জিনের পা

ইউনুস মাওলানা খুবই জনপ্রিয় একজন মানুষ। মুখে হাসি লেগেই থাকে। কিন্তু রাগ হলে তার ছায়াপড়া মাটিও থর থর কাঁপতে থাকে।নিচে পানাইলের যে মসজিদটি মধুমতির ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে মাওলানা সেই মিসজিদের ইমাম।মসজিদ ভেঙ্গে গেলে, পুড়ে গেলে, নদীভাঙ্গনে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে বা ঝড়ে উড়ে গেলে এলাকার মানুষ যদি মসজিদটিকে পুনপ্রতিষ্ঠা না করে তাহলে আল্লাহর কঠিণ গজব বর্ষিত হয়। দ্রুত মসজিদটি পুনস্থাপন করতে হবে নচেৎ মহামারি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, ক্ষরাসহ বিবাদ অশান্তি আর নানা অশুভ প্রভাবে জর্জরিত হতে থাকবে এলাকা।
সুস্থ্য শিশু মৃত্যুকোলে ঢলে পড়বে। ডাক্তার-কবিরাজ কিছুই করতে পারবে না। আগুনে পুড়ে যাবে ঘরবাড়ি কিন্তু কারণ জানা যাবে না।বিষাক্ত সাপের ছোবলে লাশ পড়বে একরে পর এক। জীবিতরা সে সাপ দেখতেও পাবে না। মায়ের বুকের দুধ শুকিয়ে যাবে। লাউ-কালিজিরা কোনকিছুতেই কাজ হবে না। নদীর পানি শুকিয়ে যাবে। জমিতে ফসল হবে না।

মাওলানা সাহেবের এসব সাবধান বাণীতে এলাকার মানুষের বুকে কম্পন শুরু হয়ে গেছে। নিজেদের ঘরের বাঁশ-কাঠ-রশি এনে প্রবাসি জাব্বার আখন্দের জমির উপর এক দিনেই তারা মসজিদ দাড় করে ফেলল। মাওলানার মুখে হাসি ফুটেছে। নতুন মসজিদে মিলাদ দিযে তিনি ঘোষণা করেছেন, এলাকার উপর আল্লাহর নেক নজরের ইঙ্গিত তিনি পেয়েছেন। তার পোষা জ্বীন মানকুফ আর জানকুফ মধুমতির ভাঙ্গন রোধ করে দিতে রাজি হয়েছে। ঝড়-বৃষ্টি হল দেও-দানবের লড়াই। মানকুফ আর জানকুফ কোন দেও-দানবকে আর এ তল্লাটে প্রবেশ করতে দিবে না। তবে তাদেরকে খুশি রাখতে হবে।প্রত্যেক শনি ও মঙ্গলবার রাতে শোয়া পাঁচসের চাল আর এক টাকা সোয়া পাঁচ আনা পয়সা একটি পবিত্র পাত্রে মসজিদের ভেতরে মেহরাবের পাশে রেখে দিতে হবে। পূর্বে এ মসজিদের ইমাম ছিলেন মুন্সি বাড়ির ছরোয়ার মুন্সি। পড়ালেখা জানতেন না কিন্তু ঘণ-লম্বা দাড়ি আর পাঞ্জাবিতে তাকে দরবেশ বলে ভ্রম হত। এলাকার মানুষ শ্রদ্ধার সাথে তাকে ইমাম হিসেবে মেনেও নিয়েছিল।কিন্তু দুই বছর আগে বর্তমান ইমাম সাহেব চর এলাকা থেকে এসে যখন হাতে কলমে দেখিয়ে দিলেন যে মুন্সি সাহেবের কুরান পড়া, উচ্চারণ, নামাজের প্রক্রিয়া এমনকি যাবতীয় আমল পর্যন্ত সম্পূর্ণ অশুদ্ধ ও নবিজীর তরিকার খেলাপ তখন সাথে সাথে মুসল্লিরা দোযখের তপ্ত আগুনের ভয়ে হায় হায় করতে করতে নতুন হুজুরের পায়ে উপুড় হয়ে পড়ল। রক্ষে করেন হুজুর আমগে বাঁচান।ভ্রান্ত মানুষকে সৎপথ দেখানো ইমাম সাহেবের ধর্মীয় দায়িত্ব।তিনি আর ফিরে গেলেন না। সরোয়ার মুন্সিকে ইমামতি থেকে ফিরিয়ে দিলেন। সিরাজরে বয়স বাইশ বছর। ঈদ বা কোরবানী ছাড়া তাকে নামাজে তেমন একটা দেখা যায় না।সবকিছু বলে ফেলে বলে সবাই তাকে বোকা মনে করে। কিন্তু তার কথায় অনেক সময় মাতব্বরগণও স্তম্ভিত হয়ে যায়। সরোয়ার মুন্সির মত মুরব্বিকে অপমান করে অচেনা মাওলানাকে ইমাম বানোনো তার ভালো লাগেনি।তার ধারণা মাওলানা স্বার্থ হাসিলের জন্যে সরোয়ার মুন্সিকে বিতাড়িত করেছে।জ্বীনকে খুশি করার কথা শুনে তার মনে খটকা লাগল। সে জিজ্ঞেস করল- জ্বীনরে খুশি কত্তি অবি ক্যা, হুজুর, আল্লারে খুশি কল্লি অবি না? সবাই মুখচাওয়াচায়ি শুরু করল।আসন্ন বিপদ আশঙ্কায় উপস্থিত উদ্বিগ্ন মুখগুলির দিকে তাকিয়ে মাওলানা বললেন- শয়তানের ওয়াসওয়াসা শুরু হয়ে গেছে।

সাবধান! বেইনসাফি কথা কেউ মুখে আনবেন না। আল্লাহর সৃষ্টিকে খুশি করলেই আল্লাহ খুশি হন। জ্বীন হল আল্লাহর সৃষ্টি। সিরাজ বলল- -মানকুফ আর জানকুফ যদি চাল না নেয় তালি কি অবি, হুজুর? -আল্লাহর গজব নাজিল হবে। শয়তান আর দানবের লড়াইতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে গ্রাম। ঘরের টিন গেঁথে থাকবে তালগাছের মাথায়।পানাহ চান, তওবা করেন, মিয়ারা। সিরাজ শব্দ করে “তাওবা আস্তাগফিরুল্লা” বলে পুণরায় জিজ্ঞেস করল- হুজুর জ্বীনরা টাকাদে কি করবি? মাওলানা চোখ বুজে একটু সময নিলেন। ক্ষোভের সাথে কোমলতা মিশিয়ে বললেন- মানকুফ আর জানকুফকে নিযে মাশকারা করবেন না। ওরা নাখোশ হলে আর উপায় থাকবে না। উপস্থিত সবাই আতঙ্কিত হয়ে সিরাজকে ধমকাতে শুরু করল। হুজুরের পায়ের কাছে নিয়ে গেল তওবা করানোর জন্যে। তওবা করিয়ে হুজুর আতরমাখা এক টুকরো তুলো গোল করে সিরাজের কানের ভাঁজের মধ্যে গুজে দিলেন। সিদ্ধান্ত হল পরের শনিবার সোয়া পাঁচসের চাল আর একটাকা সোয়া পাঁচ আনা সিরাজ দিবে। সিরাজ খুশি হয়ে ভক্তির সাথে জানতে চাইল- ইডারে চাঁদাবাজি মনে কল্লিতো পাপ, তাইনা হুজুর? দু’-তিনজন মুসল্লি সিরাজকে হুজুরের সামনে থেকে টেনে নিয়ে গেল। সিরাজ সাধারণত নামাজ পড়ে না, মসজিদেও যায় না। সুর করে হাদিস-কোরান থেকে বলা মাওলানার কথা তার কাছে আজগুবি মনে হয়।

অনেক সময় নাফরমানি প্রশ্নও করে বসে। কিন্তু গ্রামের সমাজকে সে অস্বীকার করেতে পারে না। মাওলানা গ্রামের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। তার সব সিদ্ধান্ত গ্রামের মানুষ শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করে। জ্বীনের খাবার দিতে হবে তাকে। শনিবার এশার নামাজের সময় একটি পবিত্র গামলায় চাল ও টাকা নিয়ে মাওলানা সাহেবের সামনে উপস্থিত হল। মাওলানা চোখ বাঁকা করে চালের মান দেখে বললেন- মেহরাবের সামনে রেখে যাও। সিরাজ গামলা রেখে নামাজ না পড়ে চলে এল।নামাজ শেষে মাওলানা সাহেব সবাইকে দোয়া কালাম পড়ে, দরজা-জানালা ভালোভাবে বন্ধ করে সাবধানে ঘুমাতে বলে দিলেন। ফজর নামাজের পূর্বে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করে দিলেন। কেউ ডাকলেও সাঁড়া দেয়া যাবে না। মানকুফ আর জানকুফ গ্রামের সবকিছু খুটে খুটে দেখবে। সন্তুষ্ট হলে মধুমতির পানিতে অজু করে মেসজিদে ঢুকে নামাজ পড়বে। নামাজ শেষে মেহরাবের উপর বসে খাবার খেয়ে টাকা নিয়ে চলে যাবে। কোন উল্টোপাল্টা হলে আর রক্ষা নেই। মহামারিতে ছেয়ে যাবে গ্রাম।
কেউ সামনে পড়লে ঘাড় মটকে রাগ মেটাবে। মাওলানা সাহেবের হুসিয়ার বাণীতে সকলের বুক শুকিয়ে গেল। মসজিদ থেকে বাড়ি ফিরতেই তাদের ভয় করতে লাগল। নিরেট অন্ধকার আর জোড়া জ্বীনের খপ্পড়ে পড়ার আশঙ্কায় গ্রাম ভুতুড়ে শ্মসানে পরিণত হয়ে গেল। লোকজন দরজা জানালা বন্ধ করেও ভয় কাটাতে পারল না। ছেড়া কাপড়, পুরোন জাল, পাটের ফেসা ইত্যাদি দিযে ঘরের ছোটখাট ফুটোফাটা বন্ধ করে ফেলল। আয়াতুল কুরসি পড়ে বুকে, খাটে, মশারিতে ফু দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘুমাতে গেল। যারা আয়াতুল কুরসি জানে না তারা কালেমা পড়ল। সিরাজ লুঙ্গি মালকাছা দিয়ে মাছ মারা কোচ নিয়ে অগোচরে জ্বীন দেখতে বের হল। মসজিদের পাশে বেড়িবাঁধের উপর আকন্দ গাছের ঝোপের আড়ালে অপেক্ষা করতে লাগল। চারিদিকে নিঝুম অন্ধকার। নিজের শরীরও দেখা যায় না। সে চোখ বন্ধ করে আবার তাকাল।

 

কোন পার্থক্য নেই।চোখ যে মানুষের দেখার অঙ্গ তার এই বিশ্বাসেই ফাটল দেখা দিল। তার মনে ক্ষীণ সন্দেহ হল জ্বীন সম্ভবতঃ তার দৃষ্টি শক্তি নষ্ট করে দিয়েছে। ক্যা কু শব্দে মাথার উপর দিযে বাদুড় না কি যেন উড়ে গেল। ঝোপের ভেতর থেকে কড়কড়-মরমর-ছপছপ শব্দ করে সাপ না কি যেন বেরিয়ে গেল। সিরাজ নিথর হয়ে বসে রইল। ঘণ অন্ধারের মায়ায় তার অনুভূতি আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। আকাশ-মাটি-গাছ-পানি সবকিছু তার কাছে অভিন্ন ও অখন্ড মনে হতে লাগল। মধুমতির গর্জন সুন্দর ছন্দের মত তার স্নায়ুকে নিয়ন্ত্রনহীন গতিময় করে তুলল। দমকা বাতাসে ঝোপের কয়েকটি ডাল বেঁকে তার গায়ে লাগল। সিরাজ শিউরে উঠে হাতের কোচ শক্ত করে চেপে ধরল। এত সময় কি তাহলে স্বপ্ন দেখছিল? তাকে বোকা বানিয়ে জ্বীন কি খাবার নিয়ে চলে গেল? চারিদিকে তাকিয়ে দেখল অন্ধকার কিছুটা কম মনে হচ্ছে।মসজিদ-গাছ-নদী আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। সামনে থেকে ছায়ামত কি একটা ভেসে আসছে তার দিকে। ভয় পেলে চলবে না। সিরাজ শক্ত হযে বসল।সূক্ষ্ণভাবে নজর রাখতে হবে সবদিকে। ছায়াটি ধীরে ধীরে মসজিদের দরজার সামনে গিয়ে থেমে গেল। দরজা খোলার শব্দ তার কানে এল। জ্বীন এসে গেছে মনে হচ্ছে। সিরাজের খটকা লাগল। জ্বীন দরজা খুলে প্রবেশ করবে কেন? ছায়ার মতই বা আসবে কেন। সাবধান! একটু এদিক ওদিক হলে জ্বীনে ঘাড় মটকে রক্ত খাবে।
কয়েক মুহূর্ত পরেই মসজিদের ভেতরে ম্যাচের কাঠি না কিসের আলো জ্বলে উঠল এবং সাথে সাথে নিবেও গেল। ছায়া বের হয়ে বেড়িবাঁধের দিকে আসতে লাগল। সিরাজ শিউরে উঠল। জ্বীন কি তার কথা জেনে গেছে? আর দেরি করা যাবে না। যা করার এখনই করতে হবে। পরে সময় পাওয়া যাবে না। সিরাজ এক লাফে ছায়ার সামনে গিয়ে কোচ দিয়ে জ্বীনের পায়ে সজোরে আঘাত করল।

একটি পরিচিত কন্ঠে জ্বীন উম শব্দ করে ছুটে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। সকালে আকন্দ গাছের ঝোপের পাশে ছড়ানো চাল, টাকা আর গামলা পড়ে থাকতে দেখে এলাকা শোক আর আতঙ্কে ছেয়ে গেল। মানকুফ আর জানকুফ অসন্তুষ্ট ও রাগ হয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে গেছে সবকিছু। সবাই দৌড়ে গিয়ে মাওলানা সাহেবের পায়ে পড়ল। মাওলানা সাহেব খোড়াতে খোড়াতে এসে বললেন সিরাজের নিয়তে গলত আছে এবং সে বেনামাজী। ক্ষুদ্ধ জ্বীনেরা নাকি গ্রামে কলেরা নামাতে চাচ্ছিল। তাদের ক্ষোভ বুঝতে পেরে সেই রাতে মাওলানা যদি বেরিয়ে এসে জ্বীনদেরকে বুঝিয়ে না বলতেন তবে এত সময গ্রাম ছেয়ে যেত কলেরায়। পরের মঙ্গলবারে আর ভুল হবে না এই ওয়াদা করার পরে বেনামাজির জিনিস ছুড়ে ফেলে জ্বীনেরা সাবধান, সাবধান বলতে বলতে চলে গেছে। গ্রামের মানুষ সিরাজকে নিয়ে এল মাওলানা সাহেবের কাছে। তার মাথায় হাত দিয়ে মাওলানা বললেন- নামাজ হল ফরজে আইন। পারহেজগার জ্বীনেরা বেনামাজিদের পছন্দ করেনা। সকলের ভালোর জন্যে নামাজ শুরু কর। মানকুফ আর জানকুফ রেগে গেলে গ্রাম তছনছ হয়ে যাবে। সিরাজের মন অতি শক্ত। সহজে ভয় পায় না। সে বেশী অবিশ্বাস করে মাওলানাকে। কিন্তু গ্রামের মানুষ মাওলানাকে যে গভীর শ্রদ্ধা আর অসীম ভক্তি করে তাতে মাওলানা সম্পর্কে সামান্য বাজে কথাও তারা সহ্য করবে না। অথচ মাওলানার সব কথাই সিরাজের কাছে প্রতারণা মনেহয়।

সে কোন রকম সাহস নিয়ে মাথা নিচু করে বলল- তার মানে আমরা জ্বেনের ভয়তে নামাজ পড়ব? জ্বেন কি আল্লারচে বড় নাকি, হুজুর? আর জ্বেনরা মানুষির ক্ষতি কল্লি আল্লা তাগে পাপ দিবি না? মাওলানা সাহেব ভ্রু কুচকে ঘৃণাভরে হাতের ইশারায় জানালেন- সামনে থেকে সরাও। সরাতে হল না। সিরাজ নিজেই উঠে চলে গেল। গ্রামের মানুষ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। সিরাজের হয়ে তারা মাওলানার পায়ে ধরে মাফ চাইতে লাগল। গোপালপুর গ্রামের চার-পাঁজন যুবকের জ্বীন দেখার খুব শখ। এ গ্রাম থেকে গোপালপুরের দুরত্ব মাত্র দু’মাইল। ইউনুচ মাওলানার জ্বীন হাজির করার দক্ষতার কথা সকলেই জানা। যুবকরা দল বেঁধে পাঞ্জাবি-টুপি পরে গেল মাওলানার কাছে। মাওলানার চোখ পিট পিট করতে লাগল। তৃপ্তির ঢোক গিলে তিনি বললেন- মনে শয়তানি থাকলে জ্বীন দেখতে না চাওয়াই ভালো। কারণ জ্বীন চালাকি বুঝতে পারলে আর রক্ষা থাকবে না। যুবকরা একসাথে জিহবা কামড়ে একজনে বলল- ছি ছি, কি বলেন, হুজুর, জ্বীনের সাথে চালকি! জীবনডাই খোয়াব নাকি? মাওলানা দেখলেন তার কৌশলে কাজ হচ্ছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন- জ্বীন হাজির করার উদ্যেশ্যটা কি বল? এক যুবক আদব রক্ষা করে বিনয়ের সাথে বলল- এট্টু যত্ন করব আর দোয়া নেব, হুজুর। মাওলানা জানতে চাইলেন- জ্বীন কিছু চাইলে দিতে পারবাতো? যুবকরা সমস্বরে জবাব দিল- অবশ্যই পারব।
না পাল্লি কি গ্রামের মান থাকবি হুজুর? মাওলানা বললেন- ঠিক আছে আগামী শনিবার এশার নামাজের পরে এসে আমাকে নিয়ে যেও। গোপালপুরের এক টিনের কাচারি ঘরে জ্বীন হাজিরের আসর। যুবকরা অজু করে পবিত্র হয়ে পাঞ্জাবি-টুপি পরে আদবের সাথে হুজুরের সামনে বসল। ঘরে একখানি চৌকি এবং সামনে একখানি লম্বা বেঞ্চ। মাওলানা সাহেবের নির্দেশ মত ধোয়া চাদর খাটে বিছিয়ে মশারি টাঙ্গানো হল। ঘরের সকল ছিদ্র ছেড়া কাপড়, পাটের ফেসা এবং কাগজ দিয়ে ভালোভাবে বন্ধ করে দেয়া হল। কোন ছিদ্র বন্ধ করতে বাকি থাকল কিনা হারিকেন নিভিয়ে তা পরীক্ষা করা হল।

 

সকল প্রস্তুতি শেষ করে মাওলানা মশারির ভেতরে প্রবেশ করে বসে পড়লেন এবং যুবকদের সামনের বেঞ্চে বসতে বললেন। কয়েকবার দুরুদ শরীফ পড়ার পরে মাওলানার চোখ এবং কন্ঠ কঠিণ হয়ে গেল। তিনি ইশারায় হারিকেন নিভিয়ে দিতে বললেন। মাওলানা শ্বাস গ্রহণ এবং নির্গমনের সাথে দুই ধরনের বিদঘুটে শব্দ করে আল্লাহু আল্লাহু করতে লাগলেন। নিরেট অন্ধকারে ভয়ে যুবকদের বুক শুকিয়ে গেল। তারা ব্যাকুল হয়ে জ্বীনের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। মাওলানা বিদঘুটে শব্দ বন্ধ করে শো শো শব্দে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে লাগলেন। প্রায় এক ঘন্টা এভাবে একবার শো শো, একবার গো গো, একবার হুম হুম শব্দে মাওলানার মন্ত্র উচ্চারিত হয়ে চলল।যুবকদের মন কেমন যেন ঐশি টানে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। এক সময় সকল শব্দ বন্ধ হয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল সবকিছু। যুবকদের গায়ের পশম কাটা দিয়ে উঠল। হঠাৎ টিনের চালে ঘড়ঘড় শব্দে যুবকরা শক্ত হয়ে বসল। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। চৌকির উপর ধপাস শব্দে কি যেন পড়ল। নাকি কন্ঠে মশারির ভেতর থেকে ভেসে এল- আঁসসঁলাঁমুঁ আঁলাঁইঁকুঁম। যুবকরা ভয়ার্ত কন্ঠে নরম করে সালামের জবাব দিল। নাকি কন্ঠ জিজ্ঞেস করল- – আপনারা ভালো আছেন? – হ্যা আমরা ভালো আছি। আপনি ভালোতো? – জি ভালো। আপনাদের কিছু খেতে ইচ্ছে হলে বলুন। এক যুবক সাহস করে বলল- ডাব খাব। সাথে সাথে মাওলানা ক্ষেপে উঠলেন- হারিকেন জ্বলা। হারিকেন জ্বলানোর আগেই জ্বীন ঘর ত্যাগ করে চলে গেল। মাওলানা ধমকাতে আরম্ভ করলেন- ডাব কি কোন খাওয়ার জিনিস? জ্বীনের কাছে কি কেউ কখনও ডাব খেতে চায়? যুবকরা মাফ চাইল। হুজুর বললেন- জ্বীন রাগ হয়ে চলে গেছে। তোদের কপালে যে কি আছে আল্লাহই জানেন। যুবকরা কাঁদ কাঁদ হযে বলল- তাড়াতাড়ি জ্বীন ভাইরে আবার হাজির করেন, হুজুর। পায়ে ধরে মাফ নিয়ে নেই। হুজুর কঠিণভাবে বললেন- জ্বীনের সাথে তোরা বেয়াদবি করছিস।

 

আর আসবে না। এক যুবক একটু চালাকি করে বলল- আপনার কেরামতির কথা কিডা না জানে, হুজুর। আপনি ডাকলি জ্বীন ভাইয়ের আসাই লাগবি। ব্যবস্থা করেন হুজুর। মাফ না নিতি পাল্লি গ্রাম ধ্বংস অয়ে যাবি। এট্টা কিছু করেন, হুজুর। কেরামতির কথা শুনে মাওলানা নরম হলেন। সাবধান করে দিযে বললেন- খবরদার, আর কোন বেয়াদবি করবি না কিন্তু। এক যুবক বলল- না না, এবার কিচ্ছু খাতি চাব না হুজুর। জ্বীন ভাই খুশি অয়ে যা দেয় তাই খাব। আবার হারিকেন নিভিয়ে গো গো, শো শো, হুম হাম চলল কিছু সময়। ঘণ অন্ধকারে যুবকরা মাথা উঁচু করে চোখ বড় করে। তাকিযে রইল। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছেনা। টিনের উপর মড়মড় শব্দ এবং একটু পরেই ধপাস করে চৌকির উপর জ্বীনের আসন গ্রহণ। নাকি কন্ঠে সালাম ও কুশল বিনিময়। জ্বীন জানতে চাইলঃ – আপনারা কি খাবেন? – আপনি খুশি অয়ে যা দেবেন তাই খাব। এই নিন, বলে জ্বীন হাত বাড়িয়ে দিল। অন্ধকারে সে হাত কেউ দেখতে পেল না। নাকি কন্ঠে শোনা গেল- নিচ্ছেন না কেন? এক যুবক আন্দাজে হাত বাড়িয়ে তোবারক নিতে গিয়ে জ্বীনের হাতের স্পর্শে শিউরে উঠল। হাতের ত্বক নরম কাটার মত। ভয়ে যুবকের হাত প্রায় অবস হয়ে গেল। শক্ত ধরনের কয়েকটি গোল বস্তু তার হাতে এল। নাকি কন্ঠ বলল- আপনারা কি কিছু জানতে চান? এক যুবক সাহস করে কোন রকমে বলল- আপনার পা খান এট্টু ছুয়ে দেখতি চাই। নাকি কন্ঠ বলল- ভয় পাবেন না। মশারির মধ্যে হাত বাড়িয়ে ধরে দেখুন। সাহসী যুবকটি দু’হাত মশারির মধ্যে বাড়াতেই ছাগলের গায়ের মত পশমি পা স্পর্শ করে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। যুবকটি শক্ত করে পা চেপে ধরে চিৎকার দিল-লাইট জ্বালা। মুহূর্তেই জ্বীন প্রচন্ড একলাফে ছুটে পালাল কিন্তু জ্বীনের চামড়া খুলে পড়ে রইল যুবকের হাতে। আর এক যুবক লুকিয়ে রাখা টর্চ জ্বালিয়ে ধরল। জ্বীনের পা ধরা যুবকের হাতে একটি উলের মোজা দেখে সাবই “শালা ভন্ড” বলে হুজুরকে ঠেসে ধরল। হুজুর কঠিণ ভাবে বলার চেষ্ট করলেন- খবরদার, বেয়াদবি করবি না। বরবাদ হযে যাবি কিন্তু।

 

কার কথা কে শোনে? হুজুরের গলায গামছা পেচিয়ে বাইরে নিয়ে যাওয়া হল। একজন নরম করে বলল- হুজুর পাজামাটা খোলেন। হুজুর বললেন- তওবা, তওবা, তোদের উপর আল্লার গজব পড়বে। কোথা থেকে হঠাৎ সিরাজ এসে হুজুরের পাছার উপর প্রচন্ড এক লাথি বসিয়ে বলল- আগে ফিতে খোল। আর একজন কষে ঘুসি মারল কানের উপর। হুজুর পাজামার ফিতা খুললেন। কোমর থেকে বের হযে এল দানাদারের একটি ছোট থলে। পাশে ছিল জ্বালানি কাঠ বিক্রির দোকান। সিরাজ সাইজমত একখানা চলা এনে এতদিনের ঝাল মেটাতে শুরু করল। হুজুর হাতে পায়ে ধরে মাফ চাইতে লাগল। তাকে বলে দেয়া হল, ভোরের আগেই যদি এই গ্রাম ছেড়ে না যাস তবে কালকে প্রকাশ্যে জুতাপেটা করা হবে। সেদিন ভোরে মসজিদে আজান হয়নি এবং ফজরের নামাজ পড়াতে হয়েছিল- সরোয়ার মুন্সিকে।

আরো পড়তে পারেন...

রস

কার্তিকের মাঝামাঝি চৌধুরীদের খেজুর বাগান ঝুরতে শুরু করল মোতালেফ। তারপর দিন পনের যেতে না যেতেই…

চিনি শিশু

আজব কাজটা করার সময় ক্ষণিকের জন্য হলেও সেই মুহূর্তে আমি তার মুখের ক্ষেপাটে ভাবটা দেখতে…

আমার মা-দ্বিতীয় পর্ব

দীর্ঘদিন বাবা মায়ের কাকুতি মিনতিতে একে বারেই পাত্তা দেননি। বাবা বিদ্রুপ করে বলতেন, ‘অস্ট্রেলিয়ায় কেন…