জয়পরাজয়-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-৩য় অংশ

বাঁশির গান , যমুনার কল্লোল , প্রেমের মোহ একেবারে দূর হইয়া গেল ; যেন পৃথিবীর উপর হইতে কে একজন বসন্তের সবুজ রঙটুকু মুছিয়া লইয়া আগাগোড়া পবিত্র গোময় লেপন করিয়া গেল । শেখর আপনার এতদিনকার সমস্ত গান বৃথা বোধ করিতে লাগিলেন ; ইহার পরে তাঁহার আর গান গাহিবার সামর্থ্য রহিল না । সেদিন সভা ভঙ্গ হইল । 

পরদিন পুণ্ডরীক ব্যস্ত এবং সমস্ত , দ্বিব্যস্ত এবং দ্বিসমস্তক , বৃত্ত , তার্ক্য , সৌত্র , চক্র , পদ্ম , কাকপদ , আদ্যুত্তর , মধ্যোত্তর , অন্তোত্তর , বাক্যোত্তর , শ্লোকোত্তর , বচনগুপ্ত , মাত্রাচ্যুতক , চ্যুতদত্তাক্ষর , অর্থগূঢ় , স্তুতিনিন্দা , অপহ্নুতি , শুদ্ধাপভ্রংশ , শাব্দী , কালসার , প্রহেলিকা প্রভৃতি অদ্ভুত শব্দচাতুরী দেখাইয়া দিলেন । শুনিয়া সভাসুদ্ধ লোক বিস্ময় রাখিতে স্থান পাইল না ।

শেখর যে-সকল পদ রচনা করিতেন তাহা নিতান্ত সরল — তাহা সুখে দুঃখে উৎসবে আনন্দে সর্বসাধারণে ব্যবহার করিত। আজ তাহারা স্পষ্ট বুঝিতে পারিল , তাহাতে কোনো গুণপনা নাই; যেন তাহা ইচ্ছা করিলেই তাহারাও রচনা করিতে পারিত, কেবল অনভ্যাস অনিচ্ছা অনবসর ইত্যাদি কারণেই পারে না — নহিলে কথাগুলো বিশেষ নূতনও নহে দুরূহও নহে , তাহাতে পৃথিবীর লোকের নূতন একটা শিক্ষাও হয় না সুবিধাও হয় না- কিন্তু আজ যাহা শুনিল তাহা অদ্ভুত ব্যাপার , কাল যাহা শুনিয়াছিল তাহাতেও বিস্তর চিন্তা এবং শিক্ষার বিষয় ছিল । পুণ্ডরীকের পাণ্ডিত্য ও নৈপুণ্যের নিকট তাহাদের আপনার কবিটিকে নিতান্ত বালক ও সামান্য লোক বলিয়া মনে হইতে লাগিল ।

মৎস্যপুচ্ছের তাড়নায় জলের মধ্যে যে গূঢ় আন্দোলন চলিতে থাকে , সরোবরের পদ্ম যেমন তাহার প্রত্যেক আঘাত অনুভব করিতে পারে , শেখর তেমনি তাঁহার চতুর্দিকবর্তী সভাস্থ জনের মনের ভাব হৃদয়ের মধ্যে বুঝিতে পারিলেন ।

আজ শেষ দিন । আজ জয়পরাজয় নির্ণয় হইবে । রাজা তাঁহার কবির প্রতি তীব্র দৃষ্টিপাত করিলেন । তাহার অর্থ এই ‘ আজ নিরুত্তর হইয়া থাকিলে চলিবে না, তোমার যথাসাধ্য চেষ্টা করিতে হইবে । ‘

শেখর শ্রান্তভাবে উঠিয়া দাঁড়াইলেন; কেবল এই ক ‘ টি কথা বলিলেন , “ বীণাপাণি, শ্বেতভুজা , তুমি যদি তোমার কমলবন শূন্য করিয়া আজ মল্লভূমিতে আসিয়া দাঁড়াইলে তবে তোমার চরণাসক্ত যে ভক্তগণ অমৃতপিপাসী তাহাদের কী গতি হইবে । ” মুখ ঈষৎ উপরে তুলিয়া করুণ স্বরে বলিলেন , যেন শ্বেতভুজা বীণাপাণি নতনয়নে রাজান্তঃপুরে বাতায়নসম্মুখে দাঁড়াইয়া আছেন ।

তখন পুণ্ডরীক সশব্দে হাস্য করিলেন , এবং শেখর-শব্দের শেষ দুই অক্ষর গ্রহণ করিয়া অনর্গল শ্লোক রচনা করিয়া গেলেন । বলিলেন , “ পদ্মবনের সহিত খরের কী সম্পর্ক । এবং সংগীতের বিস্তর চর্চাসত্ত্বেও উক্ত প্রাণী কিরূপ ফললাভ করিয়াছে । আর, সরস্বতীর অধিষ্ঠান তো পুণ্ডরীকেই , মহারাজের অধিকারে তিনি কী অপরাধ করিয়াছিলেন যে, এদেশে তাঁহাকে খরবাহন করিয়া অপমান করা হইতেছে । ”

পণ্ডিতেরা এই প্রত্যুত্তরে উচ্চস্বরে হাসিতে লাগিলেন । সভাসদেরাও তাহাতে যোগ দিল — তাঁহাদের দেখাদেখি সভাসুদ্ধ সমস্ত লোক , যাহারা বুঝিল এবং না-বুঝিল , সকলেই হাসিতে লাগিল ।

ইহার উপযুক্ত প্রত্যুত্তরের প্রত্যাশায় রাজা তাঁহার কবিসখাকে বার বার অঙ্কুশের ন্যায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টির দ্বারা তাড়না করিতে লাগিলেন । কিন্তু, শেখর তাহার প্রতি কিছুমাত্র মনোযোগ না করিয়া অটলভাবে বসিয়া রহিলেন ।

তখন রাজা শেখরের প্রতি মনে মনে অত্যন্ত রুষ্ট হইয়া সিংহাসন হইতে নামিয়া আসিলেন এবং নিজের কণ্ঠ হইতে মুক্তার মালা

খুলিয়া পুণ্ডরীকের গলায় পরাইয়া দিলেন — সভাস্থ সকলেই ‘ ধন্য ধন্য ‘ করিতে লাগিল । অন্তঃপুর হইতে এককালে অনেকগুলি বলয় কঙ্কণ নূপুরের শব্দ শুনা গেল — তাহাই শুনিয়া শেখর আসন ছাড়িয়া উঠিলেন এবং ধীরে ধীরে সভাগৃহ হইতে বাহির হইয়া গেলেন ।

 

কৃষ্ণচতুর্দশীর রাত্রি । ঘন অন্ধকার । ফুলের গন্ধ বহিয়া দক্ষিণের বাতাস উদার বিশ্ববন্ধুর ন্যায় মুক্ত বাতায়ন দিয়া নগরের ঘরে ঘরে প্রবেশ করিতেছে ।

ঘরের কাষ্ঠমঞ্চ হইতে শেখর আপনার পুঁথিগুলি পাড়িয়া সম্মুখে স্তূপাকার করিয়া রাখিয়াছেন । তাহার মধ্য হইতে বাছিয়া বাছিয়া নিজের রচিত গ্রন্থগুলি পৃথক করিয়া রাখিলেন । অনেকদিনকার অনেক লেখা । তাহার মধ্যে অনেকগুলি রচনা তিনি নিজেই প্রায় ভুলিয়া গিয়াছিলেন । সেগুলি উল্ টাইয়া পাল্ টাইয়া এখানে ওখানে পড়িয়া দেখিতে লাগিলেন । আজ তাঁহার কাছে ইহা সমস্তই অকিঞ্চিৎকর বলিয়া বোধ হইল ।

নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন , “ সমস্ত জীবনের এই কি সঞ্চয়। কতকগুলা কথা এবং ছন্দ এবং মিল! ” ইহার মধ্যে যে কোনো সৌন্দর্য , মানবের কোনো চির-আনন্দ , কোনো বিশ্বসংগীতের প্রতিধ্বনি , তাঁহার হৃদয়ের কোনো গভীর আত্মপ্রকাশ নিবদ্ধ হইয়া আছে — আজ তিনি তাহা দেখিতে পাইলেন না । রোগীর মুখে যেমন কোনো খাদ্যই রুচে না তেমনি আজ তাঁহার হাতের কাছে যাহা কিছু আসিল সমস্তই ঠেলিয়া ঠেলিয়া ফেলিয়া দিলেন । রাজার মৈত্রী , লোকের খ্যাতি , হৃদয়ের দুরাশা , কল্পনার কুহক — আজ অন্ধকার রাত্রে সমস্তই শূন্য বিড়ম্বনা বলিয়া ঠেকিতে লাগিল ।

তখন একটি একটি করিয়া তাঁহার পুঁথি ছিঁড়িয়া সম্মুখের জ্বলন্ত অগ্নিভাণ্ডে নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন । হঠাৎ একটা উপহাসের কথা মনে উদয় হইল । হাসিতে হাসিতে বলিলেন , “ বড়ো বড়ো রাজারা অশ্বমেধযজ্ঞ করিয়া থাকেন — আজ আমার এ কাব্যমেধযজ্ঞ । ” কিন্তু, তখনই মনে উদয় হইল , তুলনাটা ঠিক হয় নাই । “ অশ্বমেধের অশ্ব যখন সর্বত্র বিজয়ী হইয়া ফিরিয়া আসে তখনই অশ্বমেধ হয় — আমার কবিত্ব যেদিন পরাজিত হইয়াছে আমি সেইদিন কাব্যমেধ করিতে বসিয়াছি — আরো বহুদিন পূর্বে করিলেই ভালো হইত । ”

একে একে নিজের সকল গ্রন্থগুলিই অগ্নিতে সমর্পণ করিলেন । আগুন ধূ ধূ করিয়া জ্বলিয়া উঠিলে কবি সবেগে দুই শূন্য হস্ত শূন্যে নিক্ষেপ করিতে করিতে বলিলেন , “ তোমাকে দিলাম , তোমাকে দিলাম , তোমাকে দিলাম, হে সুন্দরী অগ্নিশিখা , তোমাকেই দিলাম । এতদিন তোমাকেই সমস্ত আহুতি দিয়া আসিতেছিলাম , আজ একেবারে শেষ করিয়া দিলাম । বহুদিন তুমি আমার হৃদয়ের মধ্যে জ্বলিতেছিলে , হে মোহিনী বহ্নিরূপিণী , যদি সোনা হইতাম তো উজ্জ্বল হইয়া উঠিতাম — কিন্তু আমি তুচ্ছ তৃণ , দেবী , তাই আজ ভস্ম হইয়া গিয়াছি । ”

রাত্রি অনেক হইল । শেখর তাঁহার ঘরের সমস্ত বাতায়ন খুলিয়া দিলেন । তিনি যে যে ফুল ভালোবাসিতেন সন্ধ্যাবেলা বাগান হইতে সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছিলেন । সবগুলি সাদা ফুল — জুঁই বেল এবং গন্ধরাজ । তাহারই মুঠা মুঠা লইয়া নির্মল বিছানার উপর ছড়াইয়া দিলেন । ঘরের চারিদিকে প্রদীপ জ্বালাইলেন ।

তাহার পর মধুর সঙ্গে একটা উদ্ভিদের বিষরস মিশাইয়া নিশ্চিন্তমুখে পান করিলেন এবং ধীরে ধীরে আপনার শয্যায় গিয়া শয়ন করিলেন । শরীর অবশ এবং নেত্র মুদ্রিত হইয়া আসিল ।

 নূপুর বাজিল । দক্ষিণের বাতাসের সঙ্গে কেশগুচ্ছের একটা সুগন্ধ ঘরে প্রবেশ করিল ।

কবি নিমীলিতনেত্রে কহিলেন , “ দেবী , ভক্তের প্রতি দয়া করিলে কি । এতদিন পরে আজ কি দেখা দিতে আসিলে । ”

একটি সুমধুর কণ্ঠে উত্তর শুনিলেন , “ কবি , আসিয়াছি । ”

শেখর চমকিয়া উঠিয়া চক্ষু মেলিলেন- দেখিলেন , শয্যার সম্মুখে এক অপরূপ রমণীমূর্তি ।

মৃত্যুসমাচ্ছন্ন বাষ্পাকুলনেত্রে স্পষ্ট করিয়া দেখিতে পাইলেন না । মনে হইল , তাঁহার হৃদয়ের সেই ছায়াময়ী প্রতিমা অন্তর হইতে বাহির হইয়া মৃত্যুকালে তাঁহার মুখের দিকে স্থিরনেত্রে চাহিয়া আছে ।

রমণী কহিলেন , “ আমি রাজকন্যা অপরাজিতা । ”

কবি প্রাণপণে উঠিয়া বসিলেন ।

রাজকন্যা কহিলেন , “ রাজা তোমার সুবিচার করেন নাই । তোমারই জয় হইয়াছে , কবি , তাই আমি আজ তোমাকে জয়মাল্য দিতে আসিয়াছি । ”

বলিয়া অপরাজিতা নিজের কণ্ঠ হইতে স্বহস্তরচিত পুষ্পমালা খুলিয়া কবির গলায় পরাইয়া দিলেন । মরণাহত কবি শয্যার উপরে পড়িয়া গেলেন ।

গল্পের প্রথম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!