সমাপ্তি

তুষারপাত দেখলেই শুভার কথা মনে পড়ে যায় অনন্তর। ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিয়ে যেভাবে শুভার কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকত অনন্ত, আর শুভা ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিত ওর মাথার চুলের মধ্যে দিয়ে… সেরকমভাবেই যেন ওই বরফের নরম স্পর্শ পৃথিবীর ওপর নেমে আসছে। সব ক্লান্তিকে, পাপকে ঢেকে দিতে আসছে… রাশি রাশি শান্তি! সময়ের শুরু বলে কিছু ছিল কিনা জানা নেই, তবে শেষ বুঝি আজই। এরপর আর কিছু নেই! কোনো শব্দ নেই, গন্ধ নেই, রাগ ঘৃণা প্রেম ভালবাসা কিচ্ছু নেই। শুধু অনন্ত আর শুভা চুপচাপ শুয়ে আছে একে অপরকে আলিঙ্গন করে…

আজ বহুদিন পর অনন্তর দিবস্বপ্নের রঙ আবার নীলচে সাদা কালো। ক্লাস এইটে পড়তে পাড়ার সমর্পণ দা এসে “অ্যাই একটা জিনিস দেখবি?” বলে ওকে যেমন নীলচে সাদা চলচ্চিত্র দেখিয়েছিল, সেরকমই এক লজ্জা, কৌতুহল আর অবিশ্বাসে ভরা স্বপ্ন। কলকাতা শহরের জনসমুদ্র থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে এক অখ্যাত প্রায়-গ্রামের কাঠের বাড়ির জানালার ধারে বসে আছে সে আজ। নীলাভ শীতল বরফের চাদরের ওপর দু একবার তিড়িংবিড়িং করে ছুটোছুটি করে যাচ্ছে কয়েকটা শীতকাতুরে চড়াই। তারপর আশ্রয় নিচ্ছে ঝোপঝাড়ের মধ্যে।
বড় গাছের পাতারা ঝরে গেছে বহুদিন। সেই ন্যাড়া গাছের দলের মধ্যে একটা পাইন কেমন বেমানানভাবে মাথা তুলে আছে। এই সব পেরিয়ে অনন্ত তাকিয়ে থাকেঅনেক দূরের দিকে। সে সময় কেউ তার চোখের দিকে তাকালে সেখানে দেখতে পেত খরস্রোতা শিহং নদীর জল, তার তীরে বসে নুড়ি-পাথর নিয়ে নাড়াচাড়া করছে একটা বাচ্চা ছেলে। একটা হলদে নুড়ি তুলে জলের মধ্যে ছুঁড়তেই হঠাৎ থেমে গেল শিহং নদীর স্রোত… নদীর গভীর থেকে কে যেন জলের ভাষায় বলে উঠল “অনেক তো হল বয়ে চলা, এর কি কোনো শেষ নেই?” তাই শুনে চমকে উঠে পাশে বসা দাদুর হাত চেপে ধরল ছেলেটা… যাকগে যাক। অনন্ত আবার ফিরে আসে বাস্তবে। আবার কালই রোদ উঠবে। আকাশ হবে ঝকঝকে নীল। বরফ গলে ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে পড়বে সবুজ ঘাসের আভা। আবার সেই অদ্ভুত ম্রিয়মাণ জীবন ঘিরে ধরবে ওর ইন্দ্রিয়গুলোকে। ভাবতেই কেমন বিচ্ছিরি লাগে। গুটিয়ে শুটিয়ে শুয়ে পড়ে অনন্ত। তার গোটানো দেহটা অনেকটা ওই স্নো-ফ্লেকগুলোর মত ষড়ভুজ হয়ে থাকে।

 

ভাবো অনন্ত ভাবো। আজ তোমার ভাবার দিন। ওঠো, ওই দেখো কেমন জমে পাথর হয়ে গেছে কাশফুলগুলো। দেখো কেমন সাদাকালো হয়ে গেছে সব। আজই তো তোমার বেঁচে ওঠার দিন! শূন্যতার গান গাইছে পৃথিবী, তুমিও স্তব্ধতায় মুখর হয়ে ওঠো আজ! পেঁজা তুলোর মত সাদা ধপধপে বরফের মেঘ ওকে কানে কানে ডাক দিয়ে যায়। তাকিয়ে দেখে আকাশ লাল করে সূর্য উঁকি মেরেছে মেঘের আড়াল থেকে। তারও আজকের মত বিদায় নেবার সময়। অস্ত যাওয়া সূর্যের লাল উত্তাপ গায়ে মেখে গোলাপী রঙে সেজেছে বরফ-ঢাকা গাছের মগডাল। সেই উত্তাপ এসে লাগে অনন্তর গায়েও। মেঘ গলে গলে জল হয়। সাদা রঙ মুছে গিয়ে পড়ে থাকে একমুঠো “কিছু না”। তার লজ্জা দেখে পাশ থেকে হাসে বাদবাকি মেঘের দল। ধীরে ধীরে উত্তাপ বাড়ে। বরফ ঢাকা গাছের মগডালের রাঙিয়ে ওঠা দেখে অনন্তর মনে পড়ে যায় সেই কাঞ্চনজঙ্ঘার লাজুক ভোর।
মনে পড়ে দাদুর কথা, ওর প্রিয় বন্ধু সেই শিহং নদীর কথা, আর হ্যাঁ… শুভা… আর একটু পর শুভা আসবে। চাদরটা টেনে দেবে ওর ষড়ভুজাকৃতি দেহের ওপর। মিষ্টি করে হেসে তার ঠাণ্ডা হাতটা রাখবে অনন্তর মুখে। ধীরে ধীরে শ্বাস আটকে আসবে ওর। সে কি ভীষণ আনন্দ! জানলা দিয়ে অস্তগামী সূর্যের লালচে আঁচ এসে লাগবে গায়ে। গলে যাবে অনন্ত। সবটুকু গলে গিয়ে মিশে যাবে বিছানার কোলে। এক অসম্ভব সুখকর দুঃস্বপ্নের মধ্যে তলিয়ে যাবে সে… যার পর আর বুঝি কিচ্ছুটি নেই…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়তে পারেন...

আবিষ্কার

১ ‘ টুবলু, টুবলু, টুবলু উ উ উ ‘ মার গলা, অনেকক্ষন ধরেই শুনতে পাচ্ছি। …

সরল ও হাতি

সরল এখন খুব খুশি । কারণ সরল ইশকুলে ভর্তি হয়েছে । বাবু সরলকে ইশকুলে যেতে…

পুষুর দুঃস্বপ্ন

আলমারির তাকে থরে থরে সাজানো মধুভর্তি বয়ামগুলোর দিকে তাকিয়ে পুষুর দু চোখ চকচকিয়ে উঠলো। ‘কি…