- আমার নাম রাশেদ। আমি ঢাকা শহরের একজন লেখক। আমার কাজ হলো লোকমুখে শোনা অদ্ভুত গল্প আর বাস্তব ঘটনার ভেতরের সত্যটা খুঁজে বের করা। কিন্তু সুন্দরবনের গভীরে গিয়ে আমি যে ভয়ঙ্কর সত্যিটার মুখোমুখি হলাম তা শুধু আমার লেখার বিষয় হয়ে থাকেনি, চিরদিনের জন্য আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।
২০২১ সালের আগস্ট মাস। তখন বর্ষাকাল। পত্রিকায় একটা ছোট খবর আমার চোখ টেনেছিল: “সুন্দরবনে পর্যটকদের দল পথ হারাল, গাইডের রহস্যময় মৃত্যু, ১৪ ঘণ্টা পর উদ্ধার।” প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো সামান্য একটা দুর্ঘটনা। কিন্তু যখন বনকর্মী আর বেঁচে ফেরা পর্যটকদের কাছ থেকে ঘটনাটা শুনলাম, তখন বুঝলাম গল্পটা শুধু পথ হারানোর নয়। এটা সুন্দরবনের ভেতরের এক অজানা শক্তির ডাক।
মোট এগারো জনের একটি দল সুন্দরবন ঘুরতে গিয়েছিল। ঢাকার দুটো পরিবার এবং অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় চারজন তরুণ-তরুণী। তাদের গাইড ছিল রমিজ। তার চেহারায় সুন্দরবনের অভিজ্ঞতার ছাপ স্পষ্ট। সে গর্ব করে বলত, “স্যার, এই বনের হাঁটার পথ আর বাঘের পায়ের ছাপ সব আমার মুখস্থ।”
তারা যাত্রা শুরু করেছিল খুব ভোরে যখন সব কিছু ভেজা আর শান্ত। তাদের উদ্দেশ্য ছিল হরিণ দেখা আর কিছু বিরল পাখির ছবি তোলা। রুটটা ছিল খুবই সহজ, একটা ছোট খাল ধরে একটু হেঁটে আবার দুপুরের মধ্যে লঞ্চে ফিরে আসা। বনকর্মীরাও বলেছিলেন এই পথে পথ হারানোর কোনো উপায় নেই।
চারপাশে শুধু সবুজ আর নিস্তব্ধতা। মনে হচ্ছিল যেন বন গভীর ঘুমে ডুবে আছে। মাঝে মাঝে শুধু বানর আর অচেনা পাখির আওয়াজ। দলটি তখন হাসিখুশিতে মেতে ছিল। তারা জানত না এই হাসিই তাদের শেষ আনন্দের মুহূর্ত।
সময়টা দুপুর গড়িয়ে বিকেল। তারা ম্যানগ্রোভ গাছের শিকড়ে ভরা একটা সরু খালের পাশ দিয়ে হাঁটছিল। হঠাৎ রমিজ থমকে গেল।
বারো বছরের অভিজ্ঞতা যেন এক মুহূর্তে ধুলোয় মিশে গেল। রমিজের মুখ মুহূর্তের মধ্যে হলুদ হয়ে গেল। চোখ দুটো বড় বড় স্থিরভাবে তাকিয়ে আছে খালের উল্টো দিকের ঘন ঝোপের দিকে। যেন সে এমন কিছু দেখছে যা আর কেউ দেখতে পাচ্ছে না।
ভয়ে তার গলা কাঁপছিল। সে ফিসফিস করে বলল,“দাঁড়াও… সবাই দাঁড়াও… কেউ ডাকছে… একটা নৌকা… আমাদের দিকে আসছে… কিন্তু… না…”
সবাই অবাক হয়ে গেল। কোনো আওয়াজ নেই, কোনো নৌকা নেই। শুধু গুমোট বাতাস। দলের মিথিলা নামের এক তরুণী জানতে চাইল, “রমিজ ভাই, কী হলো আপনার?”
রমিজ কোনো উত্তর দিল না। সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তার মুখ থেকে শুধু একটা অস্পষ্ট শব্দ বের হলো: “পিছিয়ে যাও…”
এর ঠিক মিনিট বিশেক পর সুন্দরবনের এই অভিজ্ঞ গাইড মারা গেলেন।
ডাক্তারের রিপোর্টে কারণ লেখা হলো ‘তীব্র স্ট্রোক’। কিন্তু দলের সদস্যরা আজও ভয় পেয়ে যায় যখন তারা বলে: রমিজের চোখ দুটো ছিল সম্পূর্ণ খোলা, স্থির। দেখে মনে হচ্ছিল সে কোনো অদৃশ্য কিছুর দিকে তাকিয়ে ছিল যা আসলে সেখানে ছিল না। তার মৃত্যু ছিল হঠাৎ অস্বাভাবিক। যেন নীরবতার বুক চিরে কেউ এসে তার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।
রমিজের মৃত্যুর পর দলটি পুরোপুরি দিশেহারা। গাইড নেই, ভয় আর আতঙ্ক চারদিকে ছেয়ে গেল। মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই আর সবার মোবাইলের চার্জও শেষের দিকে। সূর্য তখন ডুবছে শেষ আলোটুকুও ম্যানগ্রোভের পাতা ভেদ করে মিলিয়ে গেল। সুন্দরবনের অন্ধকার খুব ঘন নিশ্ছিদ্র। এই অন্ধকার শুধু দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেয় না, মানুষের সাহসও গ্রাস করে নেয়।
দলটি ঠিক করল রমিজ যে দিকে তাকিয়েছিল সেদিকেই তারা হাঁটতে থাকবে। হয়তো সেটা কোনো পরিচিত রাস্তায় গিয়ে মিশবে। এটাই ছিল তাদের সবচেয়ে বড় ভুল।
তারা হাঁটতে শুরু করল। কিছুদূর যাওয়ার পর কাদামাটির ওপর একটি অদ্ভুত ছাপ দেখে সবাই আঁতকে উঠল। মানুষের পায়ের ছাপ কিন্তু দলের এগারো জনের কারো পায়ের ছাপের সাথে তার মিল নেই। শুভ নামের এক ছেলে ফিসফিস করে বলল, “ভাই, এই ছাপটা দেখুন। এটা কোনো বাচ্চা বা প্রাপ্তবয়স্কের নয়… অদ্ভুতভাবে চিকন, কিন্তু অস্বাভাবিকভাবে গভীর… স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।”
সেখানে তখন এগারো জন মানুষ কিন্তু পায়ের ছাপ ছিল বারোটি। বারোতম ব্যক্তি যাকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু যার অস্তিত্ব মাটির বুকে পরিষ্কারভাবে আঁকা।
রাত তখন গভীর। ভয় এখন আর শুধু মনে নেই বাতাসের প্রতিটা কোণায় মিশে গেছে। দলটি হাঁটছে কিন্তু তারা যেন এক অদৃশ্য গোলকধাঁধার শিকার। তারা একটা শুকনো মরা গাছ পার হলো যার কাণ্ডে অনেক লতা জড়ানো। কিন্তু দশ মিনিট পরে তারা আবার সেই একই গাছের কাছে ফিরে এল!
তারা পথ পাল্টাল অন্য দিকে গেল। কিন্তু প্রতিবারই সেই একই শুকনো গাছের কাছে ফিরে আসছে। যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাদের চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে বারবার একই রাস্তায় ঘোরাচ্ছে। রাতের অন্ধকারে ঝোপঝাড় আর শিকড়ের মাঝে, দলটির মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল তারা একা নেই। কেউ যেন তাদের চোখের আড়ালে থেকে পথ দেখাচ্ছে, কিন্তু সে পথ মুক্তির নয় বিভ্রমের। তাদের সাহস ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।
রাত প্রায় তিনটা। চারপাশের নিস্তব্ধতা তখন আরও ভয়ঙ্কর। হঠাৎ তারা নদীর ধারে পৌঁছাল। তারা কিছুটা স্বস্তি পেল, অন্তত নদী ধরে হাঁটলে কোনো গ্রামে পৌঁছানো যেতে পারে। ঠিক তখনই তারা দেখতে পেল…
নদীর বুক চিরে একটি নরম সাদা আলো ভেসে আসছে। সেই আলোয় কোনো উষ্ণতা নেই কিন্তু তা চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। এটা কোনো নৌকা বা ট্রলারের আলো নয় বরং একটি মৃদু রহস্যময় দ্যুতি।
দলটি যখন কিনারায় গিয়ে ভালো করে দেখার চেষ্টা করল আলোটি তখন মিলিয়ে গেল। আবার যখন তারা নদীর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে দূরে তাকাল, আলোটি আবার দেখা গেল এবার আরও একটু দূরে। যেন তাদের পথ দেখানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু কাছে যেতে বারণ করছে।
স্থানীয়রা একে বলে “জঙ্গলের ভূতের আলো” বা “আলেয়া”। বিজ্ঞান বলে, মাটিতে জমা মিথেন গ্যাসের কারণে এমন আলো হতে পারে। কিন্তু গভীর রাতের সুন্দরবনের অন্ধকারে যেখানে ভয় আর বিভ্রম সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়, সেখানে এই রহস্যময় ভাসমান আলো দেখলে কারো পক্ষে শান্ত থাকা সম্ভব নয়। আলোটি তাদের নদীর আরও গভীরের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।
পরের দিন সকালে বনকর্মীদের উদ্ধারকারী দল থার্মাল ক্যামেরা যা তাপমাত্রা মেপে মানুষ খোঁজে,সেটা নিয়ে তাদের খোঁজ শুরু করল। দলের প্রধান ছিলেন করিম স্যার একজন অভিজ্ঞ বনরক্ষী।
করিম স্যার আমাকে যা বলেছিলেন, তা শোনার মতো ছিল না।
তিনি বললেন,
“রাশেদ ভাই, থার্মাল ক্যামেরায় আমরা স্পষ্ট দেখলাম বারোটি হিট সিগন্যাল।”
আমি থমকে গেলাম। “দল তো এগারো জনের ছিল, স্যার।”
তিনি আমার চোখে চোখ রাখলেন, তার দৃষ্টিতে এক গভীর আতঙ্ক,
“হ্যাঁ… সেটাই অস্বাভাবিক। বারোতম সিগন্যালটা স্পষ্ট ছিল, কিন্তু সেটা একরকম অদ্ভুতভাবে ভাসছিল। আর ঠিক যখন আমরা তাদের কাছে পৌঁছে গেলাম সিগন্যালটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।”
দলের এগারো জন সদস্যই এই কথা বিশ্বাস করেছিল। কেউ বা কিছু নিশ্চিতভাবে তাদের পথ দেখাচ্ছিল তাদের বিভ্রান্ত করছিল কিন্তু সেটা মানুষের চোখে দেখা যাচ্ছিল না। এই বারোতম সংকেতই হয়তো ছিল সেই দ্বাদশ পায়ের ছাপের অদৃশ্য প্রাণীটি।
ভোর পাঁচটার দিকে দলটি উদ্ধার হলো। সবাই ভেজা ক্লান্ত, আতঙ্কে যেন পাথরের মতো জমে গিয়েছিল। তাদের চোখগুলো ছিল ফ্যাকাশে। তারা শারীরিকভাবে বেঁচে গেলেও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল।
একজন ছেলে তখনো ফিসফিস করে বলছিল,
“বিশ্বাস করুন, আমরা কোনো ভুল পথে যাইনি। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, কেউ একজন আমাদের ভুল পথে ঠেলে দিচ্ছে… কেউ যেন অদৃশ্য দড়ি দিয়ে বেঁধে আমাদের টানছিল।”
রমিজের সহকর্মীরা সব জানতেন। তারা শান্ত গলায় বললেন,
“রমিজ আগেই আমাদের বলেছিল, রাতের সুন্দরবনে কিছু অদৃশ্য শক্তি আছে, যারা মানুষকে ডাকে। সে নিজেও ভয় পেত। কিন্তু পেটের তাগিদে শেষ পর্যন্ত এই বনের গাইড হয়েছিল।
সুন্দরবন সত্যিই রহস্যময়। এখানকার নীরবতা জল আর জঙ্গলের প্রতিটি বাঁক যেন অদেখা কোনো নিয়ম মেনে চলে।
যারা এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন তারা শুধু পথ হারাননি তারা এমন কিছুর মুখোমুখি হয়েছিলেন যার কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। তারা এমন এক অদৃশ্য পথনির্দেশকের শিকার হয়েছিলেন যার গন্তব্য কোনো মানব বসতি ছিল না ছিল বনের আরও গভীরের দিকে।
কমেন্টে লিখুন আপনি কি মনে করেন ওরা সত্যিই একা ছিল, নাকি কোনো অদেখা শক্তি তাদের পথ দেখাচ্ছিল?
যদি আপনার বন্ধুরাও জানতে চায়, গল্পটি শেয়ার করুন।
(এই গল্পটি সুন্দরবনের বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে লেখা)
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।