রানীহাটের জমিদার শারদাশংকরবাবুদের বাড়ির বিধবা বধূটির পিতৃকুলে কেহ ছিল না ; সকলেই একে একে মারা গিয়াছে । পতিকুলেও ঠিক আপনার বলিতে কেহ নাই , পতিও নাই পুত্রও নাই । একটি ভাশুরপো , শারদাশংকরের ছোটো ছেলেটি , সেই তাহার চক্ষের মণি । সে জন্মিবার পর তাহার মাতার বহুকাল ধরিয়া শক্ত পীড়া হইয়াছিল , সেইজন্য এই বিধবা কাকি কাদম্বিনীই তাহাকে মানুষ করিয়াছে । পরের ছেলে মানুষ করিলে তাহার প্রতি প্রাণের টান আরো যেন বেশি হয় , কারণ তাহার উপরে অধিকার থাকে না ; তাহার উপরে কোনো সামাজিক দাবি নাই , কেবল স্নেহের দাবি — কিন্তু কেবলমাত্র স্নেহ সমাজের সমক্ষে আপনার দাবি কোনো দলিল অনুসারে সপ্রমাণ করিতে পারে না এবং চাহেও না , কেবল অনিশ্চিত প্রাণের ধনটিকে দ্বিগুণ ব্যাকুলতার সহিত ভালোবাসে ।
বিধবার সমস্ত রুদ্ধ প্রীতি এই ছেলেটির প্রতি সিঞ্চন করিয়া একদিন শ্রাবণের রাত্রে কাদম্বিনীর অকস্মাৎ মৃত্যু হইল । হঠাৎ কী কারণে তাহার হৃৎস্পন্দন স্তব্ধ হইয়া গেল — সময় জগতের আর-সর্বত্রই চলিতে লাগিল , কেবল সেই স্নেহকাতর ক্ষুদ্র কোমল বক্ষটির ভিতর সময়ের ঘড়ির কল চিরকালের মতো বন্ধ হইয়া গেল ।
পাছে পুলিসের উপদ্রব ঘটে এইজন্য অধিক আড়ম্বর না করিয়া জমিদারের চারিজন ব্রাক্ষ্মণ কর্মচারী অনতিবিলম্বে মৃতদেহ দাহ করিতে লইয়া গেল ।
রানীহাটের শ্মশান লোকালয় হইতে বহুদূরে । পুষ্করিণীর ধারে একখানি কুটির এবং তাহার নিকটে একটা প্রকাণ্ড বটগাছ , বৃহৎ মাঠে আর-কোথাও কিছু নাই । পূর্বে এইখান দিয়া নদী বহিত , এখন নদী একেবারে শুকাইয়া গেছে । সেই শুষ্ক জলপথের এক অংশ খনন করিয়া শ্মশানের পুষ্করিণী নির্মিত হইয়াছে । এখনকার লোকেরা এই পূষ্করিণীকে পূর্ণ স্রোতস্বিনীর প্রতিনিধিস্বরূপ জ্ঞান করে ।
মৃতদেহ কুটিরের মধ্যে স্থাপন করিয়া চিতার কাঠ আসিবার প্রতীক্ষায় চারজনে বসিয়া রহিল । সময় এত দীর্ঘ বোধ হইতে লাগিল যে অধীর হইয়া চারিজনের মধ্যে নিতাই এবং গুরুচরণ কাঠ আনিতে এত বিলম্ব হইতেছে কেন দেখিতে গেল , বিধু এবং বনমালী মৃতদেহ রক্ষা করিয়া বসিয়া রহিল ।
শ্রাবণের অন্ধকার রাত্রি । থম্থমে মেঘ করিয়া আছে , আকাশে একটি তারা দেখা যায় না ; অন্ধকার ঘরে দুইজনে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল । একজনের চাদরে দিয়াশলাই এবং বাতি বাঁধা ছিল । বর্ষাকালের দিয়াশলাই বহু চেষ্টাতেও জ্বলিল না — যে লণ্ঠন সঙ্গে ছিল তাহাও নিবিয়া গেছে ।
অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া একজন কহিল , “ ভাই রে , এক ছিলিম তামাকের জোগাড় থাকিলে বড়ো সুবিধা হইত । তাড়াতাড়িতে কিছুই আনা হয় নাই । ”
অন্য ব্যক্তি কহিল , “ আমি চট্ করিয়া এক দৌড়ে সমস্ত সংগ্রহ করিয়া আনিতে পারি । ”
বনমালীর পলায়নের অভিপ্রায় বুঝিয়া বিধু কহিল , “ মাইরি! আর , আমি বুঝি এখানে একলা বসিয়া থাকিব । ”
আবার কথাবার্তা বন্ধ হইয়া গেল । পাঁচ মিনিটকে এক ঘন্টা বলিয়া মনে হইতে লাগিল । যাহারা কাঠ আনিতে গিয়াছিল তাহাদিগকে মনে মনে ইহারা গালি দিতে লাগিল — তাহারা যে দিব্য আরামে কোথাও বসিয়া গল্প করিতে করিতে তামাক খাইতেছে , এ সন্দেহ ক্রমশই তাহাদের মনে ঘনীভূত হইয়া উঠিতে লাগিল ।
কোথাও কিছু শব্দ নাই — কেবল পুষ্করিণীতীর হইতে অবিশ্রাম ঝিল্লি এবং ভেকের ডাক শুনা যাইতেছে । এমন সময়ে মনে হইল যেন খাটটা ঈষৎ নড়িল- যেন মৃতদেহ পাশ ফিরিয়া শুইল ।
বিধু এবং বনমালী রামনাম জপিতে জপিতে কাঁপিতে লাগিল । হঠাৎ ঘরের মধ্যে একটা দীর্ঘনিশ্বাস শুনা গেল । বিধু এবং বনমালী এক মুহূর্তে ঘর হইতে লম্ফ দিয়া বাহির হইয়া গ্রামের অভিমুখে দৌড় দিল ।
প্রায় ক্রোশ-দেড়েক পথ গিয়া দেখিল তাহাদের অবশিষ্ট দুই সঙ্গী লণ্ঠন হাতে ফিরিয়া আসিতেছে । তাহারা বাস্তবিকই তামাক খাইতে গিয়াছিল , কাঠের কোনো খবর জানে না , তথাপি সংবাদ দিল, গাছ কাটিয়া কাঠ ফাড়াইতেছে — অনতিবিলম্বে রওনা হইবে । তখন বিধু এবং বনমালী কুটিরের সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করিল । নিতাই এবং গুরুচরণ অবিশ্বাস করিয়া উড়াইয়া দিল , এবং কর্তব্য ত্যাগ করিয়া আসার জন্য অপর দুইজনের প্রতি অত্যন্ত রাগ করিয়া বিস্তর ভর্ৎসনা করিতে লাগিল ।
কালবিলম্ব না করিয়া চারজনেই শ্মশানে সেই কুটিরে গিয়া উপস্থিত হইল । ঘরে ঢুকিয়া দেখিল মৃতদেহ নাই , শূন্য খাট পড়িয়া আছে ।
পরস্পর মুখ চাহিয়া রহিল । যদি শৃগালে লইয়া গিয়া থাকে ? কিন্তু আচ্ছাদনবস্ত্রটি পর্যন্ত নাই । সন্ধান করিতে করিতে বাহিরে গিয়া দেখে কুটিরের দ্বারের কাছে খানিকটা কাদা জমিয়াছিল , তাহাতে স্ত্রীলোকের সদ্য এবং ক্ষুদ্র পদচিহ্ন ।
শারদাশংকর সহজ লোক নহেন , তাঁহাকে এই ভূতের গল্প বলিলে হঠাৎ যে কোনো শুভফল পাওয়া যাইবে এমন সম্ভাবনা নাই । তখন চারজনে বিস্তর পরামর্শ করিয়া স্থির করিল যে, দাহকার্য সমাধা হইয়াছে এইরূপ খবর দেওয়াই ভালো ।
ভোরের দিকে যাহারা কাঠ লইয়া আসিল তাহারা সংবাদ পাইল , বিলম্ব দেখিয়া পূর্বেই কার্য শেষ করা হইয়াছে , কুটিরের মধ্যে কাষ্ঠ সঞ্চিত ছিল । এ সম্বন্ধে কাহারো সহজে সন্দেহ উপস্থিত হইতে পারে না — কারণ , মৃতদেহ এমন-কিছু বহুমূল্য সম্পত্তি নহে যে কেহ ফাঁকি দিয়া চুরি করিয়া লইয়া যাইবে ।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।