ওরা দুজন
আলস্য আর সমবেদনা একে অপরকে জড়িয়ে শুয়েছিল। নরম রোদ এসে পড়ছিল শিশুগাছটার পাতার ফাঁক দিয়ে। সেই রোদে গা এলিয়ে পড়েছিল ওরা। এদিকে ফরিদ মিয়াকে হাটে যেতে হবে। ডজনখানেক দাড়িওয়ালা ছাগলকে সঙ্গে নিয়ে নিজের ছাগল দাড়িটা চুমরে নিয়ে ফরিদ ওদের সামনে এসে বললে “একটু রাস্তাটা ছাড়েন দেখি…”
ওরা নড়তে চায়না।
গোরুর গাড়ি হাঁকিয়ে এসে হাজির হল রামশরণ সিং। চড়া গলায় বলল – “সরে যান সরে যান! তাড়া আছে আমার…” একটু নড়ে চড়ে আবার গা এলিয়ে দিল ওরা।
মজিনা কলসি কাঁখে জল আনতে যাচ্ছিল ঘাট থেকে। সঙ্গে তার চার বছরের ছেলে ওসমান। পুরোনো সাইকেলের একখানা টায়ারকে কাঠি দিয়ে চালাতে চালাতে সে দৌড়চ্ছিল আগে আগে। ওদের ওপর দিয়েই চালিয়ে দেয় প্রায়।
উফফ… এদের নিয়ে তো পারা যায়না! উঠে বসল এবার ওরা দুজন। রাস্তা থেকে একটু সরে গিয়ে গাছতলাটায় গিয়ে বসল।
ফরিদ ছাগলের পাল নিয়ে কি একটা গান গুনগুন করতে করতে হাটের দিকে চলে গেল। রামশরণ গোরুর পিঠে চাপড় মারল, ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দে রওনা দিল তার গাড়ি। ওসমানের পিছন পিছন মজিনা ঘাটের দিয়ে হাঁটা লাগাল।
গ্রামের গায়ে গতরে খাটা লোকগুলো সব লেগে পড়ল নিজের নিজের কাজে। আলস্য আর সমবেদনা জড়াজড়ি করে পড়ে রইল গাছের তলায়।
অনন্যা
সেদিনের সেই অন্ধকার সন্ধে। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। সঙ্গে লোডশেডিং। আমার মনের ভিতরেও অন্ধকার। সদ্য খবর পেয়েছি দ্বিতীয়বারের চেষ্টাতেও আমার আই আই টি তে হয়নি। ছোটোবেলা থেকে মনের কোণায় পুষে রাখা স্বপ্নটা আর সত্যি হবেনা, ভাবতেই গলাটা কেমন ব্যথা ব্যথা করছে।
বাড়ির বারান্দায় বসেছিলাম অনন্যার সাথে। বাবা মা অফিস থেকে ফেরেনি এখনও। একাকিত্ব কাটানোর জন্যেই ফোন করে ডেকে নিয়েছিলাম ওকে।
অনন্যা আমারই ক্লাসমেট, বন্ধু। হাসিখুশি, প্রাণোচ্ছ্বলতায় ভরা। গত দু বছর ধরে চিনি ওকে, কখনও কিছু নিয়ে ডিপ্রেসড হতে দেখিনি। ওর নীরব উপস্থিতিটাই নিজেকে সামলাতে সাহায্য করছে আমায়।
– “আচ্ছা শঙ্খ, একটা কথা বল তো দেখি…” হঠাৎ বলে উঠল অনন্যা, “আমরা তো এত গুলো বছর কাটিয়ে দিব্যি অ্যাডাল্টহুডে পা দিলাম। এই আঠেরো বছরের জীবনে তোর সবচেয়ে আনন্দের আর সবচেয়ে দুঃখের দিন কোনটা?”
– “উমম… সবচেয়ে আনন্দের দিন তো সেভাবে বেছে নিতে পারব না… তবে সবচেয়ে দুঃখের দিন নিঃসন্দেহে আজকের দিনটা।”
মৃদু হেসে অনন্যা বলল – “তুই শিওর? সদ্য পাওয়া আঘাত বলে তীব্রতাটা বেশি লাগছে না তো?”
– “না রে, কোনো সন্দেহই নেই” জবাব দিলাম আমি।
আবার কিছুক্ষণ নীরবতা। বারান্দার কোণে একটা মোমবাতি জ্বলছিল। সেটার আলোয় যেন চকচক করছিল ওর চোখদুটো।
– “কি ভাবছিস?” জিজ্ঞেস করলাম।
– “কিছু না রে…”
হঠাৎ ঝড়ের দমকায় দপ করে নিভে গেল মোমবাতিটা। অন্ধকার মানুষকে স্বস্তি দেয়। দ্বিধা থেকেও বোধহয় মুক্তি দেয়। যে প্রশ্নটা করব করব করে দোনামনা করছিলাম, সেটা করেই ফেললাম – “তোকে যদি একই প্রশ্ন করি, কি উত্তর দিবি?”
– “আমার কথা ছাড়। আমি তো পাগলি নাম্বার ওয়ান।”
– “তবু?”
একটু ভেবে অনন্যা বলল, “আমি যখন সাড়ে চার বছরের, তখন একদিন বাবার সঙ্গে মেট্রোয় চেপে এস্প্ল্যানেড গেছিলাম। সেই প্রথম আমার মেট্রোয় চড়া। এরকম অভিনব ট্রেন, যা কিনা মাটির নীচ দিয়ে চলে, দেখে বেশ উত্তেজিত হয়েছিলাম। হাজারো প্রশ্ন করে বাবাকে উত্যক্ত করছিলাম, আর বাবা হাসিমুখে উত্তর দিচ্ছিল সব প্রশ্নের। ছেলেবেলায় বাবা ছিল আমার কাছে হিরো, যে সব প্রশ্নের উত্তর জানে, সব খারাপ শক্তিকে দূরে সরিয়ে আমায় আগলে রাখতে পারে। এস্প্ল্যানেডে গিয়ে শহীদ মিনার দেখে আরো উচ্ছসিত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম – ‘এর মাথায় চড়া যায়?’ বাবা বলেছিল না, ওপরে কাউকে উঠতে দেওয়া হয়না। এই ধরনের মনুমেন্টের মাথায় চাপতে গিয়ে এত রকম দুর্ঘটনা ঘটেছে… সেই দুর্ঘটনার গল্প শুনতে শুনতে প্রথম সত্যিকারের উপলব্ধি করেছিলাম মৃত্যু কিরকম হয়। মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেছিল তারপর… কিন্তু তবু বাবা সঙ্গে আছে, এই কথা মনে করেই আবার কেটে গেছিল সব ভয়… সুখ-দুঃখ-আনন্দ-উত্তেজনা-ভয় সব মিলে সেই দিনটা আমার কাছে খুব স্পেশাল। এক ধাপে অনেক কিছু শিখে যাবার দিন… অবিমিশ্র আনন্দ হয়তো নয়, তবু যতবার ওই দিনটার কথা মনে করি, একটা অদ্ভুত ভাল লাগা অনুভব করি…”
– “আর সবচেয়ে দুঃখের দিনটা?”
– “সেও বাবাকে ঘিরেই। বাবা যেদিন চলে গেল… না সেই দিনটা নয়… তার পরের দিনের কথা…
পুলিশ এসে মা-কে ধরে নিয়ে গেল। আমি তো আতঙ্কে অবশ। পাশের বাড়ির জীবন কাকুর বাড়িতে ছিলাম সেদিনের সন্ধেটা। কাকুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘ওরা মাকে নিয়ে গেল কেন?’ ‘কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে, ছেড়ে দেবে একটু পরই, চিন্তা নেই।’ কিসের জিজ্ঞাসাবাদ জানতে চাওয়ায় সত্যিটা আমায় বলে দিয়েছিল জীবন কাকু, হয়তো আমি তখন একটু বড় হয়েছি সেই ভরসাতেই। সেদিন জানতে পেরেছিলাম, আমার বাবা, সব বিপদের হাত থেকে আগলে রাখা আমার হিরো, আসলে মাদকদ্রব্যের চোরাচালান করত। ওই দলেরই একজনের গুলিতে মারা যায় বাবা…
সেই সন্ধেটা এক লহমায় বদলে দিয়েছিল অনেক কিছু।”
পাঁচ মিনিট পর নীরবতা ভাঙল অনন্যাই – “উঠি রে, বৃষ্টিটা একটু ধরেছে। বাড়ি ফিরতে হবে।”