জান্নাতে সে আমার প্রতিবেশি হবে

হযরত সিররী সাকতী রাহ, বলেন, একদিন রাতে হঠাৎ আমার মনে পেরেশারী শুরু হলে আমি ছটফট করতে লাগলাম। সেই রাতে আর কিছুতেই আমার চোখে ঘুম এলা না। রাতের তাহাজ্জুদও ছুটে গেল। ফজরের নামায আদায়ের পর মনের পেরেশানী দূর করার উদ্দেশ্যে আমি ঘর হতে বের হয়ে পড়লাম। কিন্তু কোথাও এক দন্ড শাস্তি পেলাম না। অনেকক্ষন ঘোরাঘুরি করার পর জামে মসজিদে গিয়ে এক ব্যক্তির ওয়াজ শুনতে লাগলাম। কিন্তু আমার মনের পেরেশানীর কোন উপশম হলো না। সামনে অগ্রসর হয়ে দেখলাম, আরেক ব্যক্তি ওয়াজ করছে। সেখানেও অনেকক্ষণ অবস্থান করাম, কিন্তু ক্রমেই আমার মনের অস্থিরতা বৃদ্ধি পেতে লাগল। হঠাৎ আমার খেয়াল হলো, আমি থানায় যাব। সেখানে অপরাদীদের করুন অবস্থা হয়তো আমার মনে সান্তনা আসতে পারে। পরে সেই উদ্দেশ্যে এক কয়েদখানায় গেলাম। সেখানে এক পরমা সুন্দরী দাসীর উপর আমার নজর পড়ল। হাতে হাতজড়া ও পায়ে বেড়ী লাগানো সেই দাসীর পরনে ছিল দামী লেবাস এবং তার দেহ হতে খুশবু ছড়াচ্ছিল। প্রথম দর্শনেই আমার মনে হলো, নিশ্চয় এই দাসী নেককার হবে, সে অপরাধী হতে পারে না। আমি নিকটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে সে দাসী কয়েকটি পংক্তি পাঠ করল।

পংক্তিগুলোর অর্থ হলো এই :

হে অন্তরের মালিক! বিনা অপরাধে আমার হাতে হাতকড়া ও পায়ে বেড়ী লাগানো হয়েছে। আমার এই হাত কখনও অন্যায়ভাবে কিছু স্পর্শ করেনি। অথচ তুমি দেখছ, আমার অন্তর জ্বালিয়ে পেড়িয়ে তষ্ম করা হচ্ছে। হে পরওয়ারদিগার! তোমার নামের শপথ, আমার দিল  টুকরা টুকরা করে ফেললেও আমি তোমার পথ হতে এক বিন্দু সরে আসব না।
হযরত সিররী সাকতী রাহ, বলেন, আমি দারোগার নিকট কয়েদীর অবস্থা জিজ্ঞেস করলে সে বলল, এই কয়েদি একজন দাসী। তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তার মালিক তার সংশোধনের জন্য এখানে রেখে গেছে। দারোগার কথা শুনে দাসীর চোখে পানি এলা। আমি দারোগাকে বললাম, দাসীর কথা শুনে কিন্তু তাকে পাগল বলে মনে হয় না। এদিকে দাসী আমার চেখে পানি দেখে বলল, হে সিররী! কয়েকটি গুনের কথা শুনেই তুমি কাঁদছ? যদি তার পূর্ণ পরিচয় পাও তখন তোমার অবস্থা কি হবে? এ কথা বলেই সে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেল।
দীর্ঘ সময় পর জ্ঞান ফিরে আসলে আমি তাকে বললাম, হে দাসী! সে জবাব দিল, লাব্বায়েক হে সিররী! আমি বললাম, তুমি আমার পরিচয় পেলে কিভাবে? জবাবে সে বলল, যখন হতে আমার মারেফাত হাসিল হয়েছে তখন হতেই আমি তোমাকে চিনেছি। তারপর কখনও তোমাকে ভুলিনি। আর আল্লাহওয়ালাগণ পরস্পরের পরিচয় পেয়েই থাকেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কাকে ভালোবাস? সে জবাব দিল, আমি ঐ পবিত্র সত্ত্বাকে ভালোবাসি, যিনি স্বীয় অলীগণের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এই অধমের উপর তিনি অসংখ্য নেয়ামত দান করেছেন। তিনি সর্বজ্ঞ ও সর্বত্র বিরাজমান। পৃথিবীর সকল কিছু তিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি বড় হেকমতওয়ালা, দানশীল, পরম দয়ালু ও ক্ষমাকারী। অতঃপর সে বিকট স্বরে চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
হযরত সিররী সাকতী রাহ, বলেন, দাসীর জ্ঞান ফিরে আসার পর আমি দারোগাকে বললাম, এই নিরীহ বেচারীকে ছেড়ে দাও। দারোগা দাসীকে চলে যেতে অনুমতি দিল। আমি দাসীকে বললাম, এখন তুমি মুকাত, যেখানে ইচ্ছা চলে যেতে পার। কিন্তু সে বলল, হে সিররী! আমার মালিককে ত্যাগ করে আমি কোথায় যাব, বরং তার নিকট পড়ে থেকেই সবর করব। এমন সময় তার মালিক কয়েদখানার ফটকে এসে দারোগাকে জিজ্ঞেস করল, আমার দাসী ‘তোহফা’ কোথায়? সে জানাল, দাসী ভিতরে আছে এবং শায়েখ সিররী তার সঙ্গে আলাপ করছেন।
হযরত সিররী সাকতী রাহ, বলেন, দাসীর মালিক আমার কথা শুনে অত্যান্ত খুশী হলো এবং ভিতরে প্রবেশ করে মারহাবা বলে আমার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করল। আমি তাকে বললাম, তোমার দাসী আমার তুলনায় অধিক সম্মান পাওয়ার উপযুক্ত। কি কারনে তাকে কষ্ট দিচ্ছ? জবাবে সে আক্ষেপ করে বলল, এই দাসীকে আমি বিশ হাজার দেরহামের বিনিময়ে ক্রয় করেছিলাম। আমার ধারনা ছিল, তার দ্বারা আমি লাভবান হব। অসামান্য রূপ লাবণ্যের পাশাপাশি সে ভালো গান গাইতে পারত। কিন্তু সম্প্রতি তার কি-যে হলো; সকল সময় শুধু উদাস হয়ে বসে থাকে। খানাপিনা একেবারেই ছেড়ে দিয়েছে। নিজেও ঘুমায় না এবং আমাদেরকেও ঘুমাতে দেয়া না। হঠাৎ কান্না শুরু করলে আর কিছুতেই তাকে থামানো যায় না। দিনের পর দিন এই অবস্থা চলার কারণে এখন তার রূপ-যৌবন ও স্বাস্থ্য একেবারেই ভেঙ্গে গেছে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কিভাবে তার মধ্যে এই পরিবর্তন শুরু হলো? জবাবে সে জানাল, প্রায় বছরখানিক পূর্বে একদিন সে বেহালা বাজিয়ে গান গাচ্ছিল। হঠাৎ তার কি হলো, হাতের বেহালাটি ভেঙ্গে ছুড়ে ফেলে দিয়ে করুন স্বরে কাদতে লাগল। আমি তার কান্নার কারন জিজ্ঞেস করলাম, স্বান্তনা দিতে চাইলাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। প্রথমে আমি সন্দেহ করেছিলাম, হয়তো সে কোন মানুষের প্রেমে পড়েছো। কিন্তু পরে বহু অনুসন্ধান করেও তার কোন আলামত পাওয়া গেল না। জিজ্ঞাসাবাদ করেও কিছু জানা গেল না। বহুদিন পর একদিন সে জানাল, আল্লাহ পাক স্বীয় অনুগ্রহ দ্বারা আমাকে নিকটে আহবান করেছেন। আর আমি লাব্বায়েক বলে তার ডাকে সাড়া দিয়েছে। অতঃপর অতীতের পাপাচার ও গোনাহখাতার জন্য আমার অন্তরে ভয় সৃষ্টি হয়, কিন্তু আল্লাহ পাকের মহব্বতের নিকট সেই ভয়ের পরাজয় হয়েছে।

 

হযরত সিররী সাকতী রাহ, বলেন, আমি তোহফার মালিককে বললাম, তাকে আমার নিকট বিক্রি করে দাও। সে বলল, তুমি গরীব, তুমি গরীব মানুষ, এত অর্থ পাবে কোথায়? আমি বললাম, তুমি এখানেই অপেক্ষা কর। আমি তার মূল্য নিয়ে আসছি।
হযরত সিররী সাকতী রাহ, বলেন, আল্লাহর কসম! আমার নিকট একটি দেরহামও ছিল না। আমি সেখান হতে ঘরে ফিরে এস সারা রাত আল্লাহর দরবারে রোনাজারী করে বললাম, হে পরওয়ারদিগার! আমি নিঃস্ব, কপর্দকশূন্য। কিন্তু তোমার খাজনায় কোন কিছুর অভাব নেই। তোমার রহমতের উপর ভরসা করে আমি দাসীর মালিককে বলে এসেছি। তার সামনে আমাকে অপমান করো না।
এমন সময় কে যেন আমার ঘরের দরজার শব্দ করল। দরজা খুলে দেখলাম, এক অপরিচিত ব্যক্তি এবং তার পিছনে চারজন গোলাম হাতে বাতি নিয়ে দাড়িয়ে আছে। আমি তাদেরকে ঘরে বসতে দিয়ে পরিচয় জিজ্ঞেস করলাম। আগন্তক বলল, আমার নাম আহমদ বিন মুসান্না। অতপরঃ তার আগমনের উদ্দেশ্যে ব্যক্ত করে বলল, প্রতিরাতের মতো আজ রাতেদও আমি ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ গায়েব হতে আওয়াজ এলো, হে আহমদ! পাঁচটি মুদ্রার থলি নিয়ে সিররীকে দিয়ে এসো। ফলে সে তোমার উপর খুশী হবে এবং তা দ্বারা তোহফাকে খরিদ করবে।
হযরত সিররী সাকতী রাহ, বলেন, আগন্তকের বক্তব্য শুনে আমি সিজদায় পড়ে আল্লাহর দরবারে শুকরে আদায় করলাম। সকালে তাকে সঙ্গে নিয়ে সেই কয়েদখানায় গেলাম। কয়েদখানার প্রহরী আমাকে দেখামাত্র বলে উঠল। মারহাবা, আপনার আগমন শুভ হোক। রাতে আমি গায়েব হতে আওয়াজ শুনেছি, কে যেন বলছে; আল্লাহ পাক দাসীর উপর সদয় হয়েছেন।
হযরত সিররী সাকতী রাহ, বলেন, এদিকে আমার আগমনের শব্দ পেয়ে তোহফা বের হলো। আমার নিকটে এসে সে চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলতে লাগলো। এতদিন আমি গোপন ছিলাম, আজ তুমি সকলের নিকট আমার পরিচয় প্রকাশ করে দিয়েছে।
এমন সময় তোহফার মালিকও সেখানে এসে পৌছল। তাকে দেখে আমি অবাক হলাম। তার চোখে অশ্র“, মাথার চুল উস্কখুস্ক, চোখে-মুখে পেরেশানীর ছাপ সুস্পষ্ট। আমি তাকে বললাম, তোমার পেরেশানীর কোন কারন নেই। আমি তোহফার উপযুক্ত মূল্য সংগ্রহ করে এনছি। কিন্তু সে বলল, আল্লাহর শপথ! আমি তোহফাকে বিক্রি করব না। আমি আরও অধিক মূল্য দিতে চাইলাম। জবাবে সে বলল যদি সমস্ত পৃথিবীও আমার হাতে তুলে দাও তবুও না। বরং এ মুহুর্ত তাকে আমি আযাদ করে দিলাম। আল্লাহ পাক আমার রিজিকের জিম্মাদার। গতরাতে গায়েব হতে তোহফার ব্যাপারে আমাকে ধমকানো হয়েছে।
হযরত সিররী সাকতী রাহ, বলেন, এ সময় আমি আহমদের দিকে তকিয়ে দেখলাম, সে কাঁদছে। কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলল, মনে হয়, আল্লাহ পাক আমার উপর সন্তুষ্ট নন। তিনি আমার খেদমত গ্রহন করলেন না। আপনি সাক্ষী থাকুন, আমি আমার যাবতীয় সম্পদ আল্লাহর পথে দান করে দিলাম। আমি বললাম, আসলে এ সবই তোহফার বরকত। এদিকে তোহফা তখন একটি পশমী জামা দেহে জড়িয়ে কাদতে কাদতে কয়েদখানা হতে বের হয়ে এলো। আমরা তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহ পাক তোমাকে আযাদ করে দিয়েছেন, এখন তুমি কাদছ কেন? সে আমাদের কথায় কোন জবাব না দিয়ে সামনে অগ্রসর হয়ে গেল। কিছুক্ষন পর আর কোথাও তাকে খোজে পাওয়া গেল না।
এদিকে আহমদ বিন মুসান্না বাড়ী ফিরার পথে আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করল। পরে আমি আর তোহফার মালিক মক্কা শরীফ চলে গেলাম। বহুকাল পর একদিন তাওয়াফের সময় আমি একপার্শ্ব হতে একটি রুগ্ন কন্ঠের কাতর ধ্বণি শুনতে পেলাম। সেই শব্দ লক্ষ্য করে আমি সামনে অগ্রসর হলাম। নিকটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক ব্যক্তি হে সিররী বলে আমাকে ডেকে উঠল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কে? সে বলল, আমি তোহফা। আমি তার দিকে তাকিয়ে অবাক বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। সেই তোহফাকে যেন আজ চিনার কোন উপায় নাই। তার রোগাক্লিস্ট দেহটি যেন একেবারে হাড়ের সঙ্গে মিশে গেছে। আমি তাকে বললাম, হে তোহফা মাখলুক হতে পৃথক হয়ে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের পর তুমি কি হাসিল করেছ? সে জবাব দিল, মাখলুক হতে পৃথক হয়ে আমি আল্লাহ পাকের মহব্বত হাসিল করেছি।
পরে তাকে ইবনে মুসান্নার মৃত্যু সংবাদ দিলে সে বলল, আল্লাহ পাক তার উপর রহম করেছেন। সে এমন সব বস্তু লাভ করেছে, যা পৃথিবীর কোন চোখ কোন দিন দেখেনি এবং যার বিবরণও কেই শুনেনি। জান্নাতে সে আমার প্রতিবেশী হবে। আমি তাকে বললাম, হে তোহফা। তোমার সেই মালিক আমার সঙ্গে আছেন। এ কথা শুনামাত্র সে নীরবে কি যেন পড়ল। কিছুক্ষনপর দেখা গেল, সে কাবার দিকে মুখ করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছে। সংবাদ পেয়ে তোহফার মালিক এলা। তোহফার লাশ দেখে সে কিছুতেই নিজেকে সংবরণ করতে পারল না। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সেও প্রাণ ত্যাগ করল। অতঃপর আমি উভয়কে গোসল করিয় কাফন পরিয়ে নামাযে জানাযা আদায় করে দাফন করে দেই।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!