জার ভূত: পরীক্ষা ভূত

দরজায় মৃদু টোকা পড়ছে, ওপাশ থেকে ভারী গলায় ভেসে আসছে-
-নিনিদ দরজা খোল?
–নাহ, খুলব না। ভয় লাগে!
-কেউ দরজায় কড়া নাড়লে, দরজা খুলতে হয়, জানো না?
–জানি। কিন্তু তুমি অন্য সবার মত নও, তোমাকে সবাই ভয় পায়!
-আমাকে সবাই ভয় পায় তা কিন্তু পুরোপুরি ঠিক না; ঐ যে নিহান- তোমাদের ক্লাসের ফার্স্ট বয়, সে তো আমাকে ভয় পায় না।
–সবাই-তো আর নিহান না। নিহান ছাড়া ক্লাসের বাকি সব্বাই তোমাকে ভয় পায়!
-আমি কিন্তু মোটেও ভয়ংকর কেউ না! আচ্ছা, আমি চলে গেলে যদি তোমার ভয় কমে যায় তবে চলে যাচ্ছি। কিন্তু ভয় পেয়ে এখন আমায় তাড়িয়ে দিলেও, আমায় ছেড়ে কী থাকতে পারবে? পড়াশুনা না করলেও, পরীক্ষা না দিয়ে কি পারবে? আমি চলে যাচ্ছি, তুমি স্কুবি-ডুবি দেখতে থাকো। আমি তোমায় কিছু বুদ্ধি শিখিয়ে দিতে এসেছিলাম- আমাকে ভয় না করেও জয় করা যায় কিন্তু কী আর করার তুমি তো এখন কার্টুন দেখছ, আমি বরং চলেই যাই, পরশু দেখা হবে।
নাহ, নিনিদের কার্টুন দেখায় একদম মন বসছে না। পড়তেও ভালো লাগে না তার কিন্তু পরশু যে তার ম্যাথ এক্সাম। পেনপ্রিজ মডেল একাডেমী স্কুলে ক্লাস থ্রিতে পড়ে। এমনিতে সে খারাপ স্টুডেন্ট না। পড়াশুনা মোটামুটি করে কিন্তু পরীক্ষার আগে ভয়ে আর টেনশনে সে অস্থির হয়ে পড়ে। যদিও তার প্রিপারেশান খুব খারাপ থাকে না কিন্তু এক্সামকে যমের মত ভয় পায় সে। কিছুক্ষণ পর যখন কার্টুন দেখায় আর মন বসছিল না, তখন ফিসফিসয়ে উঠে, পরীক্ষা ভূত, তুমি কি আছো এখনও?
-হুম, আছি। কি দরজা খুলবে এখন?
–হুম, খুলব। কার্টুন দেখতেও ইচ্ছে করছে না।
-দরজা খুলতে হবে না, আমি এপাশ থেকেই বলছি। তাছাড়া, আমি তো সবার মনের দরজায় টোকা দেই, মনের দরজা কি পাঁচ-সাতটা সাধারণ দরজার মতন? এ দরজা খোলার জন্য কোন কষ্ট করতে হবে না! শুধু একটু ইচ্ছেশক্তি থাকলেই চলবে কিন্তু জানো, এই ইচ্ছেশক্তিটার-ই বড্ড অভাব।
–আচ্ছা, তোমাকে সবাই ভয় পায় কেন?
-কী জানি? আমি নিজেও জানি না। নিয়মিত পড়াশুনা করলে, আমাকে ভয় পাওয়ার মত কী কিছু আছে, তুমিই বল?
–কই আমি তো রেগুলার অল্প-অল্প পড়াশুনা করি কিন্তু তুমি যখন কড়া নাড়ো আমি ভয়ে জমে যাই।
-এটা তোমাদের মনের ভুল। এই যে দেখ- তুমি পরীক্ষার আগে ভয়ে পড়াশুনাই করতে পারো না কিন্তু পরীক্ষা দিচ্ছি আবার রেজাল্টও খারাপ করছ না! যারা পরিশ্রম করে তাদের পুরস্কার দিতে আল্লাহ কখনো কার্পণ্য করেন না। তাহলে ভয় পাবে কেন, বলত?
–তা তুমি ভুল বল নি। গতবছরতো তোমার ভয়ে মৃদুলের ডায়রিয়া হয়ে গিয়েছিল! তারপরও সে ফিফথ হয়েছে! কিন্তু তুমি না থাকলে কী সমস্যা? এই যে আমরা রোজ স্কুলে যাচ্ছি, প্রতিদিন মিসদের কাছ থেকে কত্তসব নতুন কিছু শিখছি- ঐদিন ‘ওরিগেমি’ শেখাল, আমি এখন কাগজ দিয়ে খুব সুন্দর নৌকো আর প্লেন বানাতে পারি! আবার বিকেলে বন্ধুরা মিলে স্কুল প্লেগ্রাউণ্ডে ফুটবল খেলছি, সন্ধ্যায় আম্মু আর আমি একসাথে মিলে হোমওয়ার্ক করছি, ‘বেন-টেন’ দেখছি, দিব্যি দিন কেটে যাচ্ছে। এসবের মাঝে তোমার থাকার দরকারটা কি? তুমি আসলেই, আমাদের সবার পেটের ভাত চাউল হতে শুরু করে!
-সুন্দর প্রশ্ন করেছ? আচ্ছা, তোমাদের ক্লাসের রতনকে চেন না?
–কি যে বল, চিনবো না আবার! একদম বদের হাড্ডি! পড়াশুনাতো কিছুই করে না। ঐদিন টিফিন পিরিয়ডে কি হল শোন- সবাই টিফিনের ঘণ্টা বাজার শব্দ শুনে বেরিয়ে গেলাম। আমি কি মনে করে আবার ক্লাসে এসে দেখি শয়তানটা কাজলের ব্যাগ থেকে ওর মামার বিদেশ থেকে পাঠানো সুন্দর নীল পেন্সিলটা চুরি করছে, পেন্সিলের ক্যাপে একটা বোতাম আছে যেটা টিপ দিলে আলো জ্বলে! আমাকে দেখতেই, বদটা ভয়ে পেয়ে যায়। কাঁচুমাচু করে বলে- ‘না, মানে কাজলের পেন্সিলটা দেখলাম নিচে পড়ে আছে তাই ওর ব্যাগে রেখে দিচ্ছিলাম আরকি’, বলেই মিষ্টি করে হাসে। রাগে ওর মাথা ভেঙে দিতে ইচ্ছে করছিল; চিন্তা কর কত্ত বড় বদ! বড় হয়ে ও নির্ঘাত ছিঁচকে চোর হবে, দেখো।
-আচ্ছা বাবা আর বলতে হবে না। আচ্ছা, আমি যদি বলি, রতনও নিহানের মত ফার্স্ট বয়!
–কক্ষনো না! রতন বেদম ফাঁকিবাজ। অ্যান্টি সেদিনও এসে স্কুলে কমপ্লেন দিয়ে গেছে, পড়াশুনা কিছুই করে না। আর নিহান, ক্লাস টু থেকে আমাদের ফার্স্ট বয়! ওর মত ভালো ছেলে আমাদের স্কুলে দ্বিতীয়টি নেই- যেমন ভালো স্টুডেন্ট, তেমন সুন্দর ব্যাবহার! কোথায় নিহান আর কথায় রতন! কি যে বল তুমি…
-পরীক্ষা যদি না থাকে, তবে নিহান আর রতনের মধ্যে পার্থক্য করবে কীভাবে?
— আরেহ, এটা তো আগে কখনও চিন্তা করি নি! ঠিকই তো, পরীক্ষা না থাকলে তো কে ভাল স্টুডেন্ট আর কে খারাপ তা কখনও জানা যেত না। এখন রতন নিহানের থেকে কিছুটা দূরে দূরে থাকে; পরীক্ষা না থাকলে তো বুক ফুলিয়ে সবার সামনে হাঁটত।
-এভাবে বলে না নিনিদ। এমনও-ত হতে পারে, পরীক্ষা আছে বলেই একদিন হয়তো এখনের এই দুষ্ট রতন পড়াশুনায় খুব মনযোগী হয়ে উঠবে, ওরও হয়তো ফার্স্ট হতে ইচ্ছে করবে। কি হতে পারে না?
–ডিসকভারী চ্যানেলে দেখায়, একটা খাটাশ আছে না? ও যদি সাপ-বিচ্ছু কাঁচা চিবিয়ে খেতে পারে তাহলে, রতনতো ফার্স্ট হতেই পারে!এ আর এমন কি?
-এইতো বুঝতে পেরেছ। ভালো-আর মন্দের তফাৎ গড়ে দেয়ার জন্যই-তো আমি আছি তাছাড়া আমি আছি বলেই তোমাদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা ভাব থাকে যা তোমরা আরেকটু বড় হলে বুঝবে। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া অনেক তরুণ ছেলেরাও আমাকে ভয় পায়! তোমাদের আর কি দোষ দেব। আচ্ছা, এখন তোমার কি মনে হয়- আমাকে ভয় পাওয়ার মত কিছু আছে?
–একদম না, হেসে উত্তর দেয় নিনিদ।
-আমি দরজা নাড়লে আর ভয় করবে?
-প্রশ্নই আসে না? আচ্ছা, আম্মু বোধয় আমাকে ডাকছে।
–হুম, আমি যাই এখন। তুমি খুব লক্ষ্মী একটা ছেলে। পরশু’র জন্য শুভকামনা রইল কেমন। ভালো থেকো নিনিদ।
…………………………..
……………………………
‘কিরে, তুই কখন থেকে ফিস-ফিস করে কার সাথে কথা বলছিলি? নিনিদের আম্মু চোখ বড়-বড় করে তাকায়’
-ভূতের সাথে আম্মু। মজার ভূতঃ পরীক্ষা ভূত!
‘বাহ! এতক্ষণ তাহলে ভূতের সাথে কথা বলছিল। তা পরীক্ষা ভূত কি তোর মত লিকলিকে শুকনা নাকি পরাগের মত কোলবালিশ?’ মুখ টিপে হাসতে থাকে নিনিদের মা।
-আম্মু, তুমি বিশ্বাস করছ না, তাইতো? ‘পরীক্ষা ভূত’ কিন্তু সত্যিই এসেছিল! খুব ভালো ভূত। আমাকে একদম ভয় দেখায় নি!
‘হুম, ভালো ভূত বলেই তো মনে হচ্ছে! তা কী গল্প করলি এতক্ষণ পরীক্ষা ভূতের সাথে?’ আগ্রহী চোখে তাকায় নিনিদের দিকে।
-অনেক কিছুই বলেছে, কিন্তু সব তো বলা সম্ভব না। পরীক্ষা ভূত বলেছে, ওকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আসলে ও না থাকলে কে পড়াশুনা করছে আর কে করছে না তার মধ্যে পার্থক্যই তো থাকতো না। আমি এখন পরীক্ষাকে ভয় পাই না। আম্মু, তুমি আমাকে কয়টা অঙ্ক দেখিয়ে দেবে? বই আনবো?
‘বাব্বা, তুই নিজ থেকে অঙ্ক করতে চাইছিস! তোর ভূত আবার যখন আসবে, আমাকে ডাকবি- তাকে অনেকগুলো টফি দেব। কিরে টফি খায় তো ও?’ হেসে জিজ্ঞেস করে নিনিদের আম্মু।
-আম্মু, তুমি বেশি কথা বল, ‘ও কেন টফি খাবে? আমি দৌড়ে শেলফ থেকে বই নিয়ে আসি’, বলেই ছুটে যায় নিনিদ।
‘আস্তে যা’ চেহারায় ক্ষীণ হাসির রেখা টেনে নিনিদের জন্য অপেক্ষা করে- এ বয়সে ভূতের সাথে কথা না বললে বলবে কখন!
[এটা একটা শিশুতোষ গল্প। আট থেকে বারো বছরের শিশুদের জন্য লেখা]

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!