জর্ডান অঞ্চলের নবী লুত (আঃ)

হজরত লুতের পরিচয়

হজরত লুত (আঃ) আল্লাহর এক সম্মানিত নবী। তিনি সেই সব নবীদের একজন, যাদের জাতি ঈমান আনেনি। হজরত লুতের জাতি যে কেবল ঈমান আনেনি, তা নয়, বরং তাঁর জাতির লোকেরা ছিলো সেকালের সবচেয়ে পাপিষ্ঠ লোক। হজরত লুত (আঃ) সেইসব নবীদেরও একজন, যাদের জাতিকে আল্লাহ্‌ ইসলামের বিরোধিতা করার কারনে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। হজরত নূহ, হজরত সালেহ ও হজরত হুদ (আঃ) এর জাতির মতোই লুত (আঃ) এর জাতিকেও আল্লাহ্‌ পাক ধ্বংস করে দিয়েছিলেন।

হজরত লুত (আঃ) ছিলেন মহান নবী হজরত ইব্রাহিম (আঃ) এর ভাতিজা। হজরত ইব্রাহিম (আঃ) যখন নিজ দেশ ইরাকে ইসলাম প্রচার করছিলেন, তখন সেখানে মাত্র দু’জন লোক ঈমান এনেছিলেন। এদের একজন ছিলেন হজরত ইব্রাহিম (আঃ) এর স্ত্রী সারাহ আর অন্নজন ছিলেন তাঁর ভাতিজা হজরত লুত (আঃ)। তিনি যখন ইরাক থেকে হিজরত করতে বাধ্য হন, তখন কেবল এ দু’জনই তাঁর হিজরতের সাথী হন।

 

হিজরত ও নবুয়্যত লাভ

রাজা নমরূদের অত্যাচারে যখন নিজ দেশে ইসলাম প্রচার করা অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন লুত চাচা ইব্রাহিম (আঃ) এর সাথে দেশ ত্যাগ করেন। চাচার সাথে দীন প্রচারের কাজে তিনি ফিলিস্তিন, সিরিয়া হয়ে আফ্রিকার মিশরে পাড়ি জমান। মহান নবী হজরত ইব্রাহীমের ইসলাম প্রচারের সাথী হিসেবে লুত অগাধ জ্ঞান ও প্রশিক্ষন লাভ করেন। ফলে আল্লাহ্‌ তায়ালা তাকেও নবুয়্যত দান করেন এবং জর্ডান এলাকায় একটি পাপিষ্ঠ জাতির কাছে ইসলাম প্রচারের গুরু দায়িত্বে নিযুক্ত করেন।

 

কোন সে জাতি?

কোন সে জাতি? যার কাছে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব অর্পিত হয় হজরত লুত (আঃ) এর উপর? কুরআনে এদেরকে ‘কওমে লুত বা লুতের জাতি’ বলা হয়েছে। এ জাতি যে অঞ্চলে বাস করতো, বর্তমানে সে অঞ্চলের নাম ট্রান্স জর্ডান। এ জায়গাটি ইরাক ও ফিলিস্তিনের মাঝামাঝি অবস্থিত। সেকালে এ জাতির প্রধান শহরের নাম ছিলো সাদুম। এছাড়াও তাঁদের আরো অনেকগুলো শহর ছিলো। চরম পাপাচারের কারনে আল্লাহ্‌ তায়ালা তাঁদেরকে ধ্বংস করে দেন। তাঁদের শহরগুলোকে তলিয়ে দেন। বর্তমানে যাকে লুত সাগর বা Dead Sea (মৃত সাগর) বলা হয়, তাঁদের শহরগুলো তলিয়ে এতেই মিশে গিয়েছিলো। লুত সাগরের পূর্ব-দক্ষিন অঞ্চলে আজো তাঁদের ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান আছে। হজরত ইব্রাহীম (আঃ) এর প্রতিনিধি হিসেবে এ এলাকাতেই হজরত লুত (আঃ) ইসলাম প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন।

 

লুত জাতির পাপাচার

লুত (আঃ) এর জাতির মতো পাপিষ্ঠ জাতি খুব কমই ছিলো। তাঁদের চরিত্র এতো খারাপ ছিলো, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। তারা ছিলো সমকামী। তারা প্রকাশ্যে অশ্লীল কাজ এবং জনসমাবেশে কুকর্মে লিপ্ত হতো। ডাকাতি-রাহাজানি ছিলো, তাঁদের নিত্য দিনের কাজ।

তাঁদের এলাকায় কোন ভালো মানুষ এসে নিরাপদে ফিরে যেতে পারতোনা। কোনো ব্যাবসায়ী বণিক তাঁদের এলাকায় গেলে সব কিছু খুইয়ে আসতে হতো। তাঁদের মধ্যে সামান্যতম লজ্জা শরম পর্যন্ত ছিলোনা। তাঁদের মাঝে একজন সৎ লোকও ছিলোনা, যে পাপ কাজে বাধা দেবে। এমন একটি প্রানিও ছিলোনা, যে পাপকে ঘৃণা করতো। এমন একজন লোকও ছিলোনা, যে কোন অন্যায় কাজের প্রতিবাদ করতো।

 

হজরত লুতের আহবান

এই পাপিষ্ঠ লোকদের সত্য পথ দেখানোর জন্যেই মহান আল্লাহ্‌ হজরত লুত (আঃ) কে পাঠালেন। তিনি এসে তাঁদেরকে আল্লাহর দিকে ডাকলেন। মহান আল্লাহকে ভয় করতে বললেন, কুরআনের ভাষায়-

“লুতের জাতি রাসুলদেরকে অস্বীকার করেছিলো। লুত তাঁদের বলেছিল, তোমরা কি আল্লাহকে ভয় করবেনা? আমি তোমাদের জন্যে একজন বিশ্বস্ত রাসুল। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো আর আমার কথা মেনে নাও।”

আল্লাহর পরম ধৈর্যশীল নবী তাঁদের আরো বললেন-

“তোমরা এমন পাপাচার করছো, যা তোমাদের আগে কোন জাতি করেনি। তোমরা একটি সীমালংঘনকারী জাতি।” (সূরা ৭ আল আরাফঃ আয়াত ৮০)

তিনি তাঁদের বলেছিলেন-

“কেন তোমরা নরদের সাথে নোংরা কাজ করো? কেন দাকাতি-রাহাজানি করো? আর জনসমাবেশে কুকাজে লিপ্ত হও।”

এভাবে লুত (আঃ) দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের অনেক উপদেশ দিলেন, আল্লাহর পথে আসতে বললেন। পাপাচার থেকে বিরত হতে বললেন। কুকর্মের প্রতিবাদ করলেন। কিন্তু তাঁদের একটি লোকও উপদেশ গ্রহন করলোনা। বরং——-

 

হজরত লুতের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ

হ্যাঁ, ওরা হযরত লুতের উপদেশ তো গ্রহন করলোই না, সৎ পথে তো এলোই না, বরং হযরত লুতের সংশোধন কাজের বিরুদ্ধে গড়ে তুললো বিরাট প্রতিরোধ। কেউ তাঁদের ভালো হবার কথা বলুক এটা তারা সহ্য করতে পারতো না। পাপ কাজ ত্যাগ করার কথা তারা শুনতে পারতোনা। ফলে হযরত লুত (আঃ) এর বিরামহীন সংশোধন প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে তারা ক্ষেপে উঠলো। হযরত লুত যে তাঁদেরকে আল্লাহর আযাবের ভয় দেখিয়েছেন এর জবাবে তারা প্রথমে হযরত লুতকে বললো- আমরা তো তোমাকে আর তোমার খোদাকে প্রত্যাখ্যান করেছি। কই তোমার খোদার আযাব? তুমি যদি সত্যি খোদার নবী হতে তবে তো আল্লাহর আযাব এনে দেখাতে পারতে। তারা আল্লাহর নবী হযরত লুতকে শাসিয়ে বললো-

“লুত, যদি তুমি তোমার সংশোধন কাজ থেকে বিরত না হও, তবে তোমাকে অবশ্যই আমাদের দেশ থেকে বের করে দেব।” (সূরা ২৬ আশ-শোয়ারা, আয়াত ৬৭)

কিন্তু আল্লাহর কোন নবী তো আল্লাহর দ্বীন প্রচারের কাজে বিরত থাকতে পারেননা। মানুষকে সৎ পথে ডাকার ও সংশোধন করার কাজ থেকে বিরত হতে পারেননা। হযরত লুত তাঁর মিশন চালিয়ে যেতে থাকলেন। অবশেষে তারা আল্লাহর নবীর বিরুদ্ধে চরম সিদ্ধান্ত নিলো। নেতারা জনগণকে বললো –

“এই লুত আর তাঁর পরিবার পরিজনকে দেশ থেকে বের করে দাও। ওরা বড় পবিত্র লোক।”

 

এলো ধ্বংসের ফেরেস্তারা

আল্লাহর নবী হযরত লুত (আঃ) এর পুত পবিত্রতা নিয়ে ওরা যখন তিরস্কার করতে থাকলো, আর তাঁকে দেশ থেকে বের করে দেবার ষড়যন্ত্র পাকাপোক্ত করতে থাকলো, তখন সর্বশক্তিমান আল্লাহ্‌ ঐ জাতিটিকে পৃথিবীর বুক থেকে নির্মূল করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্যে ফেরেস্তা পাঠিয়ে দিলেন। ফেরেস্তারা প্রথমে হযরত ইব্রাহীমের কাছে এলো। তাঁর স্ত্রী সারাহর ঘরে তাঁর একটি পুত্র সন্তান হবার সুসংবাদ দিলো। বিদায় নেয়ার সময় ইব্রাহিম তাঁদের জিজ্ঞেস করলেন-

“হে দুতেরা, আপনারা কি কোন অভিযানে এসেছেন?

-হ্যাঁ, আমরা ঐ অঞ্চলকে (সাদুম) ধ্বংস করে দিতে এসেছি। আমাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তাঁদেরকে পাথর মেরে ধংস করে দিতে। আপনার মহান প্রভু আল্লাহর পক্ষ থেকে পাথরে চিহ্ন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।

ইব্রাহিম বললেন- সেখানে তো লুত আছে, তাঁর কি উপায় হবে?

ফেরেস্তারা বললেন- আমরা জানি সেখানে কারা আছে? লুত আর তাঁর পরিজনকে নিরাপদ রাখা হবে। অতপর ফেরেস্তারা সে এলাকায় চলে এলেন সুস্রী মানুষের বেশ ধরে। এসে হযরত লুতের ঘরে উঠলেন। লুত তাঁদের চিনতে পারেননি। বললেন- আপনাদের তো চিনতে পারছি না।

তারা বললো- আমরা আপনার কাছে এসেছি। এই লোকেরা যেই বিষয়ে সন্দেহ করছে আমরা সে বিষয়ে ফায়সালা করতে এসেছি। এতোক্ষনে হযরত লুতের বাড়িতে নতুন মেহমানদের আসার খবর পেয়ে গেছে শহরের সব মন্দ লোকেরা। বদমাশ লোকগুলো দৌড়ে এলো মেহমানদের সাথে খারাপ কাজ করার মতলবে। লুত তাঁদের বাধা দিলেন। আফসোস করে বললেন- তোমাদের মাঝে কি একজন ভালো মানুষও নেই?

ফেরেস্তারা হযরত লুতকে কানে কানে বলে দিলেন, আমরা আল্লাহর দূত ফেরেস্তা। এরা আমাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবেনা। রাতের একটি অংশ পার হয়ে গেলে আপনি আপনার পরিবার- পরিজনকে নিয়ে এই এলাকা ত্যাগ করে চলে যাবেন। ওদের ধ্বংসের নির্ধারিত সময়টি হলো ভোর। ভোর তো ঘনিয়ে এলো। তারপর ক হলো? তারপর ভোর হয়ে এলো। ভোর হবার আগেই আল্লাহর নির্দেশে হযরত লুত এলাকা ছেড়ে চলে গেলেন। এদিকে ফেরেস্তারা গোটা এলাকার জমিনকে সম্পূর্ণ ওলট-পালট করে দিলেন। অবিরাম পাথর নিক্ষেপ করে সব কিছু ধ্বংস করে দিলেন। তাঁদের একটি লোককেও বাঁচিয়ে রাখা হলোনা। বিরান করে দেয়া হলো সবকিছু। সম্পূর্ণ বিনাশ হয়ে গেলো পাপিষ্ঠ জাতি। মহান আল্লাহ্‌ বলেন-

“আমি তাঁদের প্রচন্ড বর্ষণের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিলাম। সতর্ক করার পরও যারা সংশোধন হয়না, তাঁদের উপর এমন নিকৃষ্ট বর্ষণই করা হয়ে থাকে।”

নবীর দুর্ভাগা স্ত্রী

যারা ধ্বংস হয়েছে, তাঁদের সাথে হযরত লুত (আঃ) এর স্ত্রীও রয়েছেন। ইনি নবীর স্ত্রী হয়েও কুফরির পক্ষ ত্যাগ করেননি। নবীকে তাঁর দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করেননি। ফলে আল্লাহ্‌ তায়ালা কাফিরদের সাথে তাকেও ধ্বংস করে দেন। হযরত লুত যখন রাতে ঐ এলাকা ত্যাগ করেন, তখন তাঁর এই স্ত্রী তাঁর সাথে যাননি। কাফিরদের সাথে থেকে যান এবং আল্লাহর গযবে নিপতিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যান। আল্লাহ্‌ বলেন-

“আমি লুত আর তাঁর পরিবার-পরিজনকে সেই ধ্বংস থেকে বাঁচালাম। তবে তাঁর বৃদ্ধা (স্ত্রী) কাফিরদের সাথে রয়ে গেলো। আর আমি তাঁদের সম্পূর্ণ ধংস করে দিলাম। ”

আল কুরআনের অন্য এক স্থানে মহান আল্লাহ্‌ বলেন-

“আল্লাহ্‌ কাফিরদের উপমা বানিয়েছেন নূহ আর লুতের স্ত্রীকে। তারা দু’জন আমার দুই নেক বান্দার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলো। কিন্তু তারা তাঁদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে। স্বামী নবী হয়েও আল্লাহর আযাব থেকে তাঁদের বাচাবার ব্যাপারে উপকারে আসলো না। তাঁদের নির্দেশ দেয়া হলো- দোযখীদের সাথে প্রবেশ করো দোযখে।” (সূরা ৬৬ আত তাহরিম। আয়াত ১০)

 

লুত জাতি কেন ধ্বংস হলো?

হযরত লুত (আঃ) এর জাতিকে আল্লাহ্‌ পাক কেন সমূলে ধংস করলেন? কারন, তারা-

১। আল্লাহর নবীকে অস্বীকার করেছিলো।

২। চরম অস্লীলতা ও নির্লজ্জতার মাঝে নিমজ্জিত হয়েছিলো।

৩। নিকৃষ্ট ধরনের পাপ কাজে (সমকামিতায়) ডুবে গিয়েছিল।

৪। ডাকাতি, রাহাজানি ও লুণ্ঠনের রাজত্ব গড়ে তুলেছিল।

৫। চরম কৃপণতা ও নিষ্ঠুরতা তাঁদের স্বভাবে পরিনত হয়েছিল।

৬। পুত পবিত্র জীবন যাপনকে তারা বিদ্রূপ ও ব্যাঙ্গ করতো।

৭। তারা নবীকে দেশ থেকে বের করে দেবার ষড়যন্ত্র করেছিলো।

৮। নবীকে বিদ্রূপ করে আল্লাহর আযাব আসার দাবী করেছিলো।

কুরআনে লুত (আঃ)

আল্লাহ্‌ তায়ালা আল কুরআনে ঘোষণা দিয়েছেন- “আমি ইসমাঈল, ইউশা, ইউনুস এবং লুতকে গোটা জগতবাসীর উপর মর্যাদা দান করেছি।’ সত্যিই মহান আল্লাহ্‌ তাঁর এই নবীকে বিরাট মর্যাদা দিয়েছেন। কুরআন মাজীদে লুত নামটি ২৭ বার উচ্চারিত হয়েছে। যেসব সুরায় উল্লেখ হয়েছে, সেগুলো বলে দিচ্ছি- আনআম-৮৬, আ’রাফ-৮০, হুদ-৭০,৭৪,৭৭,৮১, হিজর- ৫৯,৬১, আম্বিয়া- ৭১,৭৪, হাজ্জ-৪৩, শোয়ারা- ১৬০,১৬১,১৬৭, আন নামল-৫৪,৫৬, আনকাবুত- ২৬,২৭,৩২,৩, সাফফাত- ১৩৩, সয়াদ-১৩, কাফ-১৩, আল কামার- ৩৩,৩৪, আত তাহরিম-১০।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!