জীবন চক্র— আমিনুল ইসলাম হুসাইনী

হাসপাতালে মেয়েটাকে রেখে আসার পর থেকে রাকিব সাহেব কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠেছেন। শাপলা চত্বর ঘুরে রাকিব সাহেবের গাড়ি যখন সামনে অগ্রসর হচ্ছিল ঠিক তখনই মেয়েটি উনার গাড়ির নিচে পড়ে। রাকিব সাহেব ইচ্ছে করলে দ্রুত পালিয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি তো এমন লোক নয়। তাবলীগে সময় লাগিয়ে পাকা মুবাল্লিগ।

আশে পাশের লোকজন জড়ো হওয়ার আগেই রাকিব সাহেব মেয়েটাকে গাড়িতে তুলে ঢাকা মেট্রোপলিটন হাসপাতালে ছুটেন। মেয়েটির চেহারায় তাকিয়ে রাকিব সাহেব হারিয়ে যায় অতীতের স্মৃতিতে। স্মৃতির এলবামে খুঁজতে থাকে মেয়েটির সাথে মিলে এমন কারো অবয়ব। বেশিক্ষণ খুঁজতে হয়নি তাকে। কয়েকটি পাতা উল্টানোর পরই যে মুখটা ভেসে উঠে সে আর কেউ নয় চাচাতো বোনের ছবি। ছবির সাথে মেয়েটির কি অদ্ভুত মিল। ডা: ইমরানের কণ্ঠস্বরে রাকিব সাহেবের ভাবনায় ছেদ পড়ে।

রোগী আপনার কে হয়?

এক মুসলমান অপর মুসলমানের যা হয়- রাকিব সাহেবের সহজ উত্তর। তা রোগীর সমস্ত খরচতো আপনিই বহন করবেন, তাই না? ইনশাআল্লাহ।

পরদিন সকালে রাকিব সাহেব মেয়েটিকে একনজর দেখার জন্য পাগলপারা হয়ে ছুটে এলেন। ডাক্তারের সাথে কথা বলে জানতে পারেন রোগীর জ্ঞান ফিরেছে। তবে প্রচুর রক্ত ক্ষরণে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাড়াতাড়ি রক্ত জোগাড় না হলে রোগীকে বাঁচানো সম্ভব না।

রাকিব সাহেব মেয়েটির পাশে এসে বসেন, মেয়েটি চোখ খুলে রাকিব সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলে-

আমি এখানে কেন? কি হয়েছে আমার?

তোমার কিছুই হয়নি, সামান্য ব্যথা লেগেছে, বিশ্রাম নাও আল্লাহ্ চাহেতো ঠিক হয়ে যাবে।

কিন্তু আপনি কে?

মনে করো তোমার আংকেল।

আংকেল!

হ্যাঁ, আংকেল।

জানেন আমার না একটা ভাল আংকেল ছিল। অবশ্য আমি উনাকে দেখিনি। নানুর কাছেই সেই আংকেলের গল্প শুনেছি আমার আংকেলের নামটিও ভারি মিষ্টি ছিল। জানেন আমার আংকেলের নাম কি?

না, কি নাম উনার?

মোহাম্মদ রাকিবুল ইসলাম।

নিজের নামে নাম শুনে রাকিব সাহেব কিছুটা অবাক হলেন। মেয়েটি পুনরায় বলতে শুরু করে- কিন্তু সেই আংকেল কোথায় যেন হারিয়ে গেছে, নানু বলেছেন এ জন্য তিনি ও আম্মু দায়ি।

তোমার নাম কী?

রাকিবা তাবাসসুম।

তোমার আববুর নাম কী?

জানি না।

গ্রামের বাড়ি কোথায়?

কুসুমপুর।

কুসুমপুর? ব্যস্ত স্বরে বললেন রাকিব সাহেব।

তোমার নানাজানের নাম কি?

মফিজ মিয়া।

এবার আর স্থির থাকতে পারেনি রাকিব সাহেব। শশ ব্যস্ত হয়ে বলেন- তোমার মায়ের নাম নিশ্চয় ছবি?

হুম, কিন্তু আপনি জানলেন কি করে? অ বুঝেছি, আমার ব্যাগ থেকে নিশ্চয় মায়ের ছবিটা পেয়েছেন, তাই না?

তোমার মায়ের ছবিটা আর একবার দেখাবে?

নিশ্চয়, বলে রাকিবা ব্যাগ থেকে তার মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্রটি দেখায়। ছবির দিকে তাকিয়ে রাকিব সাহেব হারিয়ে যায় আজ থেকে পনের বছর আগের দিন গুলোতে। যেখানে সবুজ দিগন্তে ঢেউ তুলে বসন্তের দক্ষিণা হাওয়া। সেই সবুজ ঢেউয়ে ভেসে বেড়াতো রাকিব ও ছবি। ছুটে বেড়াতো মাঠের পর মাঠে। দেখতে দেখতে কৈশোরে পদার্পণ করে ওরা। কিন্তু সেদিকে তাদের খেয়াল নেই। যেন সেই ছোট খোকা-খুকি। প্রতিদিন স্কুল থেকে আসার সময় কত হৈ হুল্লোড় হয় রাকিব ও ছবির মধ্যে। কোন কোন দিন একে অপরকে মৃদু ধাক্কায় ফেলে দেয় সবুজ পাট ক্ষেতে। তারপর শুরু হয় দৌড়ে ধরার পালা আর ছোটা-ছুটি। আজও স্কুল থেকে ফেরার সময় পাট ক্ষেতের আল দিয়ে যখন ওরা বাড়ি ফিরছিল হঠাৎ ছবি দাঁড়িয়ে পড়ে। রাকিব বুঝতে পারে না হঠাৎ এই দাঁড়িয়ে পড়ার মানে। কিছু সময় পার হওয়ার পর রাকিব ছবিকে জিজ্ঞাসা করে-

কিরে দাঁড়িয়ে পড়লি যে? তুই যা আমি আসছি।

এস এস সি পরীক্ষা দেওয়ার পর হাতে অনেক সময় থাকায় রাকিব তাবলীগে ছিল্লা লাগানোর কথা ভাবছে। তাই চাচা মফিজ মিয়াকে মনের কথাটা ব্যক্ত করে। সেই এতটুকুন বয়স থেকে রাকিবের কোন চাওয়াই অপূর্ণ রাখেনি মফিজ মিয়া। রাকিবের বাবা মারা যাওয়ার কিছুদিন পর রাকিবের নানা মামারা যখন রাকিবের মাকে নিয়ে যায় রাকিবের বয়স তখন চার বা পাঁচ বছর।

তখন থেকেই রাকিবকে নিজের ছেলের মতো করে মানুষ করছে সে। মফিজ মিয়া রাকিবের এই নেক আশাটা পূরণ করার জন্য বেশ কিছু টাকা দিলেন। পূর্ব পাড়ার শাহিন, রাশেদ ও রাকিবের সাথে তাবলীগে যাচ্ছে। আগামীকালই ওরা রওয়ানা হবে। রাকিব বিকেলে ছেলেদের সাথে দেখা করে আসার সময় পাট ক্ষেতে কারো অস্পষ্ট কথা শুনতে পায়। রাকিব শব্দহীন পায়ে ধিরে ধিরে অগ্রসর হয়। রাকিব এবার সেই কথা গুলো স্পষ্ট শুনতে পায়। পরিচিত স্বর শুনে রাকিব অাঁৎকে উঠে। লতিফ সরদারের ছেলে রুস্তমের সাথে এই মেয়েটি ছবি নয়তো? নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে রাকিব।

রুস্তম রাকিবদের ছয় ক্লাশ সিনিয়র ছিল। সে হিসেবে তার অনার্স কমপ্লিট করার কথা। কিন্তু তার ভাগ্যে এস এস সি টাও জুটলনা। এর আগেই ছাত্র জীবনের পবিত্র নাম থেকে তার অপবিত্র নামটা কাটা পড়ে। অবশ্য এর একটা কারণও আছে। সেটা আজ না হয় নাই বা জানা হলো।

রাকিব মাথা ঘুরে পড়ে যায়। তার পড়ে যাওয়ার ধপাস শব্দে বাস্তবে ফিরে আসে ছবি। ছবির বুঝতে বাকি রইল না যে এতক্ষণ সে যে খেলায় বিভোর ছিল তা সবই প্রকাশ হয়ে গেছে রাকিবের নিকট। এখন কি করবে ছবি ভেবে পায় না। এই মরাটা যে কেন এল। আবার হৃদয় মাঝে সেই পুরনো প্রেমটা উঁকি দেয়। রাকিবের জন্য মায়া হয় ছবির। অজ্ঞান হয়ে গেছে নাকি? নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে সে। তারপর গায়ের জামা ঠিক করে রাকিবের কাছে আসে। রাকিবের গায়ে হাত দেবে এমন সময় রাকিব বলে উঠে সাবধান আমার গায়ে তোর অপবিত্র হাত লাগাবিনা। রাকিবের এই কথা শুনে ছবি ক্ষোভে দ্রুত বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।

***             ***           ***

চার মাস হতে চলল রুস্তমের কোন খবর নেই। এদিকে তার পাপের বোঝা ছবি বহন করে আসছে। এতদিন লোক চোখে নিজের অস্বাভাবিক পরিবর্তন আড়াল করে আসলেও এখন আর তা কোন ক্রমেই সম্ভব হচ্ছে না। ছবির মা ছবির হাব-ভাব দেখে দু:শ্চিন্তা করছেন এমন সময় ছবি দৌড়ে কল তলায় ছুটে। অনেকক্ষণ বমি করার চেষ্টা করে। পরে চোখ মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে ঘরে পা রাখে। জাহানারা বেগম মেয়ের এই অবস্থায় আরো ঘাবড়ে যান।

তিনি ভাবতে থাকেন তবে কি তার মেয়ে…… না এই ভাবনা সত্যি হলেও তো সমাজে মুখ দেখানোর উপায় থাকবেনা, তিনি হেকমতের সাথে জিজ্ঞাসা করে- কিরে তোর কি শরীর খারাব?

না, অস্পষ্ট স্বরে ছবির উত্তর।

আমি তোর মা, আমার কাছে কিছু লুকাসনে, কি হয়েছে খুলে বল- বলে জাহানারা বেগম ছবির মাথায় হাত বুলাতে থাকে। মায়ের এমন ব্যবহারে ছবি হাউ মাউ করে কেঁদে মায়ের বুকে জড়িয়ে ধরে। জাহানারা বেগম মেয়ের পিঠে আস্তে  চাপড় দিয়ে বলে- শান্ত হ মা, কি হয়েছে খুলে বল।

আমার সব শেষ হয়ে গেছে মাগো, সব শেষ হয়ে গেছে।

ছবির এমন কথায় অাঁৎকে উঠে জাহানারা। তকে কি যা ভেবেছিলাম…. সামনে আর এগুতে পারেনা। তার মাথায় যেন পাহাড় ধ্বসে পরে। লাথি মেরে ছবির চুলের মুষ্টি ধরে বলে বল কে এই সর্বনাশ করেছে? কি বলবে ছবি? রুস্তম দেশে নেই। তাছাড়া মা রুস্তমের নাম শুনলে মেরেই ফেলবেন। টাকার দাপটে পার পেয়ে যাবে লতিফ সরদার। কিন্তু সমাজে ছবিকে ঘৃণার পাত্র হয়ে ধুকে ধুকে মরতে হবে। এখন কি করবে সে। হঠাৎ রাকিবের কথা স্মরণ হয় ছবির। কান্না জড়িত কণ্ঠে ও দক্ষ অভিনয়ে ছবি বলে- সে আর কেউ নয় তোমাদের রাকিব।

***            ***              ***

তিন চিল্লা দিয়ে রাকিব বাড়ি ফিরেছে আজ তিন দিন হলো।

এশা নামাজ পড়ে এসে রুমে পা দিতেই চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে যায়।

ছবিকে রাকিবের রুমে দেখে রাকিব বাইরে চলে যাওয়ার জন্য পা তুলতেই ছবি বলে- কোথায় যাচ্ছ? তোমার সাথে কিছু কথা আছে। যা বলার তাড়াতাড়ি বল।

ছবি রাকিবের পায়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। রাকিব কিংকর্তব্যবিমুঢ়। ছবি কান্নার গতি থামিয়ে সব খুলে বলল, আগামীকালই রাকিবের সাথে তার বিয়ে হতে যাচ্ছে। রাকিব যদি ভরা মজলিশে ছবিকে অস্বীকার করে তবে রুজিনার মতই ছবির অবস্থা হবে। এর জন্য রাকিবও কম দায়ী নয়। কেন না সেদিন যদি রাকিব ছবিকে তুচ্ছ করে না ফিরিয়ে দিত তখন ছবি রাকিবের প্রতি প্রতিশোধ নিতে গিয়ে রুস্তমের ফাঁদে পা দিতনা। ছবি রুম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় হাতে বিষের বোতল দেখিয়ে বলে- তুমি যদি আমাকে গ্রহণ না কর এই বিষই হবে আমার আজরাঈল। সারা রাত ঘুমুতে পারেনি রাকিব। এ কোন পাপের সাজা সে পেতে যাচ্ছে! বিনা দোষে কেন সে অন্যের পাপের বোঝা মাথায় নেবে।

আর সারাটা জীবন তিমির অাঁধারে কাটাবে। এ রকম ভাবতে ভাবতে রাত কখন যেন শেষ হয়ে যায়- ফজর নামাজ পড়ার জন্য রাকিব ঘর থেকে বাইরে পা রাখে। সেই পা আজও এ বাড়ির ত্রি সীমানায় রাখেনি। এতদিন পর জীবন চক্রে আবার সেই ছবির আবির্ভাব।

আংকেল কি ভাবছ? কোন কথা বলছনা যে- রাকিবার স্বরে বাস্তবে ফিরে আসে রাকিব সাহেব। রাকিবাকে বলে- কিছু না, আচ্ছা তোমার আম্মু এখন কোথায়?

আম্মু সেই আংকেলকে খুঁজতে ঢাকায় চলে আসে।

নানুকে বলে এসেছিল যতদিন তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত না হবে ততদিন তিনি বাড়ি ফিরবেন না। কিন্তু রাকিব আংকেলকে কোথায় পাবে আম্মু। তবুও এখনো তিনি খুঁজে ফিরেন। আচ্ছা আপনি যদি সেই আংকেলকে দেখেন তা হলে আমাদের ঠিকানাটা দিয়ে দেবেন- বলে রাকিবা ব্যাগ থেকে তাদের বাসার ঠিকানা রাকিবের হাতে দেয়। রাকিবা পুনরায় বলে- আচ্ছা আংকেল পাপ যদি হয় আমার বাবা মায়ের আমারতো কোন পাপ নেই। তাই না? মানে?

রাকিবা মৃদু হেসে বলে- মানে? মানেতো আমিও জানি না। আংকেল আমার মাথাটা খুব ব্যথা করছে। রাকিবার গা ঘামতে থাকে। রাকিব সাহেব ডাক্তার ডাকতে গেলেন। ডাক্তার দ্রুত রাকিবাকে জরুরি বিভাগে নিয়ে যায়। রাকিবার মাকে ফোন করা হয়। ঘন্টা দু’য়েকের মধ্যে ছবি উপস্থিত হয়। ডাক্তার জরুরি বিভাগ থেকে বের হলে ছবি ও রাকিব সাহেব এগিয়ে যায়। ডাক্তার মলিন মুখে বলেন- ‘সরি আমাদের কিছু করার নেই।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!