ছোট্ট গল্প ২

আড্ডা দীপক সেদিন বলছিল “এই শহুরে বাঙালিগুলো আঁতলামি করে করেই গেল। আর্ট ফিলিম না হলে দেখবে না, এমন নাক উঁচু। আরে ভাই, কমার্শিয়াল সিনেমা না দেখতে গেলে ইন্ডাস্ট্রিটা চলবে কি করে?” অনেকেরই পছন্দ হল না কথাটা। গরম বাক্য বিনিময়ে জমে উঠেছিল চাটুজ্জেদের বৈঠকখানা। রুদ্র আমাদের মধ্যে একটু ডাকাবুকো সৎ স্বভাবের ছেলে বলে পরিচিত। সেই সঙ্গে ঠোঁটকাটাও বটে। যা মনে আসে বলে দেয়, পলিটিকাল কারেক্টনেসের ধার ধারেনা। সেদিন রুদ্র বলছিল “শালা দেশটা চোরে ভরে গেছে! মন্ত্রী থেকে বাড়ির কাজের লোকটা পর্যন্ত সব চোর। পুলিশে যে ধরবে, তারও উপায় নেই, পুলিশও ত চোর। আগেকার দিনে চোর ধরতে পারলে গণপিটুনি দিত, সেইটেই ভাল ছিল…”

কে একটা বলার চেষ্টা করছিল “যাদের পিটুনি দিত তারা তো বেশিরভাগই অভাবে স্বভাব…” “কিসের অভাব শালা?” থামিয়ে দিয়ে রুদ্র বলেছিল, “ওসব কিছুই না। লোভ লোভ! লোভে পাপ…” আরেকদিনের কথা। চৌবের বাড়ির বারান্দায় আড্ডা বসেছে সেদিন। শামসুর বলছিল “এই ওয়েস্টার্ন ব্যাপারস্যাপার আমাদের মধ্যে ঢুকে কালচারটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রি ম্যারিটাল সেক্স যে হারে শুরু হয়েচে, সবাই এখন বিয়ের আগেই ভার্জিনিটি হারিয়ে বসে থাকে। নোংরামো এমন জায়গায় চলে গেছে সুপ্রীম কোর্টও লিভ টুগদারকে হরেদরে সমর্থন করছে। কি অবস্থা! সব শালা ফ্রাস্ট্রেটেড মাল!” ভারতীয় সংস্কৃতির এই অধঃপতন নিয়ে অনেকেই একমত হয়েছিল।
আমি একটু ট্যাঁ ফোঁ করতে যাওয়ায় একঘরে হয়ে গেছিলাম। এই শনিবারের আড্ডাটা আমার বাড়িতেই বসেছিল। আবার নানারকম তর্কবিতর্কে আসর সরগরম। মায়ের করা ফুলকপির সিঙাড়া সহযোগে আলোচনা চলছিল। আসর ভাঙলে পরে ওদের এগিয়ে দিতে গেছিলুম গেট অব্ধি। বেরোনোর মুখে রুদ্র বললে “অ্যাই রাগিনি এম এম এস ২ দেখেছিস?” আমি বল্লুম “না, কিরম হয়েছে? জানিস কিছু?” দীপক হাসতে হাসতে বলল “অত জানি না বস, দেখবার মত তো হবেই, সানি লিওন আছে আফটার অল।” রুদ্র বলল “লিঙ্ক আছে? পেলে পাঠাস তো।” দীপক বলল “হ্যাঁ একটা টোরেন্ট পেয়েছি। আজ ডাউনলোডে বসাব।” “লিঙ্কটা আমাকেও পাঠাস কিন্তু অবশ্যই” – বললে শামসুর।

সেই গানটা সেই গানটা আজকেও বাজছে সকাল থেকে। কোথায় বাজছে ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা, অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে আওয়াজ। উঠে জানলাটা বন্ধ করে দিল শঙ্কর। গানটা শুনলেই মাথাটা গরম হয়ে যায় ওর। কেন কে জানে? কিছুতেই মনে করতে পারেনা কেন গানটার উপর এত রাগ ওর। মাথার ভিতর দুমদুম করে হাতুড়ির বাড়ি পড়তে থাকে। কানে আঙ্গুল চেপে ধরে ও। প্রবল চেষ্টা করতে থাকে মনে করার, কোথায় শুনেছে এই গানটা। কেন এটা শুনলেই এরকম অস্থির লাগে। কিছুতেই মনে পড়েনা। আর তাতেই আরও পাগলের মত লাগতে থাকে ওর। কদিন আগে পুজোর সময় লাউডস্পীকারে গানটা চালিয়েছিল পাড়ার শান্তি সংঘের ছেলেগুলো। কিছুক্ষণ সহ্য করার চেষ্টা করে আর নিজেকে সামলাতে পারেনি শঙ্কর। প্রায় কাঁচা খিস্তিই দিয়ে এসেছিল ছেলেগুলোকে। এরকম অত্যাশ্চার্য আক্রমণে হতবাক হয়ে ছেলেগুলো হাঁ হয়ে গেছিল। বলেছিল “আচ্ছা কাকু, পালটে দিচ্ছি গানটা।” লোকে বলাবলি করে, শঙ্করদার মাথাটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
সবই জানে শঙ্কর, কিন্তু কিছুই সামাধান খুঁজে পায়না। নিজেকে অসহায় লাগে বড্ড। সন্ধ্যাবেলা কৃষ্ণার আসার কথা ছিল। সে এসে দেখে মাথার দুদিকে হাত দিয়ে শুয়ে রয়েছে শঙ্কর। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করায় উত্তর পাওয়া গেল “মাথাটা খুব যন্ত্রণা করছে।” “আবার সেই গানটা শুনেছ বুঝি?” ম্লান হাসল শঙ্কর। কিকরে জানি ওর মনের সব কথা বুঝে ফেলে কৃষ্ণা। মেয়েটা বড় ভাল। সবিতা মারা যাবার পর আর কাউকে এত ভালবাসেনি সে। কিন্তু সবিতাকে কখনও ভুলতে পারবেনা শঙ্কর। তাই জোর করেই নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে কৃষ্ণার থেকে। “একটু চা করে আনি, ভাল লাগবে”, বলে চলে গেল কৃষ্ণা। একটু পর যখন চা নিয়ে এল তখন শঙ্কর একদৃষ্টে চেয়ে আছে বেডসাইড টেবলে রাখা সবিতার ফোটোটার দিকে।

চার বছর আগে হরিদ্বারে ওদের শেষবার বেড়াতে যাবার ছবি। সেবারই হয় গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টটা। “ওই শকটা আজও তোমায় তাড়া করে বেড়ায়, না শঙ্কর দা?” জিজ্ঞেস করল কৃষ্ণা… “কিছু যদি শেয়ার করতে চাও আমার সঙ্গে তো করতে পারো… কখনো তো কাউকে বলনি কিছু সেই দিনটা নিয়ে। বললে হয়তো একটু হাল্কা লাগবে…” “কি আর বলব… সেই দিনটা… গাড়িটা আমিই ড্রাইভ করছিলাম… নাহ থাক…” বলতে বলতে হঠাৎ চমকে উঠে বসল শঙ্কর… “এও কি সম্ভব? হ্যাঁ এটাই সম্ভব!” -“কি?” -“সেদিন গাড়ির ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজছিল এই গানটাই…

আর সেইজন্যেই… উফ!” সত্যিই অনেকটা হাল্কা লাগছে শঙ্করের। এতদিনে ও বুঝতে পেরেছে ওর সেই গানটার প্রতি ওই অ্যালার্জির কারণ। আর বোধহয় ওরকম পাগল পাগল লাগবেনা। এবার বোধহয় স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারবে ও… – “থ্যাঙ্ক ইউ কৃষ্ণা…” অস্ফুটে বলল শঙ্কর। মৃদু হাসল কৃষ্ণা। খালি চায়ের কাপটা রান্নাঘরে নামিয়ে আসার জন্য উঠে পড়ল। গানটা যে গত বছর পুজোয় রিলিজ হয়েছে সেটা শঙ্করদাকে বলা বোধহয় উচিত হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়তে পারেন...

আবিষ্কার

১ ‘ টুবলু, টুবলু, টুবলু উ উ উ ‘ মার গলা, অনেকক্ষন ধরেই শুনতে পাচ্ছি। …

সরল ও হাতি

সরল এখন খুব খুশি । কারণ সরল ইশকুলে ভর্তি হয়েছে । বাবু সরলকে ইশকুলে যেতে…

পুষুর দুঃস্বপ্ন

আলমারির তাকে থরে থরে সাজানো মধুভর্তি বয়ামগুলোর দিকে তাকিয়ে পুষুর দু চোখ চকচকিয়ে উঠলো। ‘কি…