কেরানি গঞ্জ এর কদমতলি চৌরাস্তা পার হয়ে একটু সামনে গেলেই বেগুন বাড়ি কালভার্ট , এই কালভার্ট পার হয়ে আরও সামনে গেলে ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পে পৌছানো যায় , এই প্রকল্পটির বুক চিরে একটা নতুন রাস্তা বানানো হয়েছে যা পোস্তগোলা ব্রিজ পর্জন্ত পৌঁছে গেছে ! কেরানি গঞ্জ হতে খুব সহজে সময় বাঁচিয়ে কেউ যদি পোস্তগোলা ব্রিজে যেতে চান তবে এই রাস্তাটি ব্যবহার করতে পারেন ! তবেই কখনোই রাতের বেলা এই রাস্তাটি ব্যবহার করবেন না ! কারন এই রাস্তায় প্রতি রাতে মনসুর পাগলা চলাফেরা করে !
মনসুর পাগলাকে আমি একবারই দেখেছিলাম ! আর সেটাই ছিলো আমার দুর্ভাগ্য ! খুব জরুরী দাপ্তরিক কাজে আমাকে রাতের বেলা পোস্তগোলা ব্রিজে পৌঁছানোর প্রয়োজন হয়েছিলো ! সময় বাঁচাতে আমি ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পের সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম , বেগুন বাড়ি কালভার্ট পার হয়ে সিএনজি অটোরিক্সার জন্য অনেকখন অপেক্ষা করেও কোন পরিবহন সুবিধা পাচ্ছিলাম না , অগত্যা পায়ে হেঁটেই রওয়ানা হলাম ভাবলাম ঝিলমিল প্রকল্পের কাছা কাছি গেলে হয়তো সিএনজি পাওয়া যেতে পারে !
রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আমার হাঁটতে খুব বেশি সমস্যা হচ্ছিলো না ! কিন্তু ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পে যখন পৌঁছে গেছি তখন চারিদিক ঘুটঘূটে অন্ধকার ! আগেই বলে রাখি এই প্রকল্পটিতে লোকজন এখনও বসতি স্থাপন করা শুরু করেনি তাই যতোদুর চোখ যায় কেবল মরুভুমির মতো বিস্তির্ন বালুর মাঠ ! পথে কোন লোকচলাচল নেই আর নেই কোন গারিঘোরা ! বিপদের ভড়ষা চায়না মোবাইল ! পকেট হতে চায়না মোবাইল সেট বের করে তার টর্চের আলোয় পথ দেখে চলতে লাগলাম কিছুদুর যেতেই লক্ষ্য করলাম আমার কিছু সামনেই লুংগি পরা খালি গায়ে একটা লোক হেঁটে যাচ্ছে! দেখলেই বোঝা যায় লোকটা শ্রমিক শ্রেনীর লোক ! ঘুটঘুটে অন্ধকারের রাতে এইরকম নির্জন পথে একটা সংগি পাওয়া মানে ভাগ্যের বেপার , হোক না সে শ্রমিক ! শ্রমিকরা কি মানুষ নয় ?
আমি জানতে চাইলাম “ কে যায় ? ”
লোকটা উত্তর দিলো “ মনসুর পাগলা যায় ! ”
অবাক লাগলো কারন লোকটা নিজেকে পাগল হিসেবে পরিচয় দিলো ! আমি ভাবলাম হোক পাগল , পাগলরাও মানুষ ! আমি বললাম আমি পোস্তগোলা ব্রিজে যাচ্ছি আমাকে একটু পৌঁছে দেবেন ? নিজের প্রশ্নে নিজেই হতবাক হয়ে গেলাম ! শেষ পর্জন্ত ভয়ের কাছে আমার মন পরাজয় স্বিকার করে একটা পাগলের সাহায্য চাইছে ! কিন্তু মনসুর পাগলা বেশ উৎসাহ নিয়ে বলে উঠলো !
” পৌঁছায় দিতে পারি কিন্তু যাইতে যাইতে আমার গল্প শুনতে হবে ! গল্প না শুনিলে পৌঁছায় দিবো না ! “
গল্প শোনা এ আর এমন কি কঠিন কাজ ! এমনিতেও গল্প শুনতে আমার বেশ ভালো লাগে ! ভয়ানক ঘুটঘুটে রাস্তায় এঁগিয়ে দেয়ার বিনিময়ে গল্প শোনার চুক্তিতে সম্মতি পেয়ে গল্প বলা শুরু করলো মনসুর পাগলা !
মনসুর পাগলার গল্পগুলা ছোট ছোট ঘটনার অবলম্বনে এবং বেশ ভয়ানক ধরনের ! তার গল্পের কমন একটা বৈশিষ্ঠ্য হলো সব গুলো গল্পে দুটা চরিত্র থাকে , একটা মানুষ আরেকটা পিশাচ , এবং গল্পের শেষে মানুষটা পিশাচের হাতে মারা যায় ! এসব গল্প শোনার মতো যথেস্ট পরিমান উপযুক্ত পরিবেশ এই ঘুটঘুটে অন্ধকার নির্জন রাস্তায় নেই ! কিন্তু চুক্তি যখন করে ফেলেছি গল্প তখন শুনতেই হবে , নইলে আমাকে একা ফেলে মনসুর পাগলা চলে যাবে ! আর তখন এই অন্ধকার পথে আমাকে একা বাকি পথটুকু চলতে হবে, যেটা আমার জন্য এখন বেশ কঠিন , কারন মনসুর পাগলার কাছ থেকে ইতিমধ্যে শোনা কয়েকটা গল্প আমার নরম মনটাকে আরও বেশি দুর্বল করে ফেলেছে ! পথ চলার সাথী হওয়ার শর্ত জুড়ে দিয়ে এক অদ্ভুত কৌশল খাটিয়ে মনসুর পাগলা আমাকে তার ভয়ানক গল্পগুলো শুনতে বাধ্য করছে !
মনসুর পাগলা এখন যে গল্পটি বলছে সেটা একজন মানুষের অন্ধকার পথে একা একা চলার গল্প ! লক্ষ্য করলাম গল্পের পটভুমি ও প্রেক্ষাপটের সাথে এই মুহুর্তে আমার অবস্থান করা ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পের এই রাস্তা আর পরিবেশের বেশ সাদৃশ্য রয়েছে ! গল্পের প্রধান চরিত্র একজন অফিস কর্মি যে কিনা জরুরী কাজে নির্জন অন্ধকার একটি রাস্তায় পথ চলছিলো ! পথের মধ্যে সে একটা লোকের দেখা পায় যে তাকে এঁগিয়ে দেয়ার কথা বলে , কিন্তু কিছুদুর যাওয়ার পর দেখা গেলো সেই সাহায্যকারি মানুষটি আসলে কোন মানুষ নয় সে আসলে পিশাচ !!! পিশাচ এর সাথে ধস্তা ধস্তির একটা পর্জায়ে সেই অফিস কর্মি মানুষটির গায়ের জামা ছিরে যায় পায়ের জুতা খুলে যায় ! এবং একসময় সে পিশাচের শক্তির কাছে হাড় মানে ! এরপর পিশাচ সেই লোকটির ঘারে কামর বসিয়ে তার শরীরের সমস্ত রক্ত চুষে খেয়ে ফেলে আর একটা ঝোপের কাছে মানুষটির মৃতদেহ ফেলে রাখে ! গল্পের এই পর্জন্ত বলেই সে হাত উঁচিয়ে আঙুল দিয়ে রাস্তার পাশের একটা ঝোপ এর দিকে আঙুল নির্দেশ করলো , যেন সে বোঝাতে চাইলো এই সেই ঝোপ যেখানে মানুষটির মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছিলো ! মনসুর পাগলার গল্প বলার ধরন আর বিস্তারীত বর্ননা শুনলে যে কোন মানুষ ভয় পাবে তার উপর রাস্তার চার পাশের পরিবেশও বেশ গা ছম ছমে !
আমি বলে উঠলাম ” মনুসর সাহেব ! আপ্নার গল্প বলার ধরন বেশ ভয়ানক ! আমি বুঝতে পারছি আপ্নি আমাকে গল্প বলে ভয় দেখাতে চাইছেন ! আমি যে কিছুটা ভয় পাইনি তা কিন্তু নয় ! তবে কিনা গল্প তো গল্পই তাই না ? ঝোপের দিকে আঙুল দেখিয়ে সেটাকে আরও বাস্তবতার স্বাদ মাখানোর চেস্টা করাটা একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে না ? ! “
আমার কথা শেষ হতেই মনসুর পাগলা প্রতিবাদ করে উঠলো ! বললো “ আমার বলা প্রতিটা গল্প সত্যি ঘটনা । এখানে কোন কিছু মিথ্যা নয় “
আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না ! বললাম “ কি করে সত্যি হয় ? আপ্নার গল্পে দুইটা চরিত্র , এর একটা মানুষ আরেকটা পিশাচ ! মানুষটা মারা যাওয়ার যে বিবরন আপ্নি দিচ্ছেন সেটা আপ্নি কি করে দেখলেন ? মৃত মানুষটা নিশ্চই আপ্নাকে এসে বলে যায়নি ? কারন মানুষটা তো পিশাচের হাতে ঘটনার সময় মারা গিয়েছে তাই না ? “
আমার প্রশ্ন শুনে মনসুর পাগলা জ্বলজ্বল চোখে আমার দিকে তাঁকিয়ে রইলো ! মোবাইলের টর্চের আলোয় দেখলাম তার মুখে অর্থপুর্ন হাসি ! যেন সে বলতে চাইছে ” আর কেউ না জানুক পিশাচটা তো জানে কোন মানুষটা কি ভাবে মারা গিয়েছে ! আর সে ই এক মাত্র যে কিনা ঘটনার , হুবহু বিবরন দিতে পারবে ! “
মহুর্তের জন্য আমি স্তম্বিত হয়ে গেলাম ! আমার পথ চলা থেমে গেলো ! সেই কয়েকটি মুহুর্তে মনসুর পাগলা আমার থেকে কয়েক কদম সামনে এঁগিয়ে গেলো ! মনসুর পাগলা হতে মাত্র কয়েক ফুট দুরত্ব যেন আমায় বাঁচার অনুপ্রেরনা দিলো ! আমি আর সামনের দিকে এগোলাম না , মুহুর্তেই আমি ঘুরে পেছন দিকে অর্থাত যে দিক হতে আসছিলাম সেইদিকেই উল্টো দৌড় দিলাম !
এরপর ছুটতে শুরু করে দিলাম মনসুর পাগলাকে পেছনে ফেলে ! হোক সে পিশাচ অথবা পাগল , আমাকে এই পরিবেশ হতে, মুক্ত নির্মল পরিবেশে যেতে হবে ! ছুটতে ছুটতে শুনতে পেলাম মনসুর পাগলা বলছে আর একটি গল্প শুনে যান এই গল্পটা আরও ভয়ের গল্প বলেই অট্টহাসি দিতে লাগলো ! ছুটতে ছুটতে একসময় আমার শক্তি শেষ হয়ে আসা টের পাচ্ছিলাম , আমি রাস্তার মধ্যে বসে পরলাম আর এমন ভাবে হাপাচ্ছিলাম যে কথা বলার শক্তি ছিলো না ! এভাবে অনেকটা সময় কেটে গেলো একসময় আমার শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে আসলো ! মনের ভেতর অদ্ভুত সাহসের উদয় হলো ! বুঝলাম না কোথা হতে আসলো এতো সাহস !!!! মনে হলো মনসুর পাগলাকে একটা শিক্ষা দেয়া উচিত ! এভাবে রাত বিরাতে মানুষকে ভয় দেখানো ভালো কাজ নয় ! আর যদি সে পিশাচ হয়েও থাকে তবে সেই পিশাচকেও দেখে নেওয়া হবে !
মোবাইলের টর্চটাকে জ্বেলে সামনের পথটা আলোকিত দিকে হাঁটতে লাগলাম! শরীরের রাগ মনকে শক্তিশালী করেছে ঠিকই কিন্তু চোখকে করে ফেলেছে অন্ধ ! তাই তো টর্চের আলোয় সামনের পথ খুব বেশি আলোকিত মনে হচ্ছে না ! কিন্তু তবুও বিপদের দিকেই হাঁটছি একসময় মনসুর পাগলাকে যেখানে রেখে ছুটে পালিয়ে গিয়েছিলাম সেখানে পৌঁছে গেলাম ! কিন্তু মনসুর পাগলাকে কোথাও দেখতে পেলাম না ! হয়তো সে অন্য দিকে চলে গেছে পথের অপর প্রান্তে নতুন কোন পথিককে ভয় দেখাতে ! আমি আবারও সামনে এগোতে লাগলাম ! হঠাৎ অন্ধকারে পায়ের সাথে কিছু লেগে হোচট খেয়ে উল্টে পরে গেলাম !
মনে হলো একটা মানুষের দেহ আর সেটাতে আমার পা জরিয়ে আমি পরে গেছি ! মাটিতে শুয়ে পরা হতে কোনরকম উঠে রাস্তায় পরে থাকা আমার মোবাইলটা তুলে মাটিতে থাকা বস্তুটার দিকে তাক করতেই দেখি একটা পুরুষ মানুষের দেহ মাটিতে পরে আছে !
কাছে গিয়ে লোকটার বুকে কান পাতলাম , হাতের নারি পরীক্ষা করলাম ! নাহ লোকটা মৃত ! লোকটার মুখের উপর টর্চের আলো ফেলতেই চমকে উঠলাম ! মাটিতে শূয়ে থাকা সেই লোকটা আর কেউ নয় সেটা আমি ! আমিই রাস্তায় মৃত অবস্থায় পরে আছি !
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।