খুব শক্ত অসুখ হয়েছিলো তুতুলের। সবে তিন দিন হলো হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছে। এই ক’দিন এক ছায়া ছায়া ঘুমের দেশে বেড়িয়ে এলো সে। হাতে-পিঠে ছুঁচ, রক্তের বোতল, মুখোশ পরা কারা যেন সব – সমস্ত কিছু ভারী চোখের পাতায় ধোঁয়ার মতো মনে হতো। মা’র জন্য বুক ঠেলে একটা কান্না বেরিয়ে আসতে চাইতো।
অসুখের নামটাও জেনে ফেলেছে সে – লিউকেমিয়া। তুতুল ঘুমিয়েছে ভেবে বাবা আর ডাক্তারবাবু ফিসফিস করে কথাবার্তা বলছিলেন। রেমিশন হয়েছে, পঁচিশ পার্সেন্ট চান্স এইসব শক্ত শক্ত কথা। হুঁ, না হয় তুতুলের মোটে পাঁচ বছর বয়েস হয়েছে, তা বলে কি তাকে ইংরেজী বলে ঠকানো যায়! তুতুল ঠিক বুঝেছে, সে মরে যাবে। তবে এখন নয়, অনেক দিন পর। থুত্থুড়ে বুড়োই হয়তো হয়ে যাবে তদ্দিনে। যাকগে, যা হবেই সে নিয়ে আর ভেবে লাভ কী! তুতুল তাই খাটে বসে জানালা দিয়ে শালিক পাখির ঝগড়া দেখতে থাকে।
“ওকে সব সময় খুশিতে রাখবেন”, বলছিলেন ডাক্তার কাকু। মজা লাগে তুতুলের। এই ঘরে বসে দুপুর বেলা এদিক-ওদিক তাকালে মন তো আপ্সেই খুশিতে ভরে ওঠে! কিছু দূরে প্রবীরদের সাদা ধুমসো বেড়ালটা চোখ বুঁজে তপস্বীর মতো বসে আছে, একটা কাক তার ল্যাজ ধরে দিলো অ্যায়সা টান। একটা বাচ্চা মোষ চার পা তুলে ধুলো উড়িয়ে ছুটে পালাচ্ছে – কই, কেউ তো তাড়া দেয়নি! ঘরের দেয়ালের টিকটিকিটা পুঁচকে পোকাটাকে ধরতে লাফ মেরেই মেঝেতে ধপাস্। মরে গেলো নাতো? একটা কাগজের গুলি পাকিয়ে ছুঁড়ে মারে তুতুল, টিকটিকি অমনি খাটের তলায় সড়াৎ।
অনেক নতুন ছবির বই এসেছে তুতুলের জন্য। ভারী মজার মজার সব ছবি। গল্পও নিশ্চয়ই মজার। কিন্তু কালো কালো অক্ষরগুলো চোখের সামনে জড়িয়ে-পেঁচিয়ে যায়। আসল ব্যাপারটা শুরু হবার আগেই চোখ ঘুমে ভেঙে আসে। এবার নকশা কাটা জার্মান সিলভারের গ্লাসটার গায়ে চোখ রাখে তুতুল। একটা দারুণ সুন্দর ট্রেন দাঁড়িয়ে। প্ল্যাটফর্মে কেউ নেই, খালি ফুলের বাগান। ট্রেনের জানালায় আলখাল্লা পরা ওটা কি সেই গল্পের চিনা বুড়োটা, নাকি তার বন্ধু সৌরভ? ঠিক আছে, আজকের মতো অনেক হলো – কাল বাকিটা দেখা যাবে।
মা ঘরে ঢোকেন। চোখ ফোলা ফোলা, মুখে কান্নার গন্ধ। “মা গো, তুমি কাঁদছো কেন? সোনালীর অসুখ করেছে বুঝি?” অবাক তুতুল প্রশ্ন করে। সোনালী ওর ছোট বোন, মাসীমণির মেয়ে।
ঠোঁট কামড়ান মা। “কই সোনা, কাঁদিনি তো, কিচ্ছু হয়নি তো!” তিনি তুতুলকে বুকের কাছে টেনে আনেন। লজ্জা পায় তুতুল। আবদারের সুরে বলে, “একটা গল্প বলো না, মা।”
“গল্প? বেশ – কিন্তু ঘুমোবে তাহলে?”
“সত্যি বলছি মা, তোমার পাশে শুয়ে ঘুমোব।” তুতুল আলগোছে মা’র আঁচল চেপে ধরে।
“এক দেশে এক রাজা ছিলো। সে ছিলো ভীষণ দুষ্টু –”
“মা, রাজারা খালি দুষ্টুই হয়, তাই না? আমার বন্ধু রাজা কিন্তু একটুও দুষ্টুমি করে না।” বাধা দিয়ে বলে তুতুল।
“তাই বুঝি? তা, এই রাজাটার দুষ্টুমিতে কিন্তু দেশের লোকের প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো। কেউ হয়তো ইয়া বড়ো এক কুমড়ো ফলিয়েছে, রাজা অমনি এসে হাজির। ‘দিস্ তো পাঠিয়ে – রানি কুমড়োর ছক্কা বানিয়ে দেবে, খাবো’, বলে হুকুম ঝেড়ে চলে যেতো। কুমোর মাটির গামলা বানিয়েছে, ‘আরে, আমার গরুকে খাওয়াতে লাগবে’, বলে ট্যাঁকে করে হাওয়া। কারো গাছে হয়তো কলা ধরেছে, ‘ইস, হাতি বেচারা আমার না খেয়ে মরছে’, বলে নিমেষে ঝাড়কে ঝাড় সাফ!
“তবু মানুষ কষ্টেসৃষ্টে দিন কাটাচ্ছিলো। কিন্তু সেবার হলো ভীষণ জলের কষ্ট। প্রচণ্ড গরমে নদী-নালা শুকিয়ে গেলো। তেষ্টায় মানুষের বুকের ছাতি ফাটতে লাগলো। সবাই তখন দল বেঁধে রাজার কাছে গেলো।
“মহারাজ, তেষ্টায় যে মরে গেলাম!” কেঁদেকেটে বলে তারা।
“রাজা এর মধ্যেই পুকুর, কুয়োর যা জল ছিলো তুলে এনে জমিয়েছে প্রাসাদের সব বিরাট বিরাট স্ফটিকের চৌবাচ্চায়। তাই সে চোখ ঘুরিয়ে বললো, ‘যা যা, জল নেই তো আমি কী করবো?’
“মহারাজ, কয়েকটি গভীর দীঘি কাটান – তবে জলকষ্ট ঘুচবে”, বলে এক বুড়ো প্রজা।
“ফুঃ, দীঘি কাটাবে! আমার সোনার পিকদানিটা ভেঙে গেছে, তাই সারাবার পয়সাই জুটছে না, আর ওনাদের যতসব উটকো আবদার!” রেগেমেগে বলে রাজা।
“সুজন নামে এক চাষীর ছেলে ছিলো। সে তখন এগিয়ে এসে বললো, ‘বেশ মহারাজ, তাহলে আমরা নিজেরাই শাবল, কুড়ুল, কোদাল যা পাই তাই দিয়ে দীঘি খুঁড়বো।’
“মুখের ওপর চ্যাটাং চ্যাটাং কথা শুনে রাজার মেজাজ গেলো গরম হয়ে। ‘যা, তাহলে মর গে!’ বলে সে গটমটিয়ে উঠে চলে গেলো।
“লোকজন সবাই কিন্তু সত্যি সত্যিই হৈ-হৈ করে কাজে নেমে পড়লো। কয়েক দিনের মধ্যেই তারা খুঁড়ে ফেললো এক বিরাট দীঘি, তাতে ভরা টলটলে নীল জল।
“সবার মুখে খুশির হাসি। কিন্তু দেখতে না দেখতে তা মিলিয়ে গেলো – যখন লোকলস্কর নিয়ে রাজা এসে সেখানে হাজির হলো।
“অ্যাই ভাগ, ভাগ! আমি রাজা, এই জল আমার।” বলে সব্বাইকে হঠিয়ে দিলো সে। হাতি নামিয়ে দিলো জলে। তীরে বসালো পাহারা। মুখ চূণ করে ফিরে গেলো প্রজারা।
“কাণ্ড দেখে মাটির ভীষণ রাগ হলো। রাজার দুষ্টুমির সাজা দেবার জন্য সে রাতারাতি দীঘির সব জল লুকিয়ে ফেললো। পরদিন সকালে রাজা এসে দেখে – ও মা, সব যে আবার শুকিয়ে খটখট! অনেক তর্জন-গর্জন করলো সে, কিন্তু করেই বা কী ফল!
“দেশের লোক ওদিকে তেষ্টায় শুকিয়ে কাঠ। কত ছোট্ট সোনা ঠোঁট চাটতে লাগলো, কত দাদু-ঠাকুমা মরেই গেলো – তবু না হলো একছিটে বৃষ্টি, না পেলো কেউ একফোঁটা জল।”
তুতুলের চোখ ছলছল। তাই দেখে মা গল্পের গতি বাড়িয়ে দেন,
“এমন সময় একদিন এক বুড়ো এলো সেই দেশে। লাঠিতে ভর দিয়ে চলছে, শনের নুড়ির মতো চুল ফুরফুর করে হাওয়ায় উড়ছে।
“আমায় কিছু খেতে দেবে গো?” এক চাষীর দোরে এসে হাঁক পাড়ে সে।
“খেতে হয়তো কষ্টেছিষ্টে দিতে পারি, কিন্তু জল মিলবে না।” কান্না-কান্না মুখ করে বলে চাষী।
“ও, তাই বুঝি!” গম্ভীর চালে মাথা নাড়ে বুড়ো। খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিয়ে তার গায়ে একটু জোর ফিরে এলো। তখন সে ধীরে ধীরে বললো, “শুনেছি, জীয়ন ঝর্ণার জল আছে রামধনুর দেশে। আকাশের ঐ পারে যেখানে রামধনুটা মাটিতে গিয়ে মেশে, সেখানে ঝরঝরিয়ে ঝরে পড়ছে এক মিষ্টি জলের ঝর্ণা। সেই জল এক বোতল যদি কেউ নিয়ে আসতে পারে, তবে তা ছিটিয়ে দিলে মরা মানুষ সব আবার বেঁচে উঠবে, শুকনো খাল-বিলও ভরে উঠবে জলে।
“তবে এ কাজে ঝামেলাও যে নেই, বলবো না। এক বিরাট দৈত্য আছে নাকি সে দেশে। সারা দিনরাত সে ঝর্ণা পাহারা দেয়। তার ভয়ে কেউ ওমুখো হয় না।”
“মা, রাজকন্যার গল্প নয় কিন্তু! ওসব সোনালীর মতো বাচ্চারা শোনে।” তুতুল বীরত্বব্যঞ্জক ভঙ্গীতে বলে।
মায়ের মুখ এক সুন্দর হাসিতে ভরে যায়। “ও, তাই নাকি – বুঝতেই পারিনি আমাদের তুতুলবাবু কত বড় হয়ে গেছে!” বলে তিনি আবার শুরু করেন,
“তাই শুনে এগিয়ে আসে চাষীর ছেলে সুজন। টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে সে বলে, ‘দাদু, কেউ না যায় আমি যাবো সেই জল আনতে। তুমি শুধু বলে দাও সেখানে যেতে হলে কী কী করতে হবে।’
“বুড়োর মুখ খুশিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সুজনের পিঠ চাপড়ে বলে, ‘তোমার মতো সাহসী ছেলেই পারবে সে জল আনতে। তবে কয়েকটা কথা মনে রাখবে।
‘প্রথম কথা – দৈত্যকে মারতে তলোয়ার চাই। আজই কামারভাইকে দিয়ে বানিয়ে নাও এক ধারালো তলোয়ার।
‘দ্বিতীয় কথা – যখন পথ চলবে, চোখকান খোলা রাখবে। অসহায় জীবের প্রতি দয়াধর্ম করবে।
‘আর শেষ কথা – এই জীয়ন ঝর্ণার জল অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে, মরা মানুষকে প্রাণ দেয়। কিন্তু হুঁশিয়ার – কোনো মানুষ যদি দুষ্টু হয়, লোক ঠকিয়ে খায়, তবে এই জল তার গায়ে ছিটিয়ে দিলে সে উলটে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।’
“মা, আমি আর চিনি চুরি করে খাবো না।” তুতুল মা’কে আঁকড়ে ধরে।
“ওমা, তুতুল তো আমার লক্ষ্মী সোনা – সে আবার দুষ্টু হলো কবে!” তুতুলকে একটা চুমো দিয়ে মা আবার গল্প শুরু করলেন,
“তারপর বুড়ো তো লাঠি ঠুকঠুক করতে করতে চলে গেলো। আর কোমরে তলোয়ার ঝুলিয়ে সুজন তৈরি হলো রামধনুর দেশে যাবার জন্যে।
“রাজার চর কিন্তু খবরটা রাজার কানে তুলে দিলো। আর যায় কোথায় – সেপাই এসে সুজনকে ধরে বেঁধে নিয়ে গেলো রাজার কাছে।
“কিরে, আমায় না জানিয়ে পালাচ্ছিস যে বড়ো?” রাজা তর্জন করে। কী আর বলবে, সুজন চুপ করেই থাকে।
“যাক, এবারের মতো ছেড়ে দিলাম। কিন্তু আসার সময় আমার জন্য সেখান থেকে সোনার ফুল, হীরের পাখি আর মণি-মানিকের গাছ নিয়ে আসবি। নইলে তোর ঘাড়ে মাথা থাকবে না।”
“রাজার কথা শুনে সুজন কাঁচুমাচু মুখে ঘাড় নাড়ে। তারপর গুটিগুটি পায়ে ফিরে আসে।
“কিন্তু রামধনুর দেশের রাস্তা খুঁজে পাওয়া কি সোজা কথা! এক বছরের ওপর বৃষ্টি হয় না, লোকে শেষ কবে রামধনু দেখেছে তাও ভুলে গেছে। তবু ভেবেচিন্তে একটা দিক ঠিক করে এগোয় সুজন। চলতে চলতে নাহয় একে-ওকে জিজ্ঞেস করে পথ চিনে নেওয়া যাবে।
“চলেছে তো চলেছে, হঠাৎ এক জায়গায় দেখে মহা শোরগোল। ‘আমাকে বাঁচাও’ বলে একটা বাঁদর ছুটে এসে সুজনের পায়ে পড়ে। পেছনে লাঠি নিয়ে ধেয়ে আসছে একদল লোক।
“আমাদের ফলের বাগান আস্ত রাখে না, আজ মেরেই ফেলবো ওকে”, বলে তারা।
“কী করবো, খিদে পায় যে!” কিচ কিচ করে বলে বাঁদর।
“আচ্ছা, ও আর বাগান নষ্ট করবে না। আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি”, বলে সুজন। বেশ তো – রাজি হয় সবাই।
“প্রাণ বাঁচিয়ে তুমি আমার প্রাণের বন্ধু হলে। কোথায় চলেছো, ভাই?” জিজ্ঞেস করে বাঁদর।
“চলেছি রামধনুর দেশে, জীয়ন ঝর্ণার জল আনতে। চেনো নাকি রাস্তা?”
“ও বাবা, সেখানে তো বিরাট দৈত্য থাকে। তা, কিছুদূর অবধি চিনি। আর বন্ধু যখন বলেছি তখন চিনিয়ে নিয়েও যাবো”, বলে বাঁদর।
আবার চলেছে, চলেছে, এবার বাঁদরও আর রাস্তা চিনতে পারছে না। এমন সময় শোনে ঝোপের পাশে মিঁউ মিঁউ কান্না। ভালো করে খুঁজেপেতে দেখে, এক থলের মধ্যে বাঁধা এক সুন্দর সাদা বেড়াল।
“তেষ্টায় দুধ চুরি করে খেয়েছিলাম দেখে আমাকে এভাবে ফেলে রেখে গেছে”, কাঁদতে কাঁদতে বলে বেড়াল।
“ইস, বেচারা! এক্কেবারে হাড় জিরজিরে হয়ে গেছে!” থলের বাঁধন খুলতে খুলতে বলে সুজন।
“প্রাণ বাঁচিয়ে আমার প্রাণের বন্ধু হলে। কিন্তু চলেছো কোথায়?” জিজ্ঞেস করে বেড়াল।
“চলেছি রামধনুর দেশে, জীয়ন ঝর্ণার জল আনতে। চেনো নাকি রাস্তা?”
“বাপ রে, দৈত্যের দেশে! তা, বন্ধু বলে যখন ডেকেছি – চলো, যদ্দুর চিনি দেখিয়ে দিই।”
“চলছে তো চলছেই তিন বন্ধু। কত বনবাদার, মাঠঘাট পেরিয়ে গেলো। এবার বেড়ালও আর পথ চেনে না। এমন সময় সামনে পড়লো ছোট্ট মিষ্টি জলের এক খাল। চকচক করে জল খেলো সবাই। খিদে-তেষ্টা দুই-ই যেন তখনকার মতো দূর হলো।
“বাঁচাও, বাঁচাও!” চিঁ-চিঁ করে চ্যাঁচায় কে? দেখাই তো যায় না! ও মা, স্রোতে ভেসে যাচ্ছে এক মৌমাছি। দৌড়ে গিয়ে একটা গাছের পাতা এনে ধরে সুজন, তাই আঁকড়ে কোনমতে উঠে আসে মৌমাছি।
“প্রাণ বাঁচিয়ে প্রাণের বন্ধু হলে। কিন্তু কে গো তুমি? চলেছো কোথায়?” বলে মৌমাছি।
“তিন বন্ধু চলেছি রামধনুর দেশে, জীয়ন ঝর্ণার জল আনতে। চেনো নাকি রাস্তা?”
“ওমা, চিনবো না! রামধনুর দেশেই তো আমার বাড়ি। দুষ্টুমি করে বাবা-মা’র কথা না শুনে অ্যাদ্দুর উড়ে এসেছিলাম, তারপর দম ফুরিয়ে এই অবস্থা। কিন্তু বুকের পাটা আছে তো তোমাদের! দৈত্যের কাছ থেকে চলেছো জীয়ন ঝর্ণার জল আনতে?”
“আনতে না পারি, প্রাণ তো দিতে পারবো”, বলে সুজন। তিন বন্ধু চলতে থাকে, আর তাদের মাথার ওপর উড়ে উড়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে মৌমাছি বন্ধু।
“কত পাহাড় পেরিয়ে, নদী-নালা ডিঙিয়ে এগিয়ে চলে তারা। চলে, চলে, চলে, পথ আর ফুরোয় না। শেষ পর্যন্ত একদিন এক ঘন জঙ্গল ভেঙে বেরিয়ে এসে তাদের চোখ ধাঁধিয়ে যায়।
“এক ঝলমলে আলোর দেশ তাদের সামনে। আকাশ সুন্দর সাতটা রঙে উজ্জ্বল হয়ে আছে। দূরে ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আনন্দে খেলা করে বেড়াচ্ছে। আর কী সব অপূর্ব পাতাবাহারী গাছে, রঙবাহারী ফুলে ভরে আছে চারদিক – কোথায় লাগে তার কাছে সোনা, হীরে, মানিকের ছটা! এক মিষ্টি গানের সুরে ভরে উঠছে বাতাস। দূরে দেখা যায় এক বিরাট পাহাড়, সবুজে সবুজে ছেয়ে আছে তার গা। আর সেখান থেকে ঝির ঝির ঝরে পড়ছে এক ঝর্ণা – জীয়ন ঝর্ণা!
“সবাই সেদিকে চেয়ে আছে, কারো মুখে কথা জোগায় না। শেষ অবধি সুজনই বলে, ‘তাহলে মৌমাছি বন্ধু, তুমি বাড়ি ফিরে যাও। বাঁদর আর বেড়াল বন্ধু, তোমরা এখানে একটু বসো। আমি যাচ্ছি ঝর্ণার দিকে। যদি আর না ফিরি, আমার জন্যে দুঃখ করো না। পারো তো গাঁয়ে গিয়ে সবাইকে জানিয়ে দিও – সুজন শেষ অবধি জীয়ন ঝর্ণার জল আনতে পারেনি বটে, কিন্তু চেষ্টার কসুর করেনি।
“কী আর করে, চোখের জল ফেলে সবাই সুজনকে বিদায় জানায়। ‘বিপদ হলে মনে মনে আমায় ডেকো’, বলে বাড়ির দিকে উড়ে যায় মৌমাছি।
“বুকভরা সাহস নিয়ে এগিয়ে চলে সুজন। গাছের পাতারা বলে, আমাদের ধরো। ছোট শিশুরা বলে, আমাদের কোলে নাও। রঙীন আকাশ থেকে কে যেন বলে ওঠে – ওগো, দু’দণ্ড থেমে আমাদের গান শুনে যাও। কিন্তু কোনোদিকে না তাকিয়ে সুজন সটান এগিয়ে চলে জীয়ন ঝর্ণার দিকে।
“ও মা – কোথায় রঙ, কোথায় শিশু, কোথায় গান – সব মুহূর্তে ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেলো। তালগাছের মত বড় এক দৈত্য যেন আকাশ ফুঁড়ে এসে হাজির। সুজনকে দেখে তার ভাটার মত চোখ রাগে ঘুরতে থাকে।
“দুধের বাচ্চা, সাধ করে মরণের মুখে পা বাড়িয়েছিস। ভালোয় ভালোয় প্রাণটা নিয়ে এখনো ফিরে যা”, বাজের মত হেঁকে বলে দৈত্য।
“হয় জল নেবো, নয় প্রাণ দেবো।” তলোয়ার খুলে সোজা হয়ে দাঁড়ায় সুজন। ঝড়ের বেগে এসে দৈত্য ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর।
“বীরের মত লড়ে সুজন – কিন্তু ঐ ধুমসো দৈত্যের সঙ্গে পারবে কেন! কিছুক্ষণের মধ্যেই দৈত্য তাকে কেটে টুকরো টুকরো করে রেখে হাসতে হাসতে চলে যায়।”
তুতুলের ঠোঁট কাঁপে, গলার শুকনো ডেলাটা আর ভেতরে থাকতে চায় না। কিন্তু অ্যাদ্দিনে কি আর ওর মা’কে চিনতে বাকি আছে! তাই চুপচাপ আবার শুনতে থাকে –
“সারারাত ধরে সেখানে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে দুই বন্ধু বাঁদর আর বেড়াল। তারপর একসময় ভোর হয়। লাল টুকটুকে সুয্যিমামা যাবার পথে এই দৃশ্য দেখে থমকে থেমে যান। তাঁর মন কেঁদে ওঠে। কী করেন, কী করেন – শেষে এক ফুঁয়ে জীয়ন ঝর্ণার খানিকটা জল আকাশে উড়িয়ে দিয়ে মেঘ করলেন। একটু পর ঝমঝম বৃষ্টি হয়ে সেই মেঘ জল ঢাললো সুজনের গায়ে।
“ঊঃ, বড্ড ঘুমিয়েছি!” আড়মোড়া ভেঙে উঠে বলে সুজন। জলের ছোঁয়ায় তার শরীর আগের চেয়ে বড় হয়েছে, শক্তিও হয়েছে আগের চেয়ে বেশি।
“হ্যাঁ, দিব্যি ঘুম মেরেছো, বন্ধু!” মুখ টিপে হাসে বাঁদর-বেড়াল, খুলে আর কিছু বলে না।
“খবর পেয়ে আবার ধেয়ে আসে দৈত্য। দাঁত কড়মড় করতে করতে বলে, “মানুষের বাচ্চা, এবার দেখি তুই কী করে বেঁচে উঠিস।” সে যা ভয়ানক লড়াই হয়! দৈত্যের একটা হাতও কাটা যায়। কিন্তু হলে হবে কী, দৈত্য আবার সুজনকে মেরে ফ্যালে। তারপর সে সুজনের শরীরটা ভালো করে মাটিতে পুঁতে রেখে জীয়ন ঝর্ণার দিকে এগোয়। সেখানে গিয়ে ঝর্ণার খানিকটা জল লাগিয়ে কাটা হাত আবার জুড়ে নেয়।”
“আচ্ছা মা, দৈত্য তো দুষ্টু। তবে জীয়ন ঝর্ণার জল লেগে ছাই হয়ে গেলো না কেন?” – তুতুলকে ফাঁকি দেওয়া কি অত সোজা!
এই রে! অলক্ষ্যে জিভ কাটেন মা। তারপর ভেবেচিন্তে বলেন, “দৈত্য কি মানুষ? দুষ্টু মানুষ তো ছাই হয়ে যাবে, তাই বললো না বুড়ো?”
“বুঝতে পেরেছি, এবার বলো তারপর কী হলো।” তুতুল আবার গুটিসুটি মেরে বসে।
“কী হবে, কী হবে – দুই বন্ধুর তো মাথায় হাত! কাল সকালে এসে সুয্যিমামা যে সুজনকে খুঁজে পাবেন না! কী করে তাকে বাঁচাবেন তবে?
“দাঁড়াও, আমি দেখি চেষ্টা করে।” বলে বেড়াল। তারপর সে নখ দিয়ে আঁচড়ে আঁচড়ে মাটি খুঁড়তে থাকে। খুঁড়ছে তো খুঁড়ছেই, মাটি তুলছে তো তুলছেই, শরীর আর চলে না! ভোর প্রায় হয়ে আসে। এমন সময় শেষ অবধি তার নখে ঠেকে সুজনের শরীর। চটপট আঁচড়ে-পাঁচড়ে তার ওপরের মাটিটুকু সরিয়ে দেহটা খোলা জায়গায় টেনে আনে দুই বন্ধু।
“সকালবেলা সুয্যিমামা আবার বাঁচিয়ে দিলেন সুজনকে। আরো বড় হয়ে গেলো সুজন, গায়ে হলো আরো জোর। আবার ধেয়ে এলো দত্যি।
“আরো জোরদার লড়াই হলো এবার। দৈত্যের একটা পা গেলো উড়ে। কিন্তু এবারও শেষ অবধি তারই হলো জয়। সুজনকে মেরে ফেলে সে এবার দেহটা একটা কাপড়ের পুঁটলিতে পাকিয়ে রেখে দিয়ে এলো এক্কেবারে উঁচু সেই পাহাড়ের মাথায়, গাছপালার আড়ালে। “দেখি এবার শেয়ালে-কুকুরে কী করে তোর দেহ খুঁড়ে তোলে!” হা-হা করে হেসে বলে দৈত্য। তারপর ঝর্ণার জলে পা-টা জুড়ে আবার ঠিক আগের মতন।
“রাত্তির হতেই বাঁদর হুপহাপ গাছে গাছে লাফিয়ে চলে। পাহাড়ের মাথা – সে কি এখানে! তবু হাল ছাড়ে না বাঁদর। শেষ অবধি সুয্যিমামা যখন উঠি-উঠি করছেন, সে খুঁজে পেলো সুজনের শরীর। পুঁটলি খুলে দেহটা বের করে ফেলে রাখলো খোলামেলা জায়গায়।
“এবার বেঁচে উঠে আরো বড় হয়েছে সুজন। আবার আসে দৈত্য। সে যা একখান লড়াই হয়, সবার অনেকদিন মনে থাকবে। এবারেও জেতে দৈত্য। তবে সে টলছে, ভালো করে চলতে পারছে না। তার সারা শরীর বেয়ে রক্ত ঝরছে।
“দেখি, এবার কোন পশু-পাখি তোকে বাঁচায়!” বলে সে ঝর্ণার পাশে নিয়ে যায় সুজনের শরীরটা। তারপর তাকে আড়াল করে নিজে সটান শুয়ে পড়ে।
“বাঁদর-বেড়ালের তো মাথায় হাত! ঐ পাহাড়ের মত দেহের আড়ালে কী করে সুয্যিমামার চোখ পৌঁছোবে! তাহলে কি আর সুজন বাঁচবে না? চোখের জলে ভাসে তারা। শেষে কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে আকূল হয়ে মৌমাছি বন্ধুকে স্মরণ করে।
“এসে গেছি, বন্ধু!” গুনগুন করতে করতে ছুটে আসে মৌমাছি। বেড়াল, বাঁদর সব খুলে বলে তাকে। “হুঁ, এই ব্যাপার! দাঁড়াও, পাজি দৈত্যের জারিজুরি বন্ধ করছি”, বলে উড়ে ফিরে যায় মৌমাছি।
“ভোর হবো হবো করছে। মজাসে ঘুমোচ্ছে দৈত্য। এমন সময় লাখ লাখ মৌমাছির এক ঝাঁক তাকে আক্রমণ করে। কামড়ের পর কামড়, কামড়ের পর কামড় – হুলের জ্বালায় দৈত্য অস্থির হয়ে ওঠে। শেষ অবধি আর থাকতে না পেরে উঠে জঙ্গলের দিকে দৌড় লাগায়।
“সুয্যিমামা তখন উঠে পড়েছেন। তাঁকে দেখে আনন্দে নাচতে থাকে জীয়ন ঝর্ণা। আর তার একটা বড়সড় জলের ঝাপটা এসে আবার সুজনকে জাগিয়ে তোলে। বাড়তে বাড়তে এতদিনে দৈত্যের প্রায় সমান হয়ে উঠেছে সুজন। শক্ত হাতে তলোয়ার ধরে এবার সে শেষ লড়াইয়ের জন্য তৈরি হয়।
“দৈত্য আসে। তারপর চলে সেই লড়াই যা আগে কেউ কখনো দেখেনি, পরেও কখনো দেখবে না। তিনদিন, তিনরাত সমানে যুদ্ধ চলে। দেখেশুনে সুয্যিমামাও যেন পূব আকাশে উঁকি মারতে ভয় পান। তারপর একসময় সুজনের তলোয়ারের কোপে দৈত্যের মাথাটা ছিটকে যায়।
“বনজঙ্গল ভেঙে হুড়মুড় করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে দৈত্যের পেল্লায় লাশ। তারপর আর কী? নিশ্চিন্তে ঝর্ণার জল ভরে নেয় সুজন। হঠাৎ দেখে, আলোয় আলো হয়ে উঠেছে চারদিক। আবাক হয়ে সবাই ওপরে তাকায় – দেখে, আকাশ জুড়ে আবার দেখা দিয়েছে এক সাতরঙা রামধনু।
“গাঁয়ে ফিরে চলে সুজন। ‘চলো, তোমায় পৌঁছে দিয়ে আসি।’ সাথে সাথে চলে তিন বন্ধু।
“খবর পেয়ে ছুটতে ছুটতে আসে রাজা। ‘দাঁড়াও, একটু মজা করা যাক’, বুদ্ধি-পরামর্শ করে তিন বন্ধু। তারপর মৌমাছি সাজে সোনার ফুল, বেড়াল হীরের পাখি আর বাঁদর মণি-মানিকের গাছ।
“কী রে, এনেছিস আমার জিনিস – আরে, ঐ তো!” লোভে রাজার চোখ জ্বলে ওঠে। সব কিছু ভুলে সে তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায়। আর তখন সুজন তার গায়ে ছিটিয়ে দেয় জীয়ন ঝর্ণার জল। মুহূর্তে পুড়ে ছাই হয়ে যায় দুষ্টু রাজা।
“তারপর আর কী! সারা রাজ্যে নদী-নালা-পুকুর-মাঠে জীয়ন ঝর্ণার জল ছিটিয়ে দেয় সুজন। বেঁচে ওঠে শুকিয়ে মরে যাওয়া যত মানুষ। আর তারপর আকাশ কাঁপিয়ে নামে তুমুল বৃষ্টি। নদী-নালা-খাল-বিল-পুকুর সব জলে থৈ-থৈ করতে থাকে। সবুজ সবুজ গাছপালায় চারদিক ছেয়ে যায়। ধানে মাঠ ভরে ওঠে।”
বড় আনন্দ! এতক্ষণের চেপে রাখা কষ্টটা এবার একটু একটু করে গলে বেরিয়ে আসে। দু’চোখ ঝাপসা হয়ে যায় তুতুলের। ভেজা চোখের পাতায় সে দূর আকাশের রামধনু দেখে।
“মা, বড় হয়ে আমি জীয়ন ঝর্ণার জল আনতে যাবো।” ফিসফিসিয়ে বলে তুতুল।
“যেও, সোনা।” হঠাৎ বালিশে মুখ লুকিয়ে ফ্যালেন মা। তুতুল তাঁর কোল ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে মায়ের চুল থেকে। জড়িয়ে ধরে নিশ্চিন্তে ঘুমোয় তুতুল। স্বপ্নে এক টুকরো ছোট্ট হাসি তার মুখে লেগে থাকে।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।