মাঝখানে একটা ফাঁক তৈরি হচ্ছিল। আস্তে আস্তে রাতুলের চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে আসছিল। গালের উপর ঠাণ্ডা শীতল জলের ছোঁয়া লাগছিল। রাতুল আস্তে করে চোখ মুছে নীল আলোর দিকে এগিয়ে গেল। “তুই আমার চিন্তা করিস না” রাতুলের একটা হাত তখনও চোখ থেকে জলের শেষ বিন্দুটাকে সরাতে ব্যস্ত। সে এখন দুটো পা ভাজ করে কাঁচ বাক্সটার সামনে বসেছে। তার দুটো হাত তখন কাঁচের উপর আদর করছে। “তুই ওখানে অনেক বন্ধু পাবি, ওটা অনেক বড় জায়গা। তোকে এই ছোট্ট জায়গায় আর থাকতে হবে না”। জেলি তখন নিস্পলক দৃষ্টিটে রাতুলের দিকে তাকিয়ে। ও, মাছের তো চোখের পাতা হয় না। তাই তাদের দৃষ্টি নিস্পলক হয় স্বাভাবিক ভাবেই। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছিল জেলি রাতুলের প্রত্যেকটা কথার অর্থ খুঁজে পাচ্ছে। রাতে ঘুমের ঝাঁপটা একটু দেরিতেই এল। শুয়ে শুয়ে একটা চিন্তাই মাথার এপাশ ওপাশ টহলদারি করছিল। কি করে জেলিকে ওই পুকুরে ছেড়ে আসা যায়? এই ভাবনাতে ডুবেই ঘুমের দেশে কখন হারিয়ে গেছিল রাতুল বুঝতে পারেনি। প্রত্যেক দিনের মতো মায়ের ডাকাডাকিতে চোখ খুলল রাতুলের। বাড়িতে ততক্ষণে তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। বাবার ডাকাডাকি, মায়ের দৌড়াদৌড়ি, গীতা পিসির রান্নাঘরে হাতা-খুন্তি নিয়ে নাচানাচি। কিন্তু যখন এই আওয়াজ গুলো সরল, তখন রাতের চিন্তাটা তার মাথাটা জুড়ে বসল। হঠাৎ মা ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকল, “বাবাই তাড়াতাড়ি ব্রাশ করে নাও, আমি ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছি”। ব্যাগ, হ্যাঁ ব্যাগটাই তো। এটাই তো হতে পারে। ব্যাগে ভরে জেলিকে নিয়ে গেলে কেমন হয়? কেউ দেখতে পারবে না তাহলে। ব্রাশ করতে করতে রাতুল দেখে নিচ্ছিল ঘরের ঠিক কোথায় একটা ছোট্ট প্লাস্টিক আর রাবার ব্যান্ড পাওয়া যাবে। এবার শুধু জেলিকে ভরার পালা।
(৭) নীল ব্যাগটা দুলছে। এদিক থেকে ওদিক রাতুলের পীঠে। ভেতরে জেলিও। এই প্রথমবার জেলি অ্যাকোয়ারিয়াম থেকে বাইরে এসেছে। রাতুল ইচ্ছে করে ব্যাগের অর্ধেকটা খুলে রেখেছে যাতে বাইরের টুকরো টাকরা ছিটে জেলির চোখেও পড়ে। এখান দিয়ে পুকুরটা অর্ধেক দেখা যাচ্ছে। রাতুল এবার একটু জো্রেই হাঁটা শুরু করল, দেরি হলে বাসটা হাতছাড়া হতে পারে। মায়ের সাথে জেদ করে, জোর করে চোখের জল বের করে একা বেরিয়েছে এই বলে যে আজ সে শুভমের বাড়ি হয়ে শুভমের সাথে বাস ধরবে। এতক্ষণে সে শুভমের বাড়ি ছাড়িয়েও চলে এসেছে। রাতুল এবার পুকুরের ঘেরাটোপের ভেতর দাড়িয়ে ছোট্ট বাঁশের খুঁটিটার উপর ভর দিয়ে। আর এক হাতে নিজের পীঠের ব্যাগটা ধরে। এবার ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে দুহাতের মাঝখানে জড়িয়ে ধরল। টুক করে ব্যাগের অন্ধকার ভেতরটাও চোখ বুলিয়ে নিল। কি হবে যদি যদি জেলির একটাই বন্ধু থাকে? কি হয়েছে ওকে ওই ছোট্ট জায়গায় থাকতে হবে? আমি ওর সাথে সব সময় থাকব। কোন সময় ঝগড়া করব না। ব্যাগের খোলা চেনটায় হাত গেল রাতুলের। ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে ব্যাগের চেনটা বন্ধ হল।
(৮) কল দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে। সাদা বেসিনে সাদা জল মিশে যাচ্ছে। ছোট্ট ছেলেটার মুখের ঠোঁটের উপরটুকুই দেখা যাচ্ছে সুসজ্জিত আয়নাতে। ব্রাশটা তার মুখে একই জায়গায় আটকে আছে। তার উজ্জ্বল চোখ দুটো আয়নায় যেন খুঁজে বেরাচ্ছে। “মহুয়া, প্রদীপের নাম্বারটা কোথায়?” “কে প্রদীপ?” “আরে মাছের লোকটা গো, এতদিন হয়ে গেল। ওকে একবার ডেকে অ্যাকোয়ারিয়ামটা পরিষ্কার করিয়ে নি”। কথাগুলো রাতুলের কানে ঝনঝন করে বেজে উঠল। মুখ ধুতে গিয়ে তাড়াহুড়োর চোটে দুবার ব্রাশটা বেসিনেও পড়ে গেল। পাপা অ্যাকোয়ারিয়াম পরিষ্কার করাবে? আর যখন খুঁজে পাবে যে সেখানে জেলি নেই তখন কি উত্তর দেবে রাতুল? প্রায় দৌড়ে আলোকিত কামরায় প্রবেশ করল সে। খালি নীল অ্যাকোয়ারিয়ামটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে খাটের কোণে জায়গা করে নিল ছোট্ট শরীরটা। ভয়ে তার পেটের ভেতর চিনচিনে ব্যাথাটা আরও পাকিয়ে পাকিয়ে উপরে উঠতে শুরু করছিল। ভয়ে সে চাদরটাকে আরেকটু জোরে কষে ধরল। আর তখনই এক পূর্ণবয়স্ক মানুষের প্রবেশ। সে টেবিলে রাখা কাগজের স্তূপের মধ্যে কিছু হাতড়াচ্ছিল। “পাপাই জেলি নেই” তখনও তার হাত আটকায়নি। “পাপা আমি জেলিকে ছেড়ে দিয়ে এসেছি” সেই পূর্ণবয়স্ক শরীরটা এবার পুরো ৯০ ডিগ্রি ঘুরে গেল। “কি-ই-ই-ই-ই…কোথায়?” এই চমকানো আওয়াজটা রাতুলকেও যেন একটু চমকে দিল। তার মুখে কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। “পাপা জেলি এখানে একা, একা-একাই থাকে, কোন ফ্রেন্ড নেই। তাই পাপা আমি জেলিকে ওর ফ্রেন্ড দের কাছে ছেড়ে এসেছি, পুকুরে”। রাতুলের বাবার মুখে অবাক ও বিস্ময়ের এক আলোছায়াময় চিত্র অঙ্কিত হচ্ছিল। কিন্তু সেটা রাতুল দেখতে পাচ্ছিল না। সে তখন লাল চাদরে সাদা ফুল গুনছিল। তার চোখের জলের ভারে গলাটাও নুইয়ে পড়েছে। রাতুল অনুভব করল তার পাশে বিছানার জায়গাটা কিছুটা বসে গেছে। একটা হাত এসে তার মাথায় আলতো করে ছোঁয়া রাখল। রাতুল এবার মুখ তুলেছে। ঝাপসা ঝাপসা দেখছে সব কিছু। ঘরের সাদা লাইটটা আরও জোড়াল মনে হচ্ছে।
(১০) বৃষ্টির প্রহার এখন অনেকটা ক্লান্ত। রাতুলের ভেজা শরীরটা বিছানার উপর বিরাজমান। তার প্যান্টস থেকে চুয়ে পড়া বৃষ্টির ফোঁটা গুলো সাদা মেঝের উপর একটা ছোট্ট প্রবাহি নদীর সৃষ্টি করেছে। এই রকম অনেকটা সময় চলে গেল। বাইরেটা এখন অন্ধকার, সূর্যি মামা কাল আবার আসবে বলে এখন বাড়ি গেছে। নিচে পড়ে থাকা ব্যাগটার নজর ফিরিয়েছে রাতুল। প্লাস্টিকটা বের করে তার নীল অ্যাকোয়ারিয়ামের দিকে এগিয়ে গেল। যে শেষ জলটুকু সে পুকুর থেকে তুলে এনেছিল সেটুকু সে অ্যাকুইরিয়ামে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। এই ভেবে হয়তো এইটুকু স্মৃতি তার কাছে থেকে যাবে তার প্রিয় বন্ধুটির। জলটা ঢালতেই একটা টপ করে আওয়াজ হল। এতক্ষণ পড়ে রাতুলের নিষ্প্রাণ নজরে একটু প্রা্ণের সঞ্চার ঘটল। সে দেখতে পেল একটা গাড় লাল রঙের মাছ অ্যাকোয়ারিয়ামের মধ্যে দ্রুতগতিতে ঘুরে বেরাচ্ছে। তার পাখনা ঝড়ের গতিতে নাচছে জলের নীচে। রাতুল প্রায় দুহাত দিয়ে কাঁচের বাক্স টাকে জড়িয়ে ধরেছে। তার দুটো চোখ গেঁথে গেছে কাঁচের দেওয়ালে। যেখান দিয়ে পরিষ্কার জেলিকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, ঠিক সেই জায়গাতেই রাতুল তার ঠোঁট দুটো চেপে ধরল। তার চোখের গরম জল গাল বেয়ে নেমে এসে ঠোঁটের উপর জমা হয়ে কাঁচে এক অদ্ভুত রেখার সৃষ্টি করছিল। রাতুল এবার উঠে দাড়িয়ে জলের ভেতর হাত দিয়ে একবার জেলির নরম শরীরটা ছুঁয়ে দেখল। “আই অ্যাম সরি, আমি আর কোন দিন এইরকম করব না”। জেলি হয়তো জলের মধ্যে দিয়ে তার পাখনা গুলো ঝাপটে তার সম্মতি জানিয়েছে হবে। কিন্তু সেটা বাইরে থেকে বোঝা গেল না।