জীবনের শেষ সময়

৪৫ বছর বয়সী অনন্ত চাটুজ্যে একদিন অন্য গ্রামে যাওয়ার পথে তার মৃত বন্ধু নির্মল বিশ্বাসকে উল্টো দিক থেকে হেঁটে আসতে দেখে কিছুটা ভয় পেয়েই বললেন ,” নির্মল তুই তো গত বছর কলেরায় …”
নির্মল বিশ্বাস অল্প হেসে বললেন : ঠিকই জানিস ,আমি এখন যমদূতের চাকরী করি ,সুনীল কর্মকারের স্ত্রী আর এক ঘন্টা বাদেই মারা যাবে ,অনেক দিন থেকে কষ্ট পাচ্ছিলেন ভদ্র মহিলা, আমি ওনাকে নিতেই আজ এসেছি।
অনন্ত চাটুজ্যে বেশ কৌতুহল পূর্বক বললেন : তাহলে এই নতুন চাকরীর দৌলতে তুই আগে থেকেই সব জানতে পারিস বল ,কার কবে মৃত্যু ?
নির্মল বিশ্বাস বললেন : হ্যা তা পারি বটে ,তবে সারা পৃথিবীতে অগনিত প্রাণীর মৃত্যু একজন যমদূত কি করে সামলাবে বল ,তাই আমাদেরও আবার রিজিওন ভাগ করা থাকে ,এই যেমন আমার দায়িত্ব আমার নিজের গ্রাম ছাড়াও আশেপাশের কয়েকটা গ্রাম।
অনন্ত চাটুজ্যে এবার আশ্বস্ত হয়ে বললেন ” দ্যাখ নির্মল , পরলোক সম্বন্ধে জানার আমার বিন্দুমাত্র কৌতুহল নেই ,কোনদিন ছিলও না ,আমার যাবতীয় আকাঙ্ক্ষা এজীবনেই সীমিত ,কিন্তু তুই ছোটবেলার বন্ধু বলে তোর কাছে একটা আবদার রাখছি ,তুই নিশ্চই জানবি আমার কবে মৃত্যু হবে ,না না এখন বলতে হবে না ,এখন থেকেই মৃত্যুভয় আমার সাধের জীবনযাপনে বাধ সাধবে তা আমি চাই না ,তাই আমার মৃত্যুর অল্প কয়েক বছর আগে যদি আমাকে একবার ওয়ার্নিং দিস ,ঠিক তারপর থেকেই আমি যাবতীয় পুণ্য সঞ্চয় শুরু করে দেব ,এই ধর দান ধ্যান ,নামগান ইত্যাদি ইত্যাদি ,তাতে সুবিধা হলো এই যে ,শেষ কটা দিন ছাড়া বাকি জীবন টাও আমি আমোদ আল্হাদে কাটাতে পারবো আর এদিকে বিনা পুন্যে নরক বাসের কোনো ভয়ও আমাকে বিচলিত করতে পারবে না।
নির্মল বিশ্বাস হেসে বললেন: তোর আবদার শিরোধার্য করলাম ,সময় মত আমি নিশ্চই তোকে ওয়ার্নিং দেবো অনন্ত ,এখন আমি এগোই বুঝলি ,পরলোকে সময়ের অবমাননার শাস্তি বড়ই কঠিন ।
তারপর বহু বছর কেটে গেছে। নাতি নাতনী নিয়ে আশি বছর বয়সী অনন্ত চাটুজ্যের ভরা সংসার , এরকমই একদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই সে দেখলো তার বাল্যবন্ধু নির্মল বিশ্বাস হাসিমুখে তার মাথার কাছে দাড়িয়ে আছে। অনন্ত চাটুজ্যে বিছানায় উঠে বসে হেসে বললেন, ” বুঝেছি নির্মল ,তুই নিশ্চই আমাকে ওয়ার্নিং দিতে এসেছিস ? “
নির্মল বিশ্বাস অবাক হয়ে বললেন , ” না তো। আজ আমি তোকে পরলোকে নিয়ে যেতে এসেছি ,৫ মিনিট আগে যে তোর মৃত্যু হয়েছে। “
এ কথা শুনে অনন্ত চাটুজ্যে ভীষণ রেগে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠে বললেন , “বিশ্বাসঘাতক ! আমি যে তোকে বলেছিলাম মৃত্যুর কয়েক বছর আগে আমাকে ওয়ার্নিং দিতে ,আমার যে কিছুই পুণ্য সঞ্চয় হল না ,বাল্যবন্ধুর নরকবাস দেখার ইচ্ছা তুই কিছুতেই সম্বরণ করতে পারলি না ,কি বল ?”
নির্মল বিশ্বাস অবাক হয়ে বললেন , “এ তোর কেমন অভিযোগ অনন্ত ?একবার নয়, আমি তো তোকে বহুবার ওয়ার্নিং দিয়েছি । “
অনন্ত চাটুজ্যে রেগে গিয়ে বললেন , ” পরলোকে গিয়েও তোর মিথ্যাচার কমেনি দেখছি। কবে দিয়েছিস তুই আমাকে ওয়ার্নিং ? আমি বৃদ্ধ হয়েছি ঠিকই কিন্তু স্মৃতিভ্রষ্ঠ হইনি এখনো। “
নির্মল বিশ্বাস শান্ত স্মরে বললেন, ” এই যে গত কয়েক বছর ধরে তুই বাতের ব্যথায় পঙ্গু ,চোখে ভালো দেখতে পাস না , চীৎকার না করলে কানে প্রায় কিছুই শুনতে পাস না ,একটাও দাঁত আর তোর অবশিষ্ট নেই , কিছু ধরতে গেলেই হাত কাঁপে,শরীরকে কোনরকমে চলনসই করতে ডাক্তারের দেওয়া পাতার পর পাতা প্রেসক্রিপশন , এসব ই যে সময় শেষের একেকটা ওয়ার্নিং।”
(এই গল্পটা ছোটবেলায় দাদুভাইয়ের কাছে শোনা ,আমি নিজের ভাষায় একটু অন্যভাবে লিখলাম। কেউ কেউ হয়তো শুনে থাকতে পারেন ,যারা শোনেননি ,আমার মনে হয় তাদের ভালো লাগবে।আমি যখন শুনেছিলাম তখন না হলেও আজ এই গল্পের মধ্যে লুকিয়ে থাকা নির্মম সত্যি আমাকে সত্যি ভাবিয়ে তোলে , তখন নিজের অজান্তেই আরো বেশী করে আঁকড়ে ধরি আশেপাশের ভালবাসার মানুষদেরকে )

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!