কাপড়ে কাদা মাখিয়া , অদ্ভুত ভাবের বশে ও রাত্রিজাগরণে পাগলের মতো হইয়া , কাদম্বিনীর যেরূপ চেহারা হইয়াছিল তাহাতে মানুষ তাহাকে দেখিয়া ভয় পাইতে পারিত এবং ছেলেরা বোধ হয় দূরে পালাইয়া গিয়া তাহাকে ঢেলা মারিত । সৌভাগ্যক্রমে একটি পথিক ভদ্রলোক তাহাকে সর্বপ্রথমে এই অবস্থায় দেখিতে পায় ।
সে আসিয়া কহিল , “ মা , তোমাকে ভদ্রকুলবধূ বলিয়া বোধ হইতেছে , তুমি এ অবস্থায় একলা পথে কোথায় চলিয়াছ । ”
কাদম্বিনী প্রথমে কোনো উত্তর না দিয়া তাকাইয়া রহিল । হঠাৎ কিছুই ভাবিয়া পাইল না । সে যে সংসারের মধ্যে আছে , তাহাকে যে ভদ্রকুলবধূর মতো দেখাইতেছে , গ্রামের পথে পথিক তাহাকে যে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতেছে , এ-সমস্তই তাহার কাছে অভাবনীয় বলিয়া বোধ হইল ।
পথিক তাহাকে পুনশ্চ কহিল , “ চলো মা , আমি তোমাকে ঘরে পৌঁছাইয়া দিই — তোমার বাড়ি কোথায় আমাকে বলো।”
কাদম্বিনী চিন্তা করিতে লাগিল । শ্বশুরবাড়ি ফিরিবার কথা মনে স্থান দেওয়া যায় না , বাপের বাড়ি তো নাই — তখন ছেলেবেলার সইকে মনে পড়িল ।
সই যোগমায়ার সহিত যদিও ছেলেবেলা হইতেই বিচ্ছেদ তথাপি মাঝে মাঝে চিঠিপত্র চলে । এক-একসময় রীতিমত ভালোবাসার লড়াই চলিতে থাকে — কাদম্বিনী জানাইতে চাহে ভালোবাসা তাহার দিকেই প্রবল; যোগমায়া জানাইতে চাহে কাদম্বিনী তাহার ভালোবাসার যথোপযুক্ত প্রতিদান দেয় না । কোনো সুযোগে একবার উভয়ে মিলন হইতে পারিলে যে একদণ্ড কেহ কাহাকে চোখের আড়াল করিতে পারিবে না, এ বিষয়ে কোনো পক্ষেরই কোনো সন্দেহ ছিল না ।
কাদম্বিনী ভদ্রলোকটিকে কহিল , “ নিশিন্দাপুরে শ্রীপতিচরণবাবুর বাড়ি যাইব । ”
পথিক কলিকাতায় যাইতেছিলেন ; নিশিন্দাপুর যদিও নিকটবর্তী নহে তথাপি তাঁহার গম্য পথেই পড়ে । তিনি স্বয়ং বন্দোবস্ত করিয়া কাদম্বিনীকে শ্রীপতিচরণবাবুর বাড়ি পৌঁছাইয়া দিলেন ।
দুই সইয়ে মিলন হইল । প্রথমে চিনিতে একটু বিলম্ব হইয়াছিল , তার পরে বাল্যসাদৃশ্য উভয়ের চক্ষে ক্রমশই পরিষ্ফুট হইয়া উঠিল ।
যোগমায়া কহিল , “ ওমা , আমার কী ভাগ্য । তোমার যে দর্শন পাইব এমন তো আমার মনেই ছিল না । কিন্তু, ভাই , তুমি কী করিয়া আসিলে । তোমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা যে তোমাকে ছাড়িয়া দিল! ”
কাদম্বিনী চুপ করিয়া রহিল, অবশেষে কহিল , “ ভাই , শ্বশুরবাড়ির কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়ো না । আমাকে দাসীর মতো বাড়ির একপ্রান্তে স্থান দিয়ো , আমি তোমাদের কাজ করিয়া দিব । ”
যোগমায়া কহিল , “ ওমা , সে কী কথা । দাসীর মতো থাকিবে কেন । তুমি আমার সই , তুমি আমার —” ইত্যাদি ।
এমন সময় শ্রীপতি ঘরে প্রবেশ করিল । কাদম্বিনী খানিকক্ষণ তাহার মুখের দিকে তাকাইয়া ধীরে ধীরে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল — মাথায় কাপড় দেওয়া , বা কোনোরূপ সংকোচ বা সম্ভ্রমের লক্ষণ দেখা গেল না ।
পাছে তাহার সইয়ের বিরুদ্ধে শ্রীপতি কিছু মনে করে , এজন্য ব্যস্ত হইয়া যোগমায়া নানারূপে তাহাকে বুঝাইতে আরম্ভ করিল । কিন্তু, এতই অল্প বুঝাইতে হইল এবং শ্রীপতি এত সহজে যোগমায়ার সমস্ত প্রস্তাবে অনুমোদন করিল যে , যোগমায়া মনে মনে বিশেষ সন্তুষ্ট হইল না ।
কাদম্বিনী সইয়ের বাড়িতে আসিল , কিন্তু সইয়ের সঙ্গে মিশিতে পারিল না — মাঝে মৃত্যুর ব্যবধান । আত্মসম্বন্ধে সর্বদা একটা সন্দেহ এবং চেতনা থাকিলে পরের সঙ্গে মেলা যায় না- কাদম্বিনী যোগমায়ার মুখের দিকে চায় এবং কী যেন ভাবে — মনে করে , স্বামী এবং ঘরকন্না লইয়া ও যেন বহুদূরে আর-এক জগতে আছে । স্নেহ-মমতা এবং সমস্ত কর্তব্য লইয়া ও যেন পৃথিবীর লোক , আর আমি যেন শূন্য ছায়া । ও যেন অস্তিত্বের দেশে আর আমি যেন অনন্তের মধ্যে ।
যোগমায়ারও কেমন কেমন লাগিল , কিছুই বুঝিতে পারিল না । স্ত্রীলোক রহস্য সহ্য করিতে পারে না- কারণ অনিশ্চিতকে লইয়া কবিত্ব করা যায় , বীরত্ব করা যায় , পাণ্ডিত্য করা যায় , কিন্তু ঘরকন্না করা যায় না । এইজন্য স্ত্রীলোক যেটা বুঝিতে পারে না , হয় সেটার অস্তিত্ব বিলোপ করিয়া তাহার সহিত কোনো সম্পর্ক রাখে না , নয় তাহাকে স্বহস্তে নূতন মূর্তি দিয়া নিজের ব্যবহারযোগ্য একটি সামগ্রী গড়িয়া তোলে — যদি দুইয়ের কোনোটাই না পারে তবে তাহার উপর ভারি রাগ করিতে থাকে ।
কাদম্বিনী যতই দুর্বোধ হইয়া উঠিল, যোগমায়া তাহার উপর ততই রাগ করিতে লাগিল, ভাবিল , এ কী উপদ্রব স্কন্ধের উপর চাপিল ।
আবার আর-এক বিপদ । কাদম্বিনীর আপনাকে আপনি ভয় করে । সে নিজের কাছ হইতে নিজে কিছুতেই পলাইতে পারে না । যাহাদের ভূতের ভয় আছে তাহারা আপনার পশ্চাদ্দিককে ভয় করে — যেখানে দৃষ্টি রাখিতে পারে না সেইখানেই ভয় । কিন্তু , কাদম্বিনীর আপনার মধ্যেই সর্বাপেক্ষা বেশি ভয়- বাহিরে তার ভয় নাই ।
এইজন্য বিজন দ্বিপ্রহরে সে একা ঘরে এক-একদিন চীৎকার করিয়া উঠিত- এবং সন্ধ্যাবেলায় দীপালোকে আপনার ছায়া দেখিলে তাহার গা ছম্ছম্ করিতে থাকিত ।
তাহার এই ভয় দেখিয়া বাড়িসুদ্ধ লোকের মনে কেমন একটা ভয় জন্মিয়া গেল । চাকরদাসীরা এবং যোগমায়াও যখন-তখন যেখানে-সেখানে ভূত দেখিতে আরম্ভ করিল ।
একদিন এমন হইল , কাদম্বিনী অর্ধরাত্রে আপন শয়নগৃহ হইতে কাঁদিয়া বাহির হইয়া একেবারে যোগমায়ার গৃহদ্বারে আসিয়া কহিল , “ দিদি , দিদি , তোমার দুটি পায়ে পড়ি গো! আমায় একলা ফেলিয়া রাখিয়ো না । ”
যোগমায়ার যেমন ভয়ও পাইল তেমনি রাগও হইল । ইচ্ছা করিল তদ্দণ্ডেই কাদম্বিনীকে দূর করিয়া দেয় । দয়াপরবশ শ্রীপতি অনেক চেষ্টায় তাহাকে ঠাণ্ডা করিয়া পার্শ্ববর্তী গৃহে স্থান দিল ।
পরদিন অসময়ে অন্তঃপুরে শ্রীপতির তলব হইল । যোগমায়া তাহাকে অকস্মাৎ ভর্ৎসনা করিতে আরম্ভ করিল , “ হাঁ গা , তুমি কেমনধারা লোক। একজন মেয়েমানুষ আপন শ্বশুরঘর ছাড়িয়া তোমার ঘরে আসিয়া অধিষ্ঠান হইল , মাসখানেক হইয়া গেল তবু যাইবার নাম করে না , আর তোমার মুখে যে একটি আপত্তিমাত্র শুনি না! তোমার মনের ভাবটা কী বুঝাইয়া বলো দেখি । তোমরা পুরুষমানুষ এমনি জাতই বটে । ”
বাস্তবিক, সাধারণ স্ত্রীজাতির ‘ পরে পুরুষমানুষের একটা নির্বিচার পক্ষপাত আছে এবং সেজন্য স্ত্রীলোকেরাই তাহাদিগকে অধিক অপরাধী করে । নিঃসহায়া অথচ সুন্দরী কাদম্বিনীর প্রতি শ্রীপতির করুণা যে যথোচিত মাত্রার চেয়ে কিঞ্চিৎ অধিক ছিল তাহার বিরুদ্ধে তিনি যোগমায়ার গাত্রস্পর্শপূর্বক শপথ করিতে উদ্যত হইলেও তাঁহার ব্যবহারে তাহার প্রমাণ পাওয়া যাইত ।
তিনি মনে করিতেন , ‘ নিশ্চয়ই শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এই পুত্রহীনা বিধবার প্রতি অন্যায় অত্যাচার করিত , তাই নিতান্ত সহ্য করিতে না পারিয়া পলাইয়া কাদম্বিনী আমার আশ্রয় লইয়াছে । যখন ইহার বাপ মা কেহই নাই , তখন আমি ইহাকে কী করিয়া ত্যাগ করি । ‘ এই বলিয়া তিনি কোনোরূপ সন্ধান লইতে ক্ষান্ত ছিলেন এবং কাদম্বিনীকেও এই অপ্রীতিকর বিষয়ে প্রশ্ন করিয়া ব্যথিত করিতে তাঁহার প্রবৃত্তি হইত না ।
তখন তাঁহার স্ত্রী তাঁহার অসাড় কর্তব্যবুদ্ধিতে নানাপ্রকার আঘাত দিতে লাগিল । কাদম্বিনীর শ্বশুরবাড়িতে খবর দেওয়া যে তাঁহার গৃহের শান্তিরক্ষার পক্ষে একান্ত আবশ্যক , তাহা তিনি বেশ বুঝিতে পারিলেন । অবশেষে স্থির করিলেন , হঠাৎ চিঠি লিখিয়া বসিলে ভালো ফল না ‘ ও হইতে পারে , অতএব রানীহাটে তিনি নিজে গিয়া সন্ধান লইয়া যাহা কর্তব্য স্থির করিবেন ।
শ্রীপতি তো গেলেন , এদিকে যোগমায়া আসিয়া কাদম্বিনীকে কহিল , “ সই , এখানে তোমার আর থাকা ভালো দেখাইতেছে না । লোকে বলিবে কী । ”
কাদম্বিনী গম্ভীরভাবে যোগমায়ার মুখের দিকে তাকাইয়া কহিল , “ লোকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী । ”
যোগমায়া কথা শুনিয়া অবাক হইয়া গেল । কিঞ্চিৎ রাগিয়া কহিল , “ তোমার না থাকে , আমাদের তো আছে । আমরা পরের ঘরের বধূকে কী বলিয়া আটক করিয়া রাখিব । ”
কাদম্বিনী কহিল , “ আমার শ্বশুরঘর কোথায় । ”
যোগমায়া ভাবিল , ‘ আ মরণ! পোড়াকপালী বলে কী। ‘
কাদম্বিনী ধরে ধীরে কহিল , “ আমি কি তোমাদের কেহ । আমি কি এ পৃথিবীর । তোমরা হাসিতেছ , কাঁদিতেছ , ভালোবাসিতেছ , সবাই আপন আপন লইয়া আছ , আমি তো কেবল চাহিয়া আছি । তোমরা মানুষ , আর আমি ছায়া । বুঝিতে পারি না , ভগবান আমাকে তোমাদের এই সংসারের মাঝখানে কেন রাখিয়াছেন । তোমরাও ভয় কর পাছে তোমাদের হাসিখেলার মধ্যে আমি অমঙ্গল আনি — আমিও বুঝিয়া উঠিতে পারি না , তোমাদের সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক । কিন্তু, ঈশ্বর যখন আমাদের জন্য আর-কোনো স্থান গড়িয়া রাখেন নাই , তখন কাজে-কাজেই বন্ধন ছিঁড়িয়া যায় তবু তোমাদের কাছেই ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াই । ”
এমনি ভাবে চাহিয়া কথাগুলা বলিয়া গেল যে , যোগমায়া কেমন একরকম করিয়া মোটের উপর একটা কী বুঝিতে পারিল, কিন্তু আসল কথাটা বুঝিল না , জবাবও দিতে পারিল না । দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করিতেও পারিল না । অত্যন্ত ভারগ্রস্ত গম্ভীর ভাবে চলিয়া গেল ।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।