ছোট্ট পাখি

একবার খুব বৃষ্টি হয়েছিল, মনে আছে? ওই যে সারাদিন সারারাত বৃষ্টি হলো! খেলার মাঠ পানিতে ডুবে গেল, আর স্কুল বন্ধ হয়ে গেল বলে আমরা ঘরে বসে রইলাম, মনে আছে?

সেই বছরের ঘটনা।

অমন বৃষ্টিতে এক কৃষকের সব ফসল তলিয়ে গেল পানির নীচে। তার কাছে টাকা-পয়সা নেই। ঘরে খাবারও নেই। এখন কী হবে! ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয়ে গেলে সে বাঁচবে কেমন করে? বেচারা চাষী মন খারাপ করে ঘরে বসে রইল। আর এদিকে খিদেয় তার পেট চোঁ চোঁ করছিল।

‘ইস, এখন যদি একটা কিছু খেতে পেতাম?’- কৃষকটি মনে মনে ভাবল।

সে যখন এসব কথা ভাবছিল, তখনি কোথা থেকে একটা পাখি উড়ে এল তার উঠোনে। ছোট্ট একটা পাখি। কৃষকটির চোখ চকচক করে উঠল। সে তাড়াতাড়ি ছুটল পাখিটিকে ধরতে। ‘যত ছোটই হোক, পাখির মাংশ তো খাওয়া যাবে’, খুশিতে চেঁচিয়ে উঠল সে!

সে ভেবেছিল, ধরতে গেলেই বুঝি পাখিটি উড়ে যাবে। ওমা, এ পাখি যে উড়তে পারেনা! কে যেন এর গায়ে ঢিল ছুঁড়ে মেরেছে। তাই ডানা ভেঙে গেছে । সে আর উড়তে পারছে না। পাখিটিকে দেখে কৃষকের খুব মায়া হলো। পেটে খিদে থাকুক, কিন্তু কিছুতেই সে পাখিটিকে মারতে পারবেনা। আহারে! এতটুকু পাখিকে কেউ এমন করে ব্যথা দেয়!

সে পাখিটির ডানায় এক টুকরো কাপড় বেঁধে দিল। তারপর বলল, ‘আস্তে আস্তে উড়ে যা পাখি। সাবধানে থাকিস।’

সে রাতে কৃষকের চোখে ঘুম নেই। পেটে খিদে নিয়ে ঘুমানো যায়? সে বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করতে লাগল। এমন করে রাত যখন গভীর হলো, তখন কে যেন কড়া নাড়ল তার দরজায়।

‘এত রাতে কে এলো?’- কৃষক ভাবে।

সে দরজা খুলে দেখল ফুটফুটে এক ছোট্ট মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

কৃষক বলল, ‘কী চাই গো খুকী?’
মেয়েটি বলল, ‘আমাকে কিছু খেতে দেবে? খুব খিদে পেয়েছে আমার।’
কৃষক বলল, ‘আমার ঘরে যে কোনো খাবার নেই!’
মেয়েটি বলল, ‘আমাকে থাকতে দেবে তোমার বাড়ীতে? আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি।’
কৃষক বলল, ‘আমার যে একটাই ঘর!’

কৃষকের কথা শুনে মেয়েটি চলে যাচ্ছিল। তার চলে যাওয়া দেখে খুব মায়া হলো কৃষকের। সে ভাবল, শুধু একটা রাতই তো কষ্ট হবে! থাকুক মেয়েটি।

মেয়েটিকে ঘরে থাকতে দিয়ে কৃষক সারারাত উঠোনে বসে রইল। টুপটাপ বৃষ্টি পড়ল তার মাথায়। সে ভাবল লাগল, ‘আহা, ক্লান্ত মেয়েটা ঘুমাক! কত পথই না হেঁটেছে সে!’

ভোর রাতের দিকে বৃষ্টি-কাঁদার মাঝেই ঘুমিয়ে পড়েছিল কৃষক। সকালে তার ঘুম ভাঙল মেয়েটির ডাকে।

মেয়েটি বলল, ‘আমি একটা চাদর বুনেছি রাতে। তুমি এটা বাজারে বিক্রি করে কিছু খবার কিনে আনো।’
কৃষক দেখল, দারুণ সুন্দর একটা চাদর মেয়েটির হাতে। সে খুব আবাক হয়ে বলল, ‘এটা তুমি বানিয়েছো? কিন্তু আমার ঘরে তো চাদর বানানোর মতো কিছুই নেই। তাঁত নেই, এমনি এক টুকরো সূতোও নেই!’
মেয়েটি বলল, ‘তা জানি!’
কৃষক বলল, ‘তাহলে কি করে বানালে এই চাদর?’
মেয়েটি বলল, ‘কিছু জানতে চেয়ো না। তুমি তাড়াতাড়ি কিছু কিনে আনো বাজার থেকে। তোমার নিশ্চয় অনেক খিদে পেয়েছে?’

কৃষক বাজারে গেলে লোকজন অবাক হয়ে হলো চাদরটি দেখে। সবাই বলাবলি করল, এত সুন্দর চাদর নাকি তারা আগে দেখেনি। একজন লোক অনেক দাম দিয়ে চাদরটা কিনে নিল। আর কৃষক সেই পয়সা দিয়ে খাবার কিনল। আর বাড়তি পয়সা দিয়ে কিনল কাপড়-চোপড়, আর এক জোড়া জুতো।

সে বাড়ী ফেরার পথে ভাবতে লাগল, মেয়েটি খুব অদ্ভূত! কী করে বানাল সে এই চাদর?

অনেক খুশি সে এখন। সে গান গাইতে গাইতে বাড়ী ফিরে এলো। আর মেয়েটিকে বলল, ‘আমার আরো চাদর চাই।’
মেয়েটি বলল, ‘কী হবে এত চাদর দিয়ে?’
কৃষক বলল, ‘আমি ধনী হতে চাই।’
মেয়েটি বলল, ‘তার চেয়ে এক কাজ কর, মাঠ থেকে বৃষ্টির পানি নেমে গেলে আবার ফসল ফলাও। দেখবে তোমার সব অভাব দূর হয়ে যাবে।’
কৃষক বলল, ‘আমি শিগগির বড়লোক হতে চাই। পেটে খিদে নিয়ে থাকতে আর ভাল লাগেনা। আমাকে অনেক চাদর বানিয়ে দাও।’
মেয়েটি বলল, ‘তবে তাই হোক! শুধু একটাই শর্ত, তুমি জানতে চেয়ো না কিভাবে আমি চাদর বুনোই।’
কৃষক মাথা নেড়ে বলল, ‘ঠিক আছে।’

সেই রাতেও কৃষকের চোখে ঘুম নেই। অনেক টাকা হলে কোথায় কোথায় বেড়াতে যাবে, কেমন পোষাক পড়বে- সে এসব ভাবছিল। এই রাতটুকু পার হলেই সে বড়লোক হয়ে যাবে, কৃষকের আনন্দ আর ধরে না।

আর ওদিকে মেয়েটি ঘরের ভেতর চাদর বুনছিল।

ভোরের দিকে কৃষক উত্তেজনায় আর বসে থাকতে পারল না। আর একটু পরেই ধনী হবে সে! কৃষক আনন্দে লাফাতে লাগল। নাচতে লাগল। তারপর ভাবল, যাই একটু উঁকি দিয়ে দেখে আসি কয়টা চাদর বুনলো মেয়েটা?

কৃষক পা টিপে টিপে দরজার আড়ালে দাঁড়াল। তারপর ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখল, মেয়েটি ঘরে নেই। তার বদলে সেখানে বসে আছে সেই ছোট্ট পাখিটি, যাকে সে একদিন বাঁচিয়ে ছিল।

কৃষক দেখল, পাখিটি নিজের শরীর থেকে একটা একটা করে পালক তুলে আনছে। আর ব্যথায় কাঁদছে।

কৃষক দরজায় দাঁড়িয়ে আছে, পাখিটি টের পেয়েছিল। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালা দিয়ে উড়ে চলে গেল। আর কৃষক তাকিয়ে রইল পড়ে থাকে পাখির পালকের দিকে।
তারপর থেকে কৃষকটি বসে আছে সেই অদ্ভূত পাখিটির জন্য।

পাখিটি আর কোনোদিন ফিরে আসেনি।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!