মধ্যরাত। সময়টা আনুমানিক সাড়ে বারোটা প্রায়। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। মেঘের রাশি থেকে বেরিয়ে আসা পানির ফোঁটাগুলো প্রচন্ড বেগে আঘাত হানছে কনস্টেবল নিজামের গায়ে। কিন্তু শরীরের উপর হালকা স্বচ্ছ রেইনকোট থাকায় পানির ক্ষুদ্র ফোঁটাগুলো তাকে ভিজিয়ে দিতে পারছে না। নির্ঘুম চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে রাস্তার বাঁকটা পার হলো সে। এবং সাথে সাথেই থমকে দাঁড়াল। সামান্য কিছুটা দূরেই ঘন কালো রেইনকোট পড়ে রাস্তার উপর ঝুঁকে আছে একটা লোক। লোকটার ঝুঁকে থাকা মাথার নিচে রাস্তার উপর আরেকজন ব্যক্তির অবয়ব বোঝা যাচ্ছে দূর থেকেই। তবে, কনস্টেবলের থমকে যাওয়ার কারণ হলো – ঝুঁকে থাকা লোকটার ডান হাত রাস্তায় শায়িত লোকটার ঠিক বুকের মাঝখানের উপর এবং সে হাতে প্রথম লোকটা একটা ছোটখাট বস্তু ধরে আছে। দূর থেকে দেখে, নিজামের একটুও বুঝতে বাকি রইল না – লোকটার হাতে মানুষের হৃদয়। হার্ট।।
আতংকে কিছুক্ষণের জন্য হিম হয়ে গেল নিজাম। তারপর পা সামান্য বাড়াতেই দ্রুত তার দিকে ফিরল ঝুঁকে থাকা লোকটা। নিজামের অস্তিত্ব অনুভব করতে তার বেশি সময় লাগেনি।।
লোকটার বাম পাশে পড়ে থাকা ছুরিটা খুঁজে নিয়ে যেই মাত্র সে উঠে দাঁড়াল, তখনই বন্দুকের বাঁট দিয়ে সজোরে তার মাথার পেছনে আঘাত করল নিজাম। জ্ঞান হারানোর আগে লোকটার কানে শুধু একটা ছোট বাক্যই পৌঁছাতে পারল – “শালা, পিশাচ!”
[1]
রিফাতের সামনে এই মুহুর্তে যে লোকটা বসে আছে তার মাথার প্রায় পুরোটাই সাদা ব্যান্ডেজে মুড়ানো। বসে আছে না বলে ‘বসিয়ে রাখা হয়েছে’ – বলাই মানানসই। কারণ লোকটার দুহাত পেছন দিকে শক্তকরে চেয়ারের সাথে বাঁধা। অজ্ঞান সে। পাশে রাখা জগটা থেকে আবারো রিফাত পানি ছিটিয়ে দিল লোকটার মুখে। এবার হালকা নড়ে নিজের জীবিত অবস্থা জানান দিল অজ্ঞাত ব্যক্তি।
প্রচন্ড বিরক্তির সাথে লোকটাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রস্তুতি নিল রিফাত। পুলিশের চাকরি প্রথম দিকে ভালো লাগলেও এখন কেমন জানি একঘেয়ে লাগে!
সারাক্ষণ অপরাধ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে এখন শত খুনের আসামির প্রতিও কোন ইন্টারেস্ট জাগে না। তবে, এই কেসটা কিছুটা ইন্টারেন্টিং মনে হচ্ছে রিফাতের কাছে। লোকটা মানব হৃদয় দিয়ে করেটা কি সেটা জানা দরকার!
একটু পরই পুরোপুরি চোখ খুলে স্পষ্ট দৃষ্টিতে সামনে তাকাল অজ্ঞাত আসামি। রিফাত এবং লম্বা একটা বন্দুক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কনস্টেবল নিজামের দিকে ক্রুদ্ধ চাহনি দিল সে। এমন সময় কর্কশ গলায় প্রশ্ন করে উঠল রিফাত, “নাম কি?”
“তূর্য।”-চোখ থেকে ক্রুদ্ধ চাহনি না সরিয়েই বলল লোকটা।
“তূর্যের আগে-পিছে কিছু নাই? পুরো নাম জিজ্ঞেস করছি।” – আবারো প্রশ্ন করল থানার ওসি। রিফাত।।
চোখ গরম করে জবাব দিল তূর্য নামধারী আসামি – “সেটা আমি আপনাকে বলতে বাধ্য নই!”
বিরক্তির চিহ্ন ফুঁটে উঠল রিফাতের কপালে। নিজেকে শান্ত রেখে আবার প্রশ্ন করল আসামিকে – “আপনার নিশ্চয় মনে আছে – গতকাল আমাদের কনস্টেবল নিজাম সাহেব তার ডিউটি পালনের সময় আপনাকে একজন মানুষের হার্ট হাতে থাকা অবস্থায় দেখেছিল। এবং সেই মানুষটা আপনার সামনে রাস্তায় মৃত অবস্থায় পড়ে ছিল। এখন বলুন তো – ঐ লোকটাকে আপনি খুন করে এমন পিশাচের মত তার হার্ট উপড়ে নিলেন কেন?”
রিফাতের প্রশ্ন এবং প্রশ্নের ভূমিকা শুনে তূর্যের চাহনি কিছুটা নরম হয়ে এলো। নরম গলায় বলে উঠল সে – “শুনবেন? শুনবেন আপনি আমি কেন খুন করেছি ওই হারামজাদাকে?”
“শোনার জন্যই জিজ্ঞেস করেছি। বলুন!” – বিরক্ত হয়ে বলল রিফাত।
হালকা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলা শুরু করল তূর্য – “আমি একটা মেয়েকে ভালবাসতাম। এখনো ভালবাসি। ওর সাথে আমার প্রথম দেখা হয় ভার্সিটি এডমিশন কোচিংয়ে…”
মাঝ পথে তাকে থামিয়ে দিল রিফাত – “আমি আপনাকে প্রেমকাহিনী বলতে বলিনি। মূল কাহিনী সংক্ষেপে বলুন!”
“সেটাই করছি!” – চোখ কুঁচকে বলল তূর্য – “মেয়েটার নাম ছিল নিশিতা। ওই কোচিংয়ে থাকাকালীন সময়েই ওর সাথে আমার রিলেশন হয়। রিলেশনের অনেক দিন পর – যখন আমরা উভয়েই ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হই – তখন জানতে পারি, ওর বাবা শুধু নামকরা ব্যবসায়ীই নয়, একইসাথে আন্ডারওয়ার্ল্ডের একজন ডনও। এর কিছুদিন পরই নিশিতা আমাকে শুধু একবার বলেছিল – ওর এবং ওর বাবার জীবন হুমকির মুখে। কারণ নাকি তার বাবা ওরই চাপে পড়ে বিশ্বাসঘাতকতা করে আন্ডারওয়ার্ল্ডের অনেকের পরিচয় গোয়েন্দাদের কাছে পাঠিয়ে দেন…”
এই পর্যন্ত বলে একটু থামল তূর্য। রিফাতের মনে পড়ল – গত প্রায় তিনমাস আগে সে পত্রিকায় একটা খবর দেখেছিল – “বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং তার কন্যা নিজ বাড়িতে খুন!”।। এছাড়া এরই কয়েকদিন আগে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ বড়সড় একটা অপরাধচক্রকে অ্যারেস্ট করতে পেরেছিল একজন অজ্ঞাতনামা লোকের সহয়তায়।। তাই, তূর্যের কথাগুলো কিছুটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো রিফাতের কাছে।।
আবারো বলা শুরু করল তূর্য – “এর পর দিনই নিশি আর ওর বাবাকে কে বা কারা যেন খুন করে ফেলল। মৃত্যুর আগে নিশি আমাকে একটা ম্যাসেজ দিয়েছিল। যেই ম্যাসেজে ও অথবা ওর বাবা – সব খুনীদের পরিচয় লিখে পাঠিয়েছিল আর বলেছিল রিভেঞ্জ নিতে। হ্যা, আমি ঐ কুত্তাগুলোকে খুঁজে বের করেছি। এবং প্রত্যেককে খুন করে তাদের হার্ট বের করে দেখেছি – ওদের হার্ট কত বড় যে আমার নিশিকে মেরে ফেলার সাহস পেলো!…”
তূর্যের চোখ দিয়ে প্রচন্ড বেগে অশ্রু বেরিয়ে এলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ময়লামাখা শার্টটার হাতা দিয়ে চোখ মুছায় মনোযোগ দিলো সে। এমন সময় রিফাত বলে উঠল – “নিজাম সাহেব, এই ছেলেটার যে মোবাইলটা পাওয়া গেছে সেটা একটু দিন তো!”
মোবাইলটা হাতে নিয়ে অন করল রিফাত। তার দিকে জিজ্ঞাসাসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তূর্য এবং নিজাম।
ফোনটা অন হতেই প্রথমে গ্যালারিতে ঢুকলো রিফাত। একটা প্রচন্ড সুন্দরী মেয়ের অসংখ্য সিঙ্গেল ছবি,তূর্যের কিছু ফটোগ্রাফ, সেই মেয়েটা এবং তূর্য নামধারী ছেলেটার কিছু ডাবল ফটোগ্রাফও পাওয়া গেল – সেখানে। আড় চোখে একবার তূর্যের দিকে তাকিয়ে রিফাত মনে মনে ভাবলো – “এই পাগলটাইপ ছেলেটা এত স্মার্ট ছিল! বিশ্বাস হয় না। তবে চেহারায় মিল আছে যথেষ্ট। কপাল বটে ব্যাটার, এমন মেয়ের সাথে প্রেম করছে!..”
এরপর ম্যাসেজ অপশনে ঢুকে ম্যাসেজগুলো দেখতে শুরু করল রিফাত। সেখানে গত দুই-তিন মাসের মধ্যে সিম অপরাটরের ম্যাসেজ ছাড়া আর কোন ম্যাসেজ নাই। তবে ঠিক তিন মাস তিন আগের একটা ম্যাসেজ পাওয়া গেল। ম্যাসেজটা এসেছে “নিশিতা” – নামে সেভ করা নাম্বার থেকে। আর ম্যাসেজটাতে মোট আটজনের নাম,ঠিকানা,ফোন নাম্বার – লেখা রয়েছে। এবং শেষের দিকে লেখা আছে – “রিভেঞ্জ নাও!”…
[2]
চিন্তিতমুখে ঘাড় ঘুরিয়ে নিজামের দিকে তাকাল রিফাত। লোকটার চোখ ছলছল করছে। এই লোক যেমন কঠোর, তেমন আবেগী। তূর্যের আবেগী কাহিনী শুনে কান্না করে দিচ্ছে – অথচ এই লোকই ছেলেটার মাথা ফাঁটিয়ে দিয়েছিল!
এবার তূর্যের দিকে তাকাল রিফাত। ছেলেটা কৃতজ্ঞ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হালকা কেশে নিরবতা ভাঙল রিফাত-ই, “তোমার কথাগুলো আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো। যদি সত্যিই হয়, তবে তুমি কোন অন্যায় করোনি। তাই, তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি। তোমাকে অ্যারেস্ট করার কথা আমরা তিনজন ছাড়া আর কেউ জানে না। তবে মনে রাখিও, এরপর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবে। এবং সেটা না করলে ফল ভালো হবে না!”…
এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে রিফাতের সাথে হ্যান্ডশেক করল তূর্য। তারপর অস্পষ্ট স্বরে বললো, “আপনার কথা আমার চিরদিন মনে থাকবে। নিশির মতোই।”..
তারপর ঘুরে হাঁটা দিল সামনের দিকে।
ছেলেটার চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অস্পুষ্টস্বরে বললো রিফাত – ‘দিন দিন আবেগ বেড়ে যাচ্ছে!”…