জাহান্নামের পরিচয়-২

জাহান্নামীরা তাদের নেতাদের জন্য দ্বিগুণ আযাব এবং বড় অভিশাপের দরখাস্ত করবে।
আল্লাহ তা’আলা বলেন-
– ‘সেদিন তাদের মুখমণ্ডল আগুনে উলটপালট করা হবে, তারা বলতে থাকবে, হায়! আমরা যদি আল্লাহ এবং (আল্লাহর) রাসূলের অনুসরণ করতাম।’ [সূরা আহযাব : ৬৬]
– ‘তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতা ও বড় লোকদের আনুগত্য করেছিলাম এবং তারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে।’ [সূরা আহযাব : ৬৭]
– ‘হে আমাদের প্রতিপালক! তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দাও এবং তাদেরকে দাও মহা অভিসম্পাত।’ [সূরা আহযাব : ৬৮]
জাহান্নামের দারোগাদের কাছে জাহান্নামীদের আবেদন নিবেদন
জাহান্নামীরা জাহান্নামের আযাবে অস্থির হয়ে কাকুতি-মিনতি করতে থাকবে। তারা জাহান্নামরক্ষীদের কাছে আবেদন-নিবেদন করবে-
‘তোমরা তোমাদের রবের কাছে দোআ কর, তিনি যেন আমাদের উপর থেকে কোন একটি দিনের আযাব হালকা করে দেন।’ [সূরা মোমেন : ৪৯]
জাহান্নামের রক্ষীরা জবাব দিবে-
‘তোমাদের কাছে কি তোমাদের রাসূলগণ স্পষ্ট দলিল (মোজেযা) নিয়ে আসতে থাকেন নি (তোমাদের জাহান্নাম থেকে বাঁচার পথ বলে দেন নি?)’ [সূরা মোমেন : ৫০]
এ কথার পর জাহান্নামীরা বলবে, হাঁ, রাসূলগণ তো অবশ্যই আমাদের কাছে আসতেন, কিন্তু আমরা তাঁদের কথা মানিনি।
ফেরেশতারা জবাব দিবে-
‘(আমরা তোমাদের জন্য দোআ করব না) অতএব, তোমরাই তোমাদের জন্য দোআ কর (আমাদের দোআ তোমাদের কোন কাজে আসবে না), কারণ, আখেরাতে কাফেরদের দোআ একেবারেই নিষ্ফল।’  মোমেন : ৫০]
অতঃপর তারা জাহান্নামরক্ষীদের প্রধান মালেকের নিকট নিবেদন করে বলবে-
‘হে মালেক! আপনিই দোআ করুন, যেন আল্লাহ আমাদের মৃত্যু দিয়ে শেষ করে দেন।’ [সূরা যখরুফ : ৭৭]
তিনি বলবেন-
‘তোমরা সর্বদা এ অবস্থায়ই থাকবে, মরবে না, এখান থেকে বেরও হতে পারবে না।’ [ সূরা যুখরুফ : ৭৭]
হযরত আ’মাশ (র.) বলতেন, আমার নিকট এমন বর্ণনা পৌঁছেছে যে, জাহান্নামের রক্ষীপ্রধান মালেক ফেরেশতার জবাব এবং জাহান্নামীদের মাঝে হাজার বছরের ব্যবধান হবে।
অতঃপর তিনি বলবেন- তোমরা সরাসরি রবের দরবারে দরখাস্ত কর। কেননা, তাঁর চেয়ে বড় আর কেউ নেই। তারা নিবেদন করবে-
‘হে আমাদের রব! (বাস্তবিকই) দুর্ভাগ্য আমাদের ঘিরে ফেলেছিল, আর আমরা গোমরাহ ছিলাম। হে রব, আপনি আমাদের এখান থেকে বের করে দিন। অতঃপর পুনরায় যদি আমরা এমন করি তাহলে আমরা অপরাধী হব।’ [সূরা মোমিনূন : ১০৬]
মহান আল্লাহ তাদের নিবেদনের জবাবে বলবেন-
‘ওখানেই পড়ে দুর্ভোগ পোহাতে থাক, আমার সাথে কোন কথা বলবে না।’
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এরূপ কথা শুনার পর তারা সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতা থেকে নিরাশ হয়ে যাবে, অনুতাপে হা-হুতাশ করতে থাকবে। [মিশকাত]
তাফসীরে ইবনে কাসীরে রয়েছে, তাদের চেহারা পরিবর্তিত হয়ে যাবে, গঠন আকৃতি বিবর্তিত হয়ে যাবে, এমন কি তাদের এ দুর্দশা দেখে অনেক মুমিন এগিয়ে আসবে, তাদের জন্য সুপারিশ করবে। জাহান্নামীদের কাউকে চিনা যাবে না। জাহান্নামীরা মুমিনদের দেখে বলবে, হে অমুক, কিন্তু সে (মুমিন) বলবে, তুমি ভুল বলছ, আমি তোমাকে চিনি না। (তোমরা এখানেই পড়ে দুর্ভোগ পোহাতে থাক)। আল্লাহ তাআলার এ জবাবের পরে জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। অতঃপর তারা সেখানেই শাস্তি ভোগ করে পচতে থাকবে।
ফিকির করার বিষয় এবং উপদেশ
জাহান্নাম এবং জাহান্নামীদের অবস্থা সম্পর্কে যা কিছু এতদিন পাঠ করলেন, এজন্য লেখা হয়নি যে, এগুলো পড়বেন আর জাহান্নামের শাস্তি ও আল্লাহর গজবের কথা একমুহূর্তের জন্যও চিন্তা করবেন না। এ কলামে কুরআনের যেসব আয়াত ও হাদিসের রেওয়ায়াত উল্লেখ করা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে সহীহ। কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই। যদি এগুলো বারবার পড়া হয়, আর নিজের বদ আমলের প্রতি খেয়াল করা হয়, তাহলে পাথরসম অত্যন্ত কঠোর হৃদয়ের মানুষের জীবনেও পরিবর্তন আসবে এবং নিজেকে জাহান্নামের অবস্থা বুঝিয়ে নেক আমলের রাস্তায় পরিচালনা করতে পারবে। তবে শর্ত হলো, আল্লাহ তাআলা এবং তার রাসূল সা. যেসব কথা বলেছেন তা সবই সত্য বলে বিশ্বাস করতে হবে, জাহান্নামের অবস্থা সম্পর্কে তাঁদের কথা সত্য এবং বাস্তব বলে মানতে হবে।
মুমিন বান্দারা সর্বদা নিজেদের জীবনের হিসাব করে চলেন এবং আল্লাহর দরবারে জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাওয়ার দোআ করে থাকেন। আল্লাহ তাআলা এবং তার রাসূল সা. যেসব ভীতিকর অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন, যে ব্যক্তি তা সত্য বলে বিশ্বাস করে, সে দুনিয়ার মজা এবং আরাম-আয়েশের জন্য দীনদারী বিসর্জন দিতে পারে না। রাসূল সা. ইরশাদ করেন, বিলাসিতা এবং সুখ-শান্তির ভিতর জাহান্নাম আর দুঃখ-বেদনার ভিতর জান্নাত লুকিয়ে রাখা হয়েছে। [মুসলিম]
দুনিয়ার মোহে পড়ে কেউ বিলাসিতার জীবন যাপন করে, যার আড়ালে রয়েছে জাহান্নাম। আর নফসের কথা না শুনে নেক আমল সম্পাদনকারীরা কষ্টকর কাজ করে, যার আড়ালে রয়েছে জান্নাত। আফসোস তাদের জন্য, যারা জাহান্নামের মুসিবত থেকে মুক্তি পাবে মনে করে দুনিয়ার বিলাসিতায় জীবন-যাপন করে। আর যারা দুনিয়ার মসিবতে পড়ে বলে হায়- আমার জন্য কি আল্লাহর জাহান্নামেও একটু জায়গা নেই।
বস্তুতঃ জাহান্নামের আগুন, তার ভিতরে থাকা সাপ-বিচ্ছু, আগুনের পরিধেয়, বিভিন্ন ধরনের আযাব, ইত্যাদির চিন্তা করলে রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী, পার্লামেন্টের সদস্য, মন্ত্রী এবং ধনাঢ্য শিল্পপতি দুনিয়ামুখীরা কখনই দুনিয়ার চাকচিক্যের প্রতি ধাবিত হত না, দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনের সুখের জন্য কখনও বড় বড় গুনাহের কাজে লিপ্ত হত না এবং নিজের আখেরাত বরবাদ করত না।
বলুন তো, কেউ যদি জাহান্নামের ক্ষুধার কথা চিন্তা করে সে কখনও রোযা ছাড়তে পারে? কেউ যদি জাহান্নামের পেরেশানীর কথা চিন্তা করে তাহলে সে কি সামান্য ঘুমের আরামের জন্য নামায ছেড়ে দিতে পারে? জাহান্নামের সাপ, বিচ্ছুর কথা চিন্তা করলে এ বলে দাড়ি কামাতে পারে, দাড়ি রাখলে চুলকানি হয়? যে জাহান্নামের ভয়ংকর ভীতিকর গর্ত ‘জুব্বুল হয্ন’ সম্পর্কে জানতে পেরেছে, সে কি লোক দেখানোর জন্য ইবাদত করতে পারে? ছবি বানানোর আযাব সম্পর্কে জ্ঞাত ব্যক্তি কি ছবি বানাতে পারে? যে এ কথা বিশ্বাস করে, মদ পান করলে জাহান্নামে জাহান্নামীদের দেহের নির্যাস আর ঘাম পান করানো হবে, সে কি কখনও মদের কাছেও যেতে পারে?
আসল কথা হল, জান্নাত- জাহান্নামের অবস্থা শুধু আমাদের আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে। একান্ত বিশ্বাসের পর্যায়ে পৌঁছায়নি। অন্যথায় বড় বড় গুনাহ তো দূরের কথা, নিতান্ত ছোট গুনাহ করার কথাও আমরা ভাবতে পারতাম না।
হযরত আলী রা. বলেন, যদি জান্নাত- জাহান্নাম আমার সামনে রেখে দেয়া হয় তবুও আমার বিশ্বাসে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটবে না। কেননা আমার ঈমান বিল গায়ব এত মজবুত, চোখে দেখেও ততটুকু বিশ্বাসই হবে যতটুকু না দেখেই হয়েছে। যার জাহান্নামের অবস্থা সম্পর্কে জানা আছে সে দুনিয়ার কোন হাসি-আনন্দের অনুষ্ঠানে শরীকই হতে পারে না। তারগীব ওয়াত্তারহীব গ্রন্থে উদ্ধৃত এক বর্ণনায় আছে, রাসূলুল্লাহ সা. হযরত জিবরাঈল আ. কে জিজ্ঞাসা করেন, কি ব্যাপার, আমি মীকাঈল আ. কে কখনও হাসতে দেখি না যে! জিবরাঈল আ. বললেন, যখন জাহান্নাম সৃষ্টি করা হয়েছে তখন থেকে তিনি আর হাসেন না। [মুসনাদে আহমদ]
সহীহ মুসলিম শরীফের এক বর্ণনায় আছে, একদা রাসূলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন, সেই সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার জান, যদি তোমরা সেই দৃশ্য দেখতে যা আমি দেখেছি, তাহলে অবশ্যই তোমরা কম হাসতে এবং বেশী বেশী কাঁদতে। সাহাবায়ে কিরাম নিবেদন করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সা. আপনি কি দেখেছেন? তিনি এরশাদ করেন, আমি জান্নাত এবং জাহান্নাম দেখেছি। [তারগীব]
হযরত ইবনে মাসউদ রা. বর্ণনা করেন, আমার আশ্চর্য লাগে, লোকেরা হাসে! অথচ তাদের জাহান্নাম থেকে বাঁচার কোন নিশ্চয়তা নেই।
হযরত আবু সাঈদ রা. বর্ণনা করেন, একবার রাসূলুল্লাহ সা. বাইরে গমন করেন। তখন তিনি কিছু লোককে খিল খিল করে হাসতে দেখে এরশাদ করেন, যদি তোমরা (দুনিয়ার) মজা বিনষ্টকারী বস্তু মৃত্যুর আলোচনা করতে, তাহলে তোমাদের এ সুযোগ মিলত না, যে অবস্থায় আমি তোমাদের এখন দেখছি।  [মেশকাত শরীফ]
বস্তুতঃ হুশিয়ার সাবধান সে লোকেরাই, যারা আখেরাতের জীবন সুন্দর করার জন্য দুনিয়ার দু’চার দিনের জীবনের ধন-সম্পদ, ক্ষমতা, ইজ্জত, সম্মানের ফাঁদে পা দেয় না এবং নিজেকে জাহান্নাম থেকে বাঁচায়। কেননা, জাহান্নামের আযাবে পতিত হলে দুনিয়ার কোন ধনদৌলত, ক্ষমতা, সম্মান প্রতিপত্তি কোন কাজেই আসবে না। তখন শুধু আফসোস আর আফসোসই করতে হবে। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-
‘ হায় আফসোস! যদি মৃত্যু আমাকে শেষ করে দিত, আমার সম্পদ আমার কোন কাজে আসলো না, আমার সালতানাত (রাষ্ট্রক্ষমতা)ও ধ্বংস হয়ে গেল। [সুরা আল-হাক্কাহ : ২৭-২৯]
কুরআন মাজীদের ভাষায় উল্লিখিত রূপে আফসোস অনুশোচনা করলেও কোনই কাজ হবে না, হাত বাড়ালেও কিছুই পাওয়া যাবে না।
জান্নাতের মত শান্তি এবং আরামের জায়গা অনুসন্ধান করা এবং জাহান্নামের মত আযাবের জায়গা, যার কোন তুলনা নেই, তা থেকে আত্মরক্ষা করার চিন্তা না করা একমাত্র নির্বোধের কাজ ছাড়া আর কিছুই নয়। রাসূলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন, তোমাদের সাধ্যমত জান্নাত অনুসন্ধান কর এবং জাহান্নাম থেকে দূরে থাক। কেননা, জান্নাতের অনুসন্ধানকারী এবং জাহান্নাম থেকে দূরে থাকতে চেষ্টাকারী কখনও নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে না। [আত তারগীব ওয়াত্তারহীব]
হযরত ইয়াহইয়া ইবনে মুয়াজ রহ. বলেন, মানুষ অভাবকে যতখানি ভয় করে ততখানি  ভয় যদি জাহান্নামকে করত, তাহলে সোজা জান্নাতে চলে যেত।
মুহাম্মদ ইবনে মুনকাদির যখন কাঁদতেন তখন তাঁর চোখের পানি মুখে এবং দাড়িতে মুছতেন। এর কারণ হিসাবে তিনি বলেন, যেখানে চোখের পানি পৌঁছবে সেখানে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবেনা । এ মর্মে আমার কাছে রেওয়ায়াত পৌঁছেছে।
এক আনসারী সাহাবী তাহাজ্জুদের নামায পড়ার পর বসে বসে অনেক বেশি কাঁদেন। তিনি বলছিলেন, জাহান্নামের আগুনের ব্যাপারে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করছি। তাঁর এ অবস্থা দেখে রাসূলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন, আজকে তুমি ফেরেশতাদেরও কাঁদালে।
হযরত যয়নুল আবেদীন রহ. নামাযে ছিলেন, এমন সময় তাঁর ঘরে আগুন লেগে যায়, কিন্তু তিনি নামাযেই মশগুল ছিলেন (নামায ছাড়েননি)। লোকজন তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার কোন খবর নেই (আপনার ঘরে আগুন লেগেছে)? তিনি বললেন, আখেরাতের আগুন আমাকে দুনিয়ার আগুন থেকে গাফেল করে রেখেছে।

হযরত আবু ইয়াজিদ রহ. সর্বদাই কাঁদতেন। এর কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, যদি আল্লাহ বলতেন, গুনাহ করলে হাম্মামে (বাথরুমে) বন্ধি করে রাখা হবে, তাহলেও আমার ক্রন্দন কখনো বন্ধ হত না। আর যখন গুনাহ করার দরুন সেই জাহান্নামের কথা বলা হয়েছে, যেই জাহান্নামের আগুন তিন হাজার বছর পর্যন্ত উত্তপ্ত করা হয়েছে, সেখানে আমার কাঁদা কিভাবে বন্ধ হতে পারে ?

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!