জীবিত ও মৃত–পঞ্চম পরিচ্ছেদ– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কাদম্বিনী যে কেমন করিয়া রানীহাটে ফিরিয়া গেল , তাহা বলা কঠিন । কিন্তু প্রথমে কাহাকেও দেখা দিল না । সমস্ত দিন অনাহারে একটা ভাঙা পোড়ো মন্দিরে যাপন করিল ।

বর্ষার অকাল সন্ধ্যা যখন অত্যন্ত ঘন হইয়া আসিল এবং আসন্ন দুর্যোগের আশঙ্কায় গ্রামের লোকেরা ব্যস্ত হইয়া আপন আপন গৃহ আশ্রয় করিল তখন কাদম্বিনী পথে বাহির হইল । শ্বশুরবাড়ির দ্বারে গিয়া একবার তাহার হৃৎকম্প উপস্থিত হইয়াছিল কিন্তু মস্ত ঘোমটা টানিয়া যখন ভিতরে প্রবেশ করিল দাসীভ্রমে দ্বারীরা কোনোরূপ বাধা দিল না- এমন সময় বৃষ্টি খুব চাপিয়া আসিল , বাতাসও বেগে বহিতে লাগিল ।

তখন বাড়ির গৃহিণী শারদাশংকরের স্ত্রী তাঁহার বিধবা ননদের সহিত তাস খেলিতেছিলেন । ঝি ছিল রান্নাঘরে এবং পীড়িত খোকা জ্বরের উপশমে শয়নগৃহে বিছানায় ঘুমাইতেছিল । কাদম্বিনী সকলের চক্ষু এড়াইয়া সেই ঘরে গিয়া প্রবেশ করিল । সে যে কী ভাবিয়া শ্বশুরবাড়ি আসিয়াছিল জানি না , সে নিজেও জানে না , কেবল এইটুকু জানে যে একবার খোকাকে চক্ষে দেখিয়া যাইবার ইচ্ছা । তাহার পর কোথায় যাইবে , কী হইবে , সে কথা সে ভাবেও নাই ।

দীপালোকে দেখিল, রুগ্‌ণ শীর্ণ খোকা হাত মুঠা করিয়া ঘুমাইয়া আছে । দেখিয়া উত্তপ্ত হৃদয় যেন তৃষাতুর হইয়া উঠিল — তাহার সমস্ত বালাই লইয়া তাহাকে একবার বুকে চাপিয়া না ধরিলে কি বাঁচা যায় । আর , তাহার পর মনে পড়িল , ‘ আমি নাই , ইহাকে দেখিবার কে আছে । ইহার মা সঙ্গ ভালোবাসে , গল্প ভালোবাসে , খেলা ভালোবাসে , এতদিন আমার হাতে ভার দিয়াই সে নিশ্চিন্ত ছিল , কখনো তাহাকে ছেলে মানুষ করিবার কোনো দায় পোহাইতে হয় নাই । আজ ইহাকে কে তেমন করিয়া যত্ন করিবে । ‘

এমন সময় খোকা হঠাৎ পাশ ফিরিয়া অর্ধ নিদ্রিত অবস্থায় বলিয়া উঠিল , “ কাকিমা , জল দে । ” ‘ আ মরিয়া যাই! সোনা আমার , তোর কাকিমাকে এখনো ভুলিস নাই! ‘ তাড়াতাড়ি কুঁজা হইতে জল গড়াইয়া লইয়া খোকাকে বুকের উপর তুলিয়া কাদম্বিনী তাহাকে জলপান করাইল ।

যতক্ষণ ঘুমের ঘোর ছিল , চিরাভ্যাসমত কাকিমার হাত হইতে জল খাইতে খোকার কিছুই আশ্চর্যবোধ হইল না । অবশেষে কাদম্বিনী যখন বহুকালের আকাঙ্ক্ষা মিটাইয়া তাহার মুখচুম্বন করিয়া তাহাকে আবার শুয়াইয়া দিল , তখন তাহার ঘুম ভাঙিয়া গেল এবং কাকিমাকে জড়াইয়া ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিল , “ কাকিমা , তুই মরে গিয়েছিলি ? ”

কাকিমা কহিল , “ হাঁ, খোকা । ”

“ আবার তুই খোকার কাছে ফিরে এসেছিস! আর তুই মরে যাবি নে ? ”

ইহার উত্তর দিবার পূর্বেই একটা গোল বাধিল — ঝি এক-বাটি সাগু হাতে করিয়া ঘরে প্রবেশ করিয়াছিল , হঠাৎ বাটি ফেলিয়া ‘ মাগো ‘ বলিয়া আছাড় খাইয়া পড়িয়া গেল ।

চীৎকার শুনিয়া তাস ফেলিয়া গিন্নি ছুটিয়া আসিলেন , ঘরে ঢুকিতেই তিনি একেবারে কাঠের মতো হইয়া গেলেন , পলাইতেও পারিলেন না , মুখ দিয়া একটি কথাও সরিল না ।

এই-সকল ব্যাপার দেখিয়া খোকারও মনে ভয়ের সঞ্চার হইয়া উঠিল — সে কাঁদিয়া বলিয়া উঠিল , “ কাকিমা , তুই যা । ”

কাদম্বিনী অনেকদিন পরে আজ অনুভব করিয়াছে যে, সে মরে নাই — সেই পুরাতন ঘরদ্বার , সেই সমস্ত , সেই খোকা , সেই স্নেহ , তাহার পক্ষে সমান জীবন্তভাবেই আছে , মধ্যে কোনো বিচ্ছেদ কোনো ব্যবধান জন্মায় নাই । সইয়ের বাড়ি গিয়া অনুভব করিয়াছিল বাল্যকালের সে সই মরিয়া গিয়াছে; খোকার ঘরে আসিয়া বুঝিতে পারিল , খোকার কাকিমা তো একতিলও মরে নাই ।

ব্যাকুলভাবে কহিল , “ দিদি , তোমরা আমাকে দেখিয়া কেন ভয় পাইতেছ । এই দেখো , আমি তোমাদের সেই তেমনি আছি । ”

গিন্নি আর দাঁড়াইয়া থাকিতে পারিলেন না , মূর্ছিত হইয়া পড়িয়া গেলেন । ভগ্নীর কাছে সংবাদ পাইয়া শারদাশংকরবাবু স্বয়ং অন্তঃপুরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন; তিনি জোড়হস্তে কাদম্বিনীকে কহিলেন , “ ছোটোবউমা , এই কি তোমার উচিত হয় । সতীশ আমার বংশের একমাত্র ছেলে , উহার প্রতি তুমি কেন দৃষ্টি দিতেছ । আমরা কি তোমার পর । তুমি যাওয়ার পর হইতে ও প্রতিদিন শুকাইয়া যাইতেছে , উহার ব্যামো আর ছাড়ে না , দিনরাত কেবল ‘ কাকিমা ‘ ‘ কাকিমা ‘ করে । যখন সংসার হইতে বিদায় লইয়াছ তখন এ মায়াবন্ধন ছিঁড়িয়া যাও — আমরা তোমার যথোচিত সৎকার করিব । ”

তখন কাদম্বিনী আর সহিতে পারিল না; তীব্রকণ্ঠে বলিয়া উঠিল , “ ওগো , আমি মরি নাই গো , মরি নাই । আমি কেমন করিয়া তোমাদের বুঝাইব , আমি মরি নাই । এই দেখো , আমি বাঁচিয়া আছি । ”

বলিয়া কাঁসার বাটিটা ভূমি হইতে তুলিয়া কপালে আঘাত করিতে লাগিল , কপাল ফাটিয়া রক্ত বাহির হইতে লাগিল ।

তখন বলিল , “ এই দেখো , আমি বাঁচিয়া আছি । ”

শারদাশংকর মূর্তির মতো দাঁড়াইয়া রহিলেন; খোকা ভয়ে বাবাকে ডাকিতে লাগিল; দুই মূর্ছিতা রমণী মাটিতে পড়িয়া রহিল ।

তখন কাদম্বিনী ‘ ওগো আমি মরি নাই গো , মরি নাই গো , মরি নাই ‘ – বলিয়া চীৎকার করিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া, সিঁড়ি বাহিয়া নামিয়া অন্তঃপুরের পুষ্করিণীর জলের মধ্যে গিয়া পড়িল । শারদাশংকর উপরের ঘর হইতে শুনিতে পাইলেন ঝপাস্‌ করিয়া একটা শব্দ হইল ।

সমস্ত রাত্রি বৃষ্টি পড়িতে লাগিল; তাহার পরদিন সকালেও বৃষ্টি পড়িতেছে, মধ্যাহ্নেও বৃষ্টির বিরাম নাই । কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল , সে মরে নাই ।

গল্পের প্রথম পরিচ্ছেদ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!