ছোটগল্প —- গৌতম যুথিপুত্র

“আরে এ মা , সুখিকাকা নাইরে , সুখিকাকা পলাইছে….আরে এ মা…সুখিকাকা পলাইছে বটে।

দু-পাশে বিস্তীর্ণ চাষের জমি । তার বুক চিরে চলে যাওয়া হাইওয়েটা শুয়ে আছে নিথর অজগরের মতো । দিন নেই রাত নেই দানবের মত বড় বড় ট্রাকগুলো দৌড়ে চলেছে সেই পথ বরাবর । রঘুনন্দনের নজর এল একদিন হঠাৎই ট্রাকগুলো সার বেঁধে দাঁড়িয়ে গেল রাস্তা্য়…একটার পর একটা , তারও পরে একটা । রঘুনন্দনের নিজের জমি নেই । অন্যের জমিতে খেতমজুরের কাজ করেই চলে তার সংসার । বাবুরা ভোটের সময় এসে আশ্বাস দেয় , এবার ভোটে জিতলেই তোরা বছরে একশো দিনের কাজ পাবি নিশ্চিত , সুতরাং…।নিরক্ষর রঘু্ ভোটের রাজনীতি খুব বোঝে , শুধু বোঝে না কত দিনে একশো দিন হয় ; ভোট বাবুরা বোঝায় একশো দিনেই তোদের বছর। আর জানে কাজ কাজ না জুটলে ফুলমনি আর ্বুধিয়াকে নিয়ে ভুখা থাকতে হয় ।

একদিন , দুইদিন ,তিনদিন….ট্রাকগুলোর নড়বার কোন লক্ষণই নেই । ড্রাইভার , খালাসি কয়েক’শ লোক হাইওয়েতেই পড়ে আছে । শুকনো খাবারেও তাদের টান পড়েছে। রঘুনন্দন অবস্থা বুঝে রাস্তার ধারে বাঁশ পুঁতে পলিথিনের চাদরে মুড়ে অস্থায়ী খাবারের দোকান খুলে ফেলল । সারাদিন তার দোকান চলে । ভোর হতেই বুধিয়া আর ফুলমুনিকে নিয়ে সে চলে আসে সেখানে । ভালই খদ্দের জোটে তার দোকানে । রঘু ভাবে কত লোক , কত বিচিত্র তাদের ভাষা । অবাক হয় রঘু ।

—কী হইয়েছে গো, হেথা কী মেলা লাগেছে ? ফুলমনি ঠিক বুঝে উঠতে পারে না ।

রঘু বলে , কী জানি , শুনতে পাই নেতারা রাস্তা জুড়ে মিটিং করছে আমাদের কাজের জন্য…..কাজ কবে পাবো সেটা মিটিং শেষ হলে বুলবে । এখন কাজে লাগ ; আটা মেখে ফেল জলদি জলদি ।

এরই মধ্যে ট্রাকওয়ালা সুখবিন্দরের সঙ্গে বুধিয়ার ভাব জমে গেছে । এবার সুখবিন্দর মাল নিয়ে মুলুকের দিকেই যাচ্ছিল । এখানে আটকে না গেলে এতদিনে ঘর পৌঁছে যেত সে । ঘরের কথা মনে হতে মনটা তার ভারী হয়ে যায়। তবু বুধিয়াকে নিয়ে খেলায় মেতে সে ঘরের কথা ভুলে থাকবার চেষ্টা করে । এদিকে রঘুর কারবার ভালই চলতে থাকে। রাতে বাড়ি ফিরে রঘুনন্দন ফুলমনিকে বলে , কাল আরও আটা , আলু নিয়ে যাব । আরও কামাই করে লিতে হোবে। প্রায় মাঝরাত । হাইওয়েতে ঘরঘর আওয়াজ । সার দিয়ে ট্রাক চলতে শুরু করেছে । পুলিশের লোকেরা রাস্তা ফাঁকা করে গাড়ি চালু করে দিয়েছে । মিটিং অবরোধ সব আপাতত বন্ধ । আবার কবে শুরু হয়ে যাবে ঠিক নেই । সবার তাড়া লেগেছে । ট্রাক ছুটিয়ে দিয়েছে যার যার গন্তব্যস্থলের দিকে ।

পরদিন ভোরবেলা । বুধিয়াকে কাঁধে করে রঘুনন্দন আসে হাইওয়েতে । সঙ্গে ফুলমনি । ফাঁকা রাস্তায় হু হু করে ট্রাক , গাড়ি সব ছুটে চলেছে । সুখবিন্দরকে দেখতে পায় না রঘু । বুধিয়া তার সুখি কাকাকে না পেয়ে কাঁদে । রঘু বলে , কান্দিস নাই বুধিয়া ; তোর সুখিকাকা তার ঘর গেছে । তারপর ফুলমনির দিকে ফিরে বলে , মিটিং শেষ হইছে রে ফুলমনি , এবার আমাদের কামকাজ মিলবে ; সারা বছরের কাম , একশো দিনের কাম । আর ভুখা মরতে হবে নাই …..।”

গল্পটা শেষ করে একটু থামলেন ইতিহাসের শিক্ষক বাদল রায় ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের মুখের উপর আলতো দৃষ্টি বুলিয়ে বললেন , সম্ভবতঃ গল্পটা একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে কোন এক অখ্যাত গল্পকারের লেখা এই গল্পটা থেকে আমরা আজ থেকে প্রায় আশি-নব্বই বছর আগেকার অর্থাৎ ২০০০-২০১০ সালের ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক পরিবেশ ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটা ভয়ানক খন্ডচিত্র পাই ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগষ্ট ভারতবর্ষ বিদেশী শাসনের অবসান ঘটিয়ে তার প্রথম স্বাধীনতা পেয়েছিল কিন্তু পরবর্ত্তী প্রায় একশো বছর সে শোষিত হয়েছিল রাজনৈ্তিক শঠতা , অর্থনৈ্তিক ভন্ডামি এবং সামাজিক ব্যাভিচারের দেশীয় দালালতন্ত্রের কাছে দূর্বল সংবিধান , অক্ষম গণতন্ত্র , নিস্ক্রিয় বিচারব্যবস্থা দেশের সাধারন মানুষকে নিরাপত্তা দিতে ব্যার্থ হ’ক্রমে এক ব্যার্থ রাষ্ট্রে পরিনত হ’ল ভারত কিন্তু হিস্ট্রি রিপিটশ ইটসেলফ ! আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগে এই দুমড়ে যাওয়া ভারতবর্ষের সর্বস্তরের মানুষ একদিন রুখে দাঁড়াল রাষ্ট্রীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে, শুরু হ’ল প্রতিরোধ তারপর প্রতিআক্রমন যাকে ঐতিহাসিকরা ভারতবর্ষের“ স্বাধীনতার দ্বিতীয় যুদ্ধ “ বলে অভিহিত করেছেন অবশেষে ২০৪৭ সালে যাবতীয় রাষ্ট্রীয় শোষন গুঁড়িয়ে দিয়ে ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত হ’ল এক পরিচ্ছন্ন রাজনৈ্তিক , সামাজিক , অর্থনৈ্তিক বাতাবরন ঘটনাক্রমে সে দিনটাও ছিল ১৫ই আগষ্ট, আমাদের স্বাধীনতা দিবস আজ ২০৮২ সালে দাঁড়িয়ে তোমরা যে ভারতবর্ষকে বিশ্বের সুপার পাওয়ার হিসাবে দেখছো সেখানে রাজনীতি আছে কিন্তু রাজনৈ্তিক ব্যাভিচার নেই , দৃঢ় অর্থনীতি আছে কারন অর্থনৈ্তিক শোষণ নেই , পর্যাপ্ত খাদ্য আছে কারন কালোবাজারী নেই , ব্রথেল আছে কিন্তু ধর্ষক নেই ! সে অর্থে ভারতবর্ষ আজ সত্যিই স্বাধীন ; এখানে আজ কেউ বলার নেই , ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায় স্বাধীনতার এই দ্বিতীয় যুদ্ধই যেন আমাদের স্বাধীনতার শেষ যুদ্ধ হয় , আর সে দ্বায়িত্ব নিতে হবে তোমাদেরই

স্কুল ছুটির ঘন্টা বেজে উঠল ঢং..ঢং…ঢং…

অনুবাদ গল্প – কৌশিক ভাদুরী

রবিবার, জুলাই ২১, ২০১৩  ছোটগল্প

অনুবাদ গল্প – কৌশিক ভাদুরী

বিচার


(
মূল : অস্ট্রিয়ান লেখক মার্টিন অয়ার-এর The Justice , সরাসরি ইংরেজিতে লেখা )

বন্ধুরা! যা বলছি বিশ্বাস করলে তো ভাল, না হলে ঠকে যাবে!

অনেক কাল আগে এই পৃথিবীতেই ছোট্ট একটা মহাদেশ ছিল। এখন সেটার পুরোটাই সাগরের নীচে, খুঁজলেও ম্যাপে পাবে না। আর যখন এই মহাদেশের অস্তিত্ব ছিল, মানচিত্র তৈরির ব্যাপারটাই আবিষ্কার হয়নি। প্রাচীন পৃথিবীর যে সব মানচিত্র ইতিহাস বইতে দেখ, পাবে না ওখানেও। গুনলে হয়তো সপ্তম মহাদেশই হতো, কিন্তু তখনও তো কোনো মহাদেশই আবিষ্কার হয়নি। সবাই জানত মহাদেশ মানে একটাই, গোনার প্রশ্নই ওঠেনি। যাই হোক, সেই মহাদেশে, যা ছিল সপ্তম নয় প্রথমও নয় একমাত্র মহাদেশ, ভারী অদ্ভুত মানুষ-জন বাস করত।

এই মানুষেরা, সত্যি বলতে কি, অদ্ভুত রকমের ছিটগ্রস্ত ছিল, বোকা নয় মোটেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ওরা যখন চাকা আবিষ্কার করে তখনও পর্যন্ত কোন মহাদেশেই চাকা আবিষ্কৃত হয়নি, কারণ আর কোন মহাদেশই আবিষ্কার হয়নি। চাকার পরে-পরেই আবিষ্কার করল আগুন, পিরামিড, মোবাইল ফোন, টেলিভিশন। কিন্তু বললাম না, ওরা ছিল অদ্ভুত ছিটগ্রস্ত, কি করে বোঝাই! ধরা যাক ওদের কারুর বাড়িতে বেড়াতে আসবেন এক পিসি। পিসি তাঁর মোবাইল ফোনে ফোন করলেন : ‘বুঝলি, এই রোববার আসছি । তোদের সঙ্গে দু’এক দিন কাটিয়ে যাব। তোদের খুব ইচ্ছে করে বুড়ি পিসিকে দেখতে, তাই না!’ বাড়িতে ঠিক হয়েছে রোববারে সি-বিচে আউটিং। লাগেজ প্যাকিং হয়ে গেছে। চাকাগুলো গ্যারেজ থেকে বার করে বাড়ির সামনে রাখা। যেই না পিসির ফোন অমনি আবার লাগেজ খোলো, চাকা গ্যারেজে ঢোকাও, হাঁ করে বসে থাক পিসির আসার অপেক্ষায়। ধরা যাক, পিসি সেই যে এলেন, ছুটি কবেই ফুরিয়ে গেছে, ছ’সপ্তাহ কেটে গেছে, ফেরার আর নাম গন্ধ নেই। এদিকে ব্রেকফাস্টে সবাইকে চা খেতে হচ্ছে, কেন না পিসির ফতোয়া : কফি অস্বাস্থ্যকর। বাবাকে তো সিগারেট ছাড়তেই হলো; কারণ পিসি গন্ধটা সহ্য করতে পারেন না। দুপুর ১টা থেকে ৪টে বাচ্চারা চুপ-চাপ; ওটা পিসির দিবানিদ্রার সময়। আশ্চর্য হলো লোকগুলো পিসিকে বার করে দেবে না। নিদেনপক্ষে কোথায় আঙুলে একটা লিপস্টিক নিয়ে; বাড়ির সব চেয়ে ছোট মেয়েটার গালে লাল-লাল ফুটকি বসিয়ে দেবে, স্কারলেট ফিভার হয়েছে; সে সব কিচ্ছু না। উল্টে চুপচাপ নিজেদের স্যুটকেস ব্যাগ প্যাক করবে। চাকাগুলো গ্যারেজ থেকে বার করবে। বাড়ির চাবি পিসির হাতে দিয়ে চলে যাবে সমুদ্র তীরে। তাঁবু খাটিয়ে গোটা পরিবার দিনের পর দিন সেখানে; যেখানে বাবা যতখুশি সিগারেট খেতে পারে, সকালে জলখাবারের সাথে কফি পেতে অসুবিধে নেই, সারা দুপুর বাচ্চাদের চ্যাঁচামেচি করে নিজেদের মধ্যে খেলে কাটাতে মানা নেই।

কিংবা ধরা যাক; স্কুলে নতুন হেডমিস্ট্রেস এসেছেন। কোন এক টিচার অন্যদের কাছে সারাক্ষণ গাইছেন : ‘পড়ানোর ছিরিছাঁদ দেখেছো; তবু ওরা আমাকে হেডমিস্ট্রেস করবে না।’ কেউ কিন্তু ওঁকে এ কথা বলছে না : ‘উনি অনেক বেশি দিন পড়াচ্ছেন। এই ছুটিতে প্রত্যেক দিন এক্সট্রা ক্লাস নিয়েছেন, যে সময় তুমি শুধুই ব্যস্ত থেকেছ পায়ের নখে রঙ দিতে।’ বদলে ওরা কী করবে; কাউন্সিলের কাছে চিঠি লিখবে : ‘নতুন হেডমিস্ট্রেস এসে থেকে এই মহিলা কানের কাছে সারাক্ষণ গজগজ করছেন; মাথা ধরতে ধরতে আমাদের মাইগ্রেন হওয়ার উপক্রম, অনুগ্রহ করে এনাকে এক্ষুনি হেড মিস্ট্রেস করে দিন; আমাদের মাথাগুলো বাঁচুক।’ আর সব থেকে আশ্চর্য যে বেশির ভাগ সময়ে এসব চিঠি নতুন হেড মিস্ট্রেসই ফরওয়ার্ড করে সই করে দেন।

কোন বাচ্চা হয়তো লাগাতার খারাপ নম্বর আনছে। টিচাররা ওকে একই ক্লাসে রেখে দেন না; -আহা বাচ্চাটা কি সুন্দর হাসে। আর একই ক্লাসে রেখে দিলে; সাথে না পেয়ে দুঃখ পাবে না বন্ধুরা! সে যতই বানান ভুল করুক; অথবা সেই মহাদেশগুলোর নাম না বলতে পারুক যেগুলো এখনও আবিষ্কার হয়নি।

তোমরা চাইলে আমি এ রকম ঘটনার বিবরণ দিয়েই চলতে পারি। সে নয় পরে দেখা যাবে। আর একটা বলেই আপাতত শেষ করি। ধর : রাস্তার মোড়ে দুটো চাকায় ধাক্কা হয়েছে। রাস্তায় লোকেদের তো দুটো পক্ষ নিয়ে নেওয়ার কথা। এক দল বলবে : ‘আমরা দেখেছি ওই চাকাটাই উল্টো দিক থেকে আসছিল। আর কী স্পিড!’ আর এক দল বলবে : ‘ছাড়ুন ছাড়ুন ও সব বাজে কথা। আমরা দেখেছি সঠিক ঘটনা। ও মশাই আপনি যদি কোর্টে যান, আমরা সাক্ষি দেব, এই নিন আমাদের নাম ঠিকানা।’ এই নিয়ে দু’দলে কোথায় তর্ক-বিতর্ক করবে, সে সব না করে এই মানুষেরা বলে : ‘ও মশাই জলদি রাস্তা ছাড়ুন, চাকা সাইড করুন।’ স্বগতোক্তি করবে : ‘ শয়তান জানে কেন যে আমরা সবার আগে চাকা আবিষ্কার করতে গেলাম।’

বন্ধুরা বুঝতেই পারছ এই পাগলামো কোন জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার নয়, আর দেয়ওনি ওদের। ওরা সব সময়ই দ্বিতীয় সারিতে থেকেছে। সিনেমা হলে সব সময় পেয়েছে লড়ঝরে সিট। সুপার মার্কেটে মাংস কেনার অভিজ্ঞতা ওদের ভাগ্যে কোন দিনই জোটেনি। স্কুলে ওরা কোনদিনই হেডমিস্ট্রেস হতে পারেনি। বরং ওরা চিরকাল সমুদ্রের তীরে তাঁবু খাটিয়ে থেকেছে, কফি সিগারেট খেয়ে আর চেঁচামেচির খেলা খেলে নিজেদের শরীর-স্বাস্থ্য নষ্ট করেছে।

এই ভাবে চলতে চলতে একদিন এক জাদুকরের আবির্ভাব হলো। জাদুকরের নাম ‘দি গ্রেট বিলোনি’। ও বাজারের চত্বরের মধ্যে ম্যাজিক কার্পেটটা ল্যান্ড করাল। সব্বাইকে জাদু ওড়না নাড়িয়ে অভিবাদন করে বলল : আজ থেকে এই মহাদেশের নাম হলো বিলোনিয়া! কারণ আমিই আবিষ্কার করলাম এই মহাদেশ।

লোকে একটু আশ্চর্য হল। কেন না তারা ভাবত, আবিষ্কার করা যখন তাদের একচেটিয়া কাজ, তারাই আবিষ্কার করেছে এই মহাদেশ। তখন জাদুকর বোঝাল তোমরা এমন কিছুকে আবিষ্কার করতে পার না যেটা তোমরা আবহমান কাল থেকেই জানো। হয় তো মহাদেশটার নাম হত গুলব্র্যানসোনিয়া বা হার্শকোভিৎজিয়া, সেখানে বিলোনিয়া নামটা মন্দ কী!

তারপর জাদুকর ক্রমাগতই সেই মহাদেশের অলিগলি চক্কর দিতে থাকল। এই ভাবেই একদিন বুঝতে পারল মহাদেশের মানুষ-জনের সমস্যাটা আসলে কোথায়। -‘মানুষ হিসেবে তোমরা নিঃসন্দেহে বুদ্ধিমান। তোমাদের ভিতরে আছে সম্ভাবনার প্রাচুর্য। অভাব শুধু দুটো জিনিসের।’ লোকে উসখুস করে উঠল কি সেই দুটো জিনিস। -‘ প্রথমটা হল গাড়ি’।

তখন জাদুকর দেখাল; কী করে একটা কাঠের বাক্স মতো বস্তু চাকার সাথে সংযুক্ত করে পাওয়া যায় গাড়ি; কী ভাবে তাইতে করে মালপত্র বয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। একটা দিয়ে শুরু করে সাতটা চাকা ব্যবহার করে লোকেরা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাল। শীঘ্রই বুঝে গেল চাকার আদর্শ ব্যবহার হচ্ছে দুটো অথবা চারটে। এর পর আর বেশি কঠিন হলো না; একে একে মোটর গাড়ি, স্টিম ইঞ্জিন বা রেল গাড়ি আবিষ্কার। একদিন কেউ আবিষ্কার করে বসল; গাড়িতে গাধাও জোতা যায়; তাতে করে বেশ চলার সময় অনাবশ্যক শব্দ দূষণও হয় না ।

‘আর দ্বিতীয়টা কী জিনিস’; লোকে প্রশ্ন করল জাদুকরকে।

‘শোন বলি; দ্বিতীয় বিষয়; যেটার অভাবে তোমাদের উন্নতি রুখে গেছে; সেটা হলো বিচার ব্যবস্থা সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান।’

‘তা সেটা কী রকম বস্তু; এই কাঠের বাক্স যাকে গাড়ি বললে; সে রকমই কিছু কী?’

‘না; সেটা বস্তু নয়; নীতি।’

লোকে মাথা নাড়ল; যেন বোঝা গেছে। কিন্তু ঘটনা; নীতি বিষয়টাই তাদের ধারনার বাইরে।

‘বিচার মানে প্রত্যেকে যাতে তার ন্যায্যটুকু পায়; সেই ব্যাপারটা নির্দিষ্ট করা; ন্যায্য থেকে এক চুল কম কিংবা বেশি নয়।’

‘তা আমরা তো সেটাই করি।’

‘না কর না। তোমরা লোককে সেটাই দাও যেটা সে চায়; যাতে সে আর ঘ্যানঘ্যান না করে। সুতরাং সেটা বিচার নয়। আর যারা ঘ্যানঘ্যান করে না বা করতে চায় না তারা কিছুই পায় না।’

‘মানেটা তো এই রকমও হতে পারে চাহিদা তত জরুরি নয় যতটা হলে ঘ্যানঘ্যান করা যায়।প্রয়োজনের গুরুত্ব নিজের থেকে বেশি আর কে বুঝতে পারে?’

জাদুকর আরও কিছুক্ষণ বোঝানোর চেষ্টা করে ক্লান্ত হয়ে লম্বা নি:শ্বাস ফেলল।

‘দ্যাখো; তোমরা ঠিক করে বল তো বিচার ব্যবস্থা চাও কিনা; ওটা দিতে আমার জাদু-লাঠি একবার হেলানোই যথেষ্ট; আর আমিও গলা ধরে যাওয়ার খপ্পর থেকে রেহাই পেয়ে যাই।’

লোকেরা বলল : ‘ঠিক আছে; যদি এতে করে আমাদের উন্নতি হয়; আসুক তা’হলে’

জাদুকর তার জাদুদণ্ড সাঁই করে যেই না নাড়লো; ম্যাজিক কার্পেট উদয় হলো। জাদুকর সেটায় বসে উড়ে গেল। তিনি ইতিমধ্যেই নতুন মহাদেশগুলোর ফাটাফাটি সবনাম ঠিক করে রেখেছেন। যথা : বিলোনিয়া-২, বিলোনিয়া-৩, ইত্যাদি। এবার কাজ হলো নামের উপযুক্ত মহাদেশগুলো খুঁজে বার করা।

এদিকে জাদুকর চলে যাওয়ার সঙ্গেসঙ্গে মহাদেশের মানুষ টের পেতে আরম্ভ করলো; জাদুকর কীসের কথা বলেছিল। এখন তারা নিজেদের বিলোনিয়ান বলে; আর মাথা নাড়তে নাড়তে বলাবলি করে :‘সত্যি কী পাগলই না ছিলাম আমরা এতদিন!’ সমুদ্র তীর থেকে যে যার তল্পি গুটিয়ে ফিরে আসতে শুরু করল। বাড়ির অধিকার দাবি করতে লাগলো। এদিকে পিসিরা গুছিয়ে স্থিতু বাড়িতে। বলতেই বলেন তারা :‘চালাকি! আমাদের একা ফেলে চলে গিয়ে এখন বাড়ির অধিকার? মোটেই ছাড়ব না।’ তারপর লম্বা ঝগড়া;মৌখিক চুক্তি, সাধারণ আইন বা এই ধরনের বিষয়ে ক্রমাগত কথা বিনিময় হতে থাকলো।

এর পরের ধাপে বিলোনিয়ানরা আদালত তৈরি করলো। অনেক মামলা এদিকে জমা পড়ে গেছে, এক-এক করে বিচার করতে হবে; তাই ঠিক হলো প্রত্যেক দিন সকাল দশটায় আদালত বসবে।

প্রথম মামলা বিচারের জন্যে এলো : দুই গরিব ভাই। বাবা মারা যাওয়ার পর তাদের জন্য পিতৃদত্ত টিকে ছিল কেবল একটা গাধা । দু’জনের প্রত্যেকেই বলল; গাধাটা তার দরকার; গাড়ি টানার জন্যে;রাস্তায় রাস্তায় জিনিস-পত্র ফেরি করে জীবন নির্বাহ করবে। এই কেসটার সমাধান সহজ। সাব্যস্ত মতো গাধাটা দু’টুকরো করে অর্ধেক অর্ধেক দু’ভাইকে দেওয়া হলো। যদিও ভাইদের দু’জনেইপ্রতিবাদ করল : অর্ধেক গাধা তো কিছু না পাওয়ার সামিল; কারণ অর্ধেক গাড়িও টানতে সক্ষম নয়। কিন্তু ওদের বলা হলো ভাগ-বাঁটোয়ারা একদম সমান হয়েছে; সুতরাং আর কোন কথাই গ্রাহ্য নয়। ভ্রাতৃদ্বয় গজগজ করতে করতে চলে গেল; গাধার টুকরো দুটো ওখানেই পড়ে রইলো।

পরের মামলাটা জটিল। সেটা একটা মাতালের ব্যাপার; মাতাল অবস্থায় ঘুসি মেরে রাস্তায় এক জনের চোখ অন্ধ করে দিয়েছে। প্রথম প্রস্তাব এলো : যা’র চোখ গেছে সে ঘুসি মেরে সেই মাতালের একটা চোখ অন্ধ করে দেবে; এর পর দু’জনেই দু’জনকে একটা করে কাচের চোখ গড়িয়ে দেবে; কারণ বিচার মানে একদম মাপ মতো; চোখের বদলে চোখ।

কিন্তু পরের দিন সেই মাতালকেই আবার আদালতে আনতে হলো; আজ সে আর এক জনের চোখ অন্ধ করে দিয়েছে। রায় আগের মতোই পুনরাবৃত্ত হতে যাচ্ছে; কথা উঠলো : মাতালের একটা চোখ তো আগের দিনের সাজাতেই গেছে, আজ আর একটা গেলে দেখবে কী করে; এক চোখ গেলে কিছুটা চালিয়ে নেওয়া যায় কিন্তু দু’চোখ গেলে সেটি হওয়ার নয়; দুচোখবিশিষ্টের একটি চোখ যাওয়ার ফলএকচোখওয়ালার একমাত্র চোখ যাওয়ার ফলের সমতুল নয়। অতএব বিচার ন্যায্য নয়। কথা হলো মাতাল একজনের দৃষ্টির অর্ধেক নিয়েছে; সুতরাং মাতালেরও দৃষ্টির অর্ধেক নেওয়া হোক; ওর অর্ধেক চোখ নেওয়া হোক। তা’তেও অসুবিধে অর্ধেক চোখ নেওয়া প্রায় অসম্ভব। যদি বা সম্ভব হয়; অর্ধেক চোখে কোনোই কাজ হবে না, সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন হয়ে যাবে। এই ভাবে মামলা চলতেই থাকলো।

এদিকে আদালতে এবার এক “পিসি-ভাইপোর বাড়ির দাবি” মামলা উঠে এসেছে। এই পিসি ভাইপোর বাড়ি বহু বছর আছেন। একা থাকার শারীরিক ও মানসিক কষ্ট দূর করতে তিনি আর একভাইপোকে বাড়িতে ডেকে বসিয়েছেন। ভাইপো ও তার স্ত্রী সেখানে থাকার সুবাদে তাদের ছেলেপুলেরাও সেই বাড়িতেই জন্ম নিয়েছে। সে বিবাদী পক্ষ। বক্তব্য : ‘ বাইরের দেওয়াল আমিই রং করেছি,ঘরের ভিতরে নতুন ওয়াল পেপার লাগিয়েছি, এ বাড়ি আমার।’

অন্য ভাইপোর বক্তব্য : ‘জলের পাইপ, কল-বেসিন সমস্ত প্লাম্বিং আমি নয়তো আর কে করিয়েছে শুনি?’

বিচারকেরা বললেন : ‘রাখুন ওসব ওয়ালপেপার-প্লাম্বিং, আসল কথা হলো বাড়িটা কে তৈরী করেছে?’

প্রথম ভাইপো মাথা চুলকে বলল : ‘দেখুন এটা তো অনেক পুরনো বাড়ি; তৈরি কে করেছিল সে বিষয়টা সঠিক বলা মুশকিল; তবে এটুকু বলতে পারি আমার জন্ম ওই বাড়িতেই।’

‘কিন্তু তুমি বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলে।’

‘না ধর্মাবতার মোটেই না। কানের কাছে সারাক্ষণ গজগজ করে আমাকে তাড়ানো হয়েছে।’

‘তুমি তোমার পিসিকে তাড়িয়ে দিতে পারতে।’

‘মাননীয় বিচারক এ কী বলছেন; পিসি তাড়ানোর কথা কস্মিন কালেও কেউ শুনেছে!’

‘কিন্তু তুমি তো ফিরে আসতে চাও বলে পিসিকে কখনও নোটিশ দাওনি।’

‘আমরা তাঁবুর নীচে থাকি অস্থায়ী বাসায়; ধর্মাবতার, এটাই কী যথেষ্ট সূচক নয় যে আমি আমারপৈত্রিক ভিটেয়ে ফিরে আসার দিন গুনছি।’

এইবার পিসি হাত তুললেন; তাঁর কিছু বলার আছে। ‘ধর্মাবতার যতদূর স্মৃতিতে আছে; একদা এই বাড়িতেই থাকতেন আমার বাবা। একবার বাদী ভাইপোর বাবার পিসি ছুটি কাটাতে এলেন এবং থেকে গেলেন। আমার বাবাকে বেরিয়ে গিয়ে থাকতে হলো সমুদ্র তীরে তাঁবু খাটিয়ে। সিগারেট ফুঁকে ফুঁকে মাথার সব চুল উঠিয়ে ফেললেন ভালো মানুষ লোকটি। সুতরাং বোঝা যায় না কী উত্তরাধিকারহিসেবে আমার দাবিই ন্যায্য; ধর্মাবতার।’

আদালতে তখন তলব মোতাবেকে পুরনো দলিল দস্তাবেজ ফটো অ্যালবাম অনেক পেশ হয়েছে।সেখানেও দেখা গেল অনুক্রম-পরাক্রমে এমন অনেক পিসি-ভাইপোর নিষ্পত্তি-বিহীন বিবাদ বিদ্যমান। কোথাও-কোথাও আবার দূর ও নিকট তুতো-ভাইদের অমীমাংসিত সামলাতে গিয়ে বৃদ্ধা প্র-উপমাতাদের টেনে নামাতে হয়, তো কোথাও ধর্ম-মায়েদের।

মামলা চলতেই থাকলো, চলতেই থাকলো। মানুষ-জনের খিদে পেয়ে গেল। কেন না মামলা চলাকালীনতারা রোজগারে যেতে পারেনি। খাবারের ভাঁড়ার শূন্য।

এদিকে আদালত চত্বরে পড়ে-পড়ে সেই গাধার টুকরো দুটো পচেছে। চতুর্দিকে দুর্গন্ধ। টেকা দায়। কেউই ভাবেনি ও দুটো হটানো উচিত; বিধিবদ্ধ ভাবে সেগুলো অন্যের সম্পত্তি। সরাতে যাবে কে!দুই-ভাই এদিকে একটা নৌকো চুরি করে সমুদ্রে লা-পতা। মনে আশা যদি জাদুকরের দেখা মেলে;তাকেও তো দিতে হবে তার ন্যায্য প্রাপ্য! দেখতে দেখতে কোটি-কোটি মাছিতে ঢেকে গেল গাধার দুটোটুকরো। কালক্রমে সমস্ত বিলোনিয়াবাসী অসুস্থ হয়ে মারা পড়ল।

এইবার একদিন জাদুকর ফিরে এলো; দেখতে; বিলোনিয়ায় উন্নতির হাল-হকিকত্‌! আকাশচারীম্যাজিক কার্পেটে বসে দেখে ওই দৃশ্য; কোথায় উন্নতি কোথায় কী মাছি ছাড়া গোটা মহাদেশে কিছুটি নেই। অমনি জাদু-লাঠি একবার সাঁই করে দিল। কোথায় কী; মহাদেশ-কে- মহাদেশ দ্বীপ-কে-দ্বীপ ডুবে গেল;উড়ে এসে মাছিগুলো ছেঁকে ধরল। গাধার টুকরো তো খেতে খেতে কবেই শেষ হয়ে গেছে; এখন তারা ক্ষুধার্ত। নিমেষের মধ্যে জাদুকরকে খেয়ে শেষ করে ফেলল। ম্যাজিক কার্পেট তার জাদু-নির্ধারিত সময়ে উড়ে গেল। উড়তে উড়তে জাদুটোনা ফুরিয়ে একদিন মাটিতে আছড়ে পড়ল। এক পথচারী সেটা পেয়ে হাটে বিক্রি করতে এনেছিল। সে-দিন আমার ছুটি ছিল; আমি তখন হাটে; দেখতে পেয়ে কিনে নিলাম। বাড়িতে বসার ঘরে দেওয়ালে টাঙিয়ে রেখেছি। বন্ধুরা চলে এস একদিন; কার্পেটটা দেখে যাবে।

দুঃখিত!