রাত্রি প্রায় যখন দশটা তখন শ্রীপতি রানীহাট হইতে ফিরিয়া আসিলেন । মুষলধারে বৃষ্টিতে পৃথিবী ভাসিয়া যাইতেছে । ক্রমাগতই তাহার ঝর্ ঝর্ শব্দে মনে হইতেছে , বৃষ্টির শেষ নাই , আজ রাত্রিরও শেষ নাই ।
যোগমায়া জিজ্ঞাসা করিলেন , “ কী হইল । ”
শ্রীপতি কহিলেন , “ সে অনেক কথা । পরে হইবে । ” বলিয়া কাপড় ছাড়িয়া আহার করিলেন এবং তামাক খাইয়া শুইতে গেলেন । ভাবটা অত্যন্ত চিন্তিত ।
যোগমায়া অনেক ক্ষণ কৌতূহল দমন করিয়া ছিলেন , শয্যায় প্রবেশ করিয়াই জিজ্ঞাসা করিলেন , “ কী শুনিলে, বলো । ”
শ্রীপতি কহিলেন , “ নিশ্চয় তুমি একটা ভুল করিয়াছ । ”
শুনিবামাত্র যোগমায়া মনে মনে ঈষৎ রাগ করিলেন । ভুল মেয়েরা কখনোই করে না; যদি-বা করে কোনো সুবুদ্ধি পুরুষের সেটা উল্লেখ করা কর্তব্য হয় না , নিজের ঘাড় পাতিয়া লওয়াই সুযুক্তি । যোগমায়া কিঞ্চিৎ উষ্ণভাবে কহিলেন , “ কিরকম শুনি । ”
শ্রীপতি কহিলেন , “ যে স্ত্রীলোকটিকে তোমার ঘরে স্থান দিয়াছ সে তোমার সই কাদম্বিনী নহে । ”
এমনতরো কথা শুনিলে সহজেই রাগ হইতে পারে — বিশেষত নিজের স্বামীর মুখে শুনিলে তো কথাই নাই । যোগমায়া কহিলেন , “ আমার সইকে আমি চিনি না , তোমার কাছ হইতে চিনিয়া লইতে হইবে — কী কথার শ্রী । ”
শ্রীপতি বুঝাইলেন, এস্থলে কথার শ্রী লইয়া কোনোরূপ তর্ক হইতেছে না , প্রমাণ দেখিতে হইবে । যোগমায়ার সই কাদম্বিনী যে মারা গিয়াছে তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই ।
যোগমায়া কহিলেন , “ ঐ শোনো। তুমি নিশ্চয় একটা গোল পাকাইয়া আসিয়াছ । কোথায় যাইতে কোথায় গিয়াছ , কী শুনিতে কী শুনিয়াছ তাহার ঠিক নাই । তোমাকে নিজে যাইতে কে বলিল , একখানা চিঠি লিখিয়া দিলেই সমস্ত পরিষ্কার হইত । ”
নিজের কর্মপটুতার প্রতি স্ত্রীর এইরূপ বিশ্বাসের অভাবে শ্রীপতি অত্যন্ত ক্ষুণ্ন হইয়া বিস্তারিতভাবে সমস্ত প্রমাণ প্রয়োগ করিতে লাগিলেন, কিন্তু কোনো ফল হইল না । উভয়পক্ষে হাঁ না করিতে করিতে রাত্রি দ্বিপ্রহর হইয়া গেল ।
যদিও কাদম্বিনীকে এই দণ্ডেই গৃহ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দেওয়া সম্বন্ধে স্বামী স্ত্রী কাহারো মতভেদ ছিল না , কারণ শ্রীপতির বিশ্বাস তাঁহার অতিথি ছদ্মপরিচয়ে তাঁহার স্ত্রীকে এতদিন প্রতারণা করিয়াছে এবং যোগমায়ার বিশ্বাস সে কুলত্যাগিনী — তথাপি উপস্থিত তর্কটা সম্বন্ধে উভয়ের কেহই হার মানিতে চাহেন না ।
উভয়ের কন্ঠস্বর ক্রমেই উচ্চ হইয়া উঠিতে লাগিল , ভুলিয়া গেলেন পাশের ঘরেই কাদম্বিনী শুইয়া আছে ।
একজন বলেন , “ ভালো বিপদেই পড়া গেল । আমি নিজের কানে শুনিয়া আসিলাম । ”
আর-একজন দৃঢ়স্বরে বলেন , “ সে কথা বলিলে মানিব কেন , আমি নিজের চক্ষে দেখিতেছি । ”
অবশেষে যোগমায়া জিজ্ঞাসা করিলেন , “ আচ্ছা , কাদম্বিনী কবে মরিল বলো দেখি । ”
ভাবিলেন কাদম্বিনীর কোনো-একটা চিঠির তারিখের সহিত অনৈক্য বাহির করিয়া শ্রীপতির ভ্রম সপ্রমাণ করিয়া দিবেন ।
শ্রীপতি যে তারিখের কথা বলিলেন , উভয়ে হিসাব করিয়া দেখিলেন, যেদিন সন্ধ্যাবেলায় কাদম্বিনী তাঁহাদের বাড়িতে আসে সে তারিখ ঠিক তাহার পূর্বের দিনেই পড়ে । শুনিবামাত্র যোগমায়ার বুকটা হঠাৎ কাঁপিয়া উঠিল , শ্রীপতিরও কেমন একরকম বোধ হইতে লাগিল ।
এমন সময়ে তাঁহাদের ঘরের দ্বার খুলিয়া গেল , একটা বাদলার বাতাস আসিয়া প্রদীপটা ফস্ করিয়া নিবিয়া গেল । বাহিরের অন্ধকার প্রবেশ করিয়া একমুহূর্তে সমস্ত ঘরটা আগাগোড়া ভরিয়া গেল । কাদম্বিনী একেবারে ঘরের ভিতরে আসিয়া দাঁড়াইল । তখন রাত্রি আড়াই প্রহর হইয়া গিয়াছে , বাহিরে অবিশ্রাম বৃষ্টি পড়িতেছে ।
কাদম্বিনী কহিল , “ সই , আমি তোমার সেই কাদম্বিনী , কিন্তু এখন আমি আর বাঁচিয়া নাই । আমি মরিয়া আছি । ”
যোগমায়া ভয়ে চীৎকার করিয়া উঠিলেন: শ্রীপতির বাকস্ফূর্তি হইল না ।
“ কিন্তু, আমি মরিয়াছি ছাড়া তোমাদের কাছে আর কী অপরাধ করিয়াছি । আমার যদি ইহলোকেও স্থান নাই, পরলোকেও স্থান নাই — ওগো , আমি তবে কোথায় যাইব । ” তীব্রকণ্ঠে চীৎকার করিয়া যেন এই গভীর বর্ষানিশীথে সুপ্ত বিধাতাকে জাগ্রত করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “ ওগো , আমি তবে কোথায় যাইব । ”
এই বলিয়া মূর্ছিত দম্পতিকে অন্ধকার ঘরে ফেলিয়া বিশ্বজগতে কাদম্বিনী আপনার স্থান খুঁজিতে গেল ।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।