ছেঁড়া কাগজের ঝুড়ির গল্প

গত বুধবার লেকের ধারে বেড়াচ্ছিলাম। দিব্যি ফুরফুরে হাওয়া। মনটা খুশি খুশি লাগছিল। বিকেলের দিকটায় অনেকেই এই লেকের ধারে বেড়াতে আসে, ইভনিং ওয়াকে আসা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা থেকে শুরু করে হাত ধরে বেড়াতে আসা প্রেমিক প্রেমিকাও। লেকের টলটলে জলে ভেসে বেড়াচ্ছে একদল হাঁস। এইসব দেখতে দেখতে রাস্তার দিকে খেয়াল ছিল না, হঠাতই একটা উঁচু হয়ে থাকা শিকড়ে হোঁচট খেয়ে… পপাত চ। কাঁধের ঝোলাটা ছিটকে গিয়ে পড়ল পাশের ঝোপের মধ্যে। পড়ে গিয়ে চোট যে বিশেষ লেগেছে তা নয়, তবে সবার সামনে এইভাবে আছাড় খাওয়াটা একটু লজ্জাজনক। তাই অবিলম্বে স্মার্টলি উঠে পড়াটা বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু কেন জানি ইচ্ছে করল না উঠতে। তার বদলে ওই অবস্থাতেই গড়িয়ে গড়িয়ে চলে গেলাম পাশের ঘাসে ঢাকা অঞ্চলটায়। যে গাছের শিকড়ে হোঁচট খেয়েছিলাম তারই গোড়াটাকে বালিশ করে শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম আগড়ুম বাগড়ুম নানা রকম। ফোনের বিল দিতে হবে, আর চিনা রেস্টুরেন্টে খাওয়া, চিলি চিকেন খাওয়া হয়নি অনেক দিন, আমার এক্স গার্লফ্রেন্ড হেব্বি চিলি চিকেন রাঁধতে পারত… গত হপ্তায় ওর জন্মদিন ছিল…  বয়েস বেড়ে যাচ্ছে… লাইফটাকে যদি বছর দশেক রিওয়াইন্ড মেরে নেওয়া যেত…

 

হঠাত শুনি “Hey gentleman! Are you okay?” চমকে বর্তমানে ফিরলাম। তাকিয়ে দেখি প্রশ্নকর্তা এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক। পাশের ট্রেল দিয়ে পায়চারি করতে করতে আমায় অদ্ভুতভাবে পড়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করেছেন একথা। কি উত্তর দেব ভাবতে ভাবতে উনি আবার শুধালেন “What are you doing there?” বললাম “Just Enjoying the fall” উনি অবাক হয়ে বললেন “But its springtime now! Usually leaves don’t fall in March!” স্মিত হেসে আমি বললাম “That’s right sir, but I do…”

মনে আছে ছোটবেলায় নিজের সাথেই একটা খেলা খেলতাম। দুই আমি’র খেলা। অবশ্য আমার বেশিরভাগ খেলাই ছিল নিজের সাথে, বন্ধুবান্ধব খুব বেশি ছিল না, মুখচোরা, অসামাজিক হওয়ার জন্যই বোধহয়। এদিকে বাবা মা দুজনেই চাকুরে হওয়ায় বাড়িতে সারাদিন থাকতে হত একাই। ফলে নিজের মস্তিষ্কপ্রসূত নানা ধরনের খেলা চালিয়ে যেতাম সারাদিন। ইরেজার কেটে বানানো বল দিয়ে ছ-ইঞ্চি বাই এক ফুট মাপের পিচে ক্রিকেট খেলাই হোক, বা খোপ কাটা বোর্ডে ছক্কা চেলে খেলা ওলিম্পিক গেমস, ওগুলোই ছিল আমার সারাদিনের সঙ্গী। শুধু খেলাই বা কেন, এছাড়াও ছিল নানা ধরনের কাজকর্ম। কখনো বাগানে রমন কাকুর (আমাদের বাগানের মালী) কাছ থেকে শিখে টবে বুনোফুলের গাছ লাগানো, কখনো দুপুর বেলা পাড়ার নির্জন রাস্তায় একা একা ঘুরে বেড়ানো, আবার কখনো বা নিজস্ব সংবাদপত্র লেখা। বলাই বাহুল্য সেই সংবাদপত্রের খবর গুলো সবই আমার উর্বর মস্তিষ্কের সৃষ্টি।

সে যাহোক, দুই আমি’র খেলাটার কথা বলি। যখনই কোনো দ্বিধায় পড়তাম, তখনই আমার মনের মধ্যে দুজন আমি আমার দুই কানে এসে তাদের পরামর্শ দিয়ে যেত। প্রথম আমি ছিল দুঃসাহসী, ডাকাবুকো, মোর‍্যালিটির ধার ধারতনা সে। সে সর্বদা আমায় দুষ্টু বুদ্ধি দিত, মায়ের কথা না শুনতে উৎসাহ দিত। অন্যদিকে দ্বিতীয় আমি ছিল সাবধানী, সংযত, এক্কেবারে গুডবয়। সে বলত “খবরদার, ঝুঁকি নিসনা! কি দরকার এইসব বদমায়েসী করার?” কখনো আমি এর কথা মেনে চলতাম কখনো বা ওর কথা। দুষ্টুমি করে মায়ের কাছে যখন কানমলা খেতাম তখন সেই দ্বিতীয়জন কানে কানে বলত “আমার কথা না শোনার ফল!” আর তখন প্রথম জন কিস্যু না বলে স্রেফ মিচকি হেসে চোখ টিপত।

ক্লাস ফোর বা ফাইভ মনে নেই, আমার স্কুলে যাওয়ার জন্য মা ব্যবস্থা করে দিল রাবণ কাকুর রিক্সার। সেই রাবণ কাকুর রিক্সাতেই যেত পাড়ার আরেকটি মেয়ে, আমার চেয়ে এক বছরের ছোট। ভারী মিষ্টি দেখতে। সেই প্রথম কোন মেয়েকে দেখে একটু অন্যরকমভাবে ভাল লেগেছিল। একদিন রিক্সায় যেতে যেতে প্রথম আমি কানে কানে বলেছিল “কি লজ্জায় মরছিস এত? বন্ধুত্ব কর মেয়েটার সাথে!” সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয়জন চোখ রাঙ্গিয়ে বলে “চিনিস না জানিস না, কি দরকার আগ বাড়িয়ে কথা বলার, কি না কি ভাববে।” বহুদিন হল ওরা দুজন আর আসেনা পরামর্শ দিতে, মাঝে মাঝে অবসর সময়ে ভাবি – সেদিন প্রথম জনের কথাটা শুনলে মন্দ হতনা!

আমার বয়ফ্রেন্ডের মদের নেশা, বাবার সিগারেট। ছোট ভাইটাকে দেখি নেশার মত চিনি খায় রান্নাঘর থেকে চুরি করে। এ জিনিসটা আমি কখনও পারলাম না। কোনো নেশাই জুটলনা আমার কপালে। আপনারা আমায় পাগল ভাবতে পারেন, কিন্তু আমার ফ্রাস্ট্রেশনটাও ভেবে দেখুন একবার। কত লোকের কথা শুনে কত রকম নেশা করার কথা ভেবেছি, একবারও সফল হতে পারিনি। কলেজে ঢোকার পর বন্ধুদের দলে পড়ে মদ খেলাম, চেখে দেখলাম সিগারেটও। পরিচয় হল গাঁজা চরসের সাথেও। কোনোটা অসহ্য রকমের বাজে লাগল আবার কোনোটা বেশ ভাল। কিন্তু যতই ভাল লাগুক, নেশা কিছুতেই হলনা। কিরম জানেন? ধরুন বিরিয়ানি খেতে তো আমার দারুণই লাগে, কিন্তু রোজ রোজ বিরিয়ানি না পেলে চলবেনা, বা দুদিন বিরিয়ানি ছাড়া থাকলেই বুকের ভেতর আঁকুপাঁকু করবে, এরকম তো নয়। মদের ক্ষেত্রেও আমার হল সেরকমটাই। ওয়াইন, হুইস্কি, ভদকা কোনোটাই মন্দ লাগেনি আমার, কিন্তু নেশা? নাহ! কত রকম জিনিস ট্রাই করলাম, কোনোটাই জমলনা।

পরে চেষ্টা করেছি আরও অনেক কিছুর। ডেনড্রাইটের গন্ধ, কোকেন, হেরোইন মায় হস্তমৈথুন। কিন্তু… উফফ কিকরে উদ্ধার পাব এই নেশাহীনতার হাত থেকে? সাইকায়াট্রিস্টের কাছে গিয়েও বলেছি নিজের সমস্যার কথা। তিনি বললেন “কি যে বলেন, লোকে নেশা ছাড়ার জন্য আসে আমার কাছে, আর আপনি কিনা নেশা করার জন্য বুকফাটা কাঁদছেন?” ওনার মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য আমায় ভর্ৎসনা করা স্রেফ ভাগিয়ে দিলেন।

বন্ধুরা আমায় নিয়ে হাসাহাসি করে, বয়ফ্রেন্ডও ইদানিং ভাবছে আমার মাথায় গোলমাল, কোনদিন লেঙ্গি দেবে ভগবানই জানেন। এই সমস্ত ফ্রাস্ট্রেশনের হাত থেকে বাঁচার জন্যও অন্তত কিছুদিনের জন্য কিছু একটা নেশা আমার চাই… আপনারা আমায় সাহায্য করতে পারেন দাদাভাই দিদিভাইরা?

রামপুরহাট কলেজে লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছি মাসছয়েক হল। ছাত্র চরাতে নেহাত মন্দ লাগছেনা। ছোট থেকেই পড়ানোর দিকে আমার ঝোঁক। বাপ মা দুজনেই শিক্ষক। সেই জিনের প্রভাবই হবে হয়ত। কিন্তু চাকরীটা নেওয়ার পর দেখলাম ব্যাপারটা ততটাও সুখকর নয়। তার প্রধান কারণ হল ছাত্রগণ অধ্যয়ন করতে একেবারেই উৎসাহী নয়। তারা চায় ফাঁকিবাজি করে কোনোক্রমে পরীক্ষায় উতরে যেতে। কাজেই যে স্যার ভাল সাজেশন দেন সেই স্যারই তাদের নয়নের মণি, কে কেমন পড়ালেন সেটা গৌণ। এই ব্যাপারটাই আমায় বিরক্ত করে। ভেবেছিলাম আমার জ্ঞানের ভান্ডার উজাড় করে দেব নতুন প্রজন্মের সামনে, সুন্দর করে বুঝিয়ে দেব পড়া, সবাই ধন্য ধন্য করবে। কোথায় কি? আদ্ধেক দিন বেশিরভাগ ছেলে ক্লাসেই আসেনা। গুটিকয় যারা আসে তারাও ক্লাসে গপ্প করে কিম্বা ঘুমোয়। কত আর বকাঝকা করা যায়, স্কুলের বাচ্চা তো আর নয়।

দেখতে দেখতে চলে এল টেস্ট পরীক্ষা। আগেই ঠিক করেছিলাম এমন প্রশ্ন করব, যারা ক্লাসে আসেনি তারা কেবল নোট পড়ে কিছুতেই আনসার করতে পারবেনা। যেমন কথা তেমনি কাজ। পরীক্ষার দিন হলে গার্ড দিতে গিয়ে দেখি সবার মুখ চুন। দুএকটা প্রশ্ন বাদে বাকিগুলো একেবারেই যাকে বলে “কমন পড়েনি”। বেশ একটা অদ্ভুত আনন্দ হচ্ছে মনের ভিতর, বেশ উচিত শাস্তি দেওয়া গেছে হতভাগাগুলোকে। হলের পিছন দিকটায় পায়চারি করছিলাম গার্ড দিতে দিতে। হঠাৎ ডানদিকে ভাল করে তাকাতেই দেখি একটি ছেলে পাশে কি যেন একটা রেখে তাই দেখে লিখছে! টুকলি!! রাগ সামলে খুব সন্তপর্ণে এগোলাম ওর দিকে। পিছন দিক থেকে এগিয়ে যাওয়ায় বেচারা বুঝতেই পারেনি যে আমি আসছি ওর দিকেই। পাশে পৌঁছে প্রথমেই ছোঁ মেরে তুলে নিলাম টুকলি কাগজখানা, তার পর চেপে ধরলাম ওর কলার। ততক্ষণে ও তাকিয়েছে আমার দিকে। চোখাচোখি হতেই… মুখটা বড্ড চেনা চেনা লাগল… আর ওকে চিনতে পেরেই অবশ হয়ে গেল আমার হাত। নিজে থেকেই ছেড়ে দিলাম কলারটা। চড় মারতে উদ্যত ডানহাতটাও নেমে এল ধীরে ধীরে… যে ছেলেটা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, সে আর কেউ নয়… আমি।

একটা গভীর সমস্যায় পড়ে গেছি আমি। অনেকদিন থেকেই আমার শখ আত্মহত্যা করার। কিন্তু কিভাবে করা যায় সেটাই চিন্তার বিষয়। চলতি উপায়ে আত্মহত্যা করে লাভ নেই। তাহলে আর নতুন কি করা হল? আমি চাই নতুন একটা পথ দেখিয়ে যেতে। হয়তো আমার দ্বারা ইনস্পায়ার্ড হয়ে ভবিষ্যতে আরও হাজার হাজার লোক সেই পদ্ধতিতে আত্মহত্যা করবে! ভাবতেই রোমাঞ্চিত হই আমি। আপনারা হয়তো ভাবছেন, কি মুস্কিল, গোড়াতেই তো গলদ, আদৌ আত্মহত্যা করতে চায় কেন পাগলটা? সেরকম ভয়ানক কিছু কারণ হয়তো আমি বলতে পারবনা, এটুকুই বলতে পারি জীবনে আমার বিতৃষ্ণা ধরে গেছে। এই বোরিং জীবনে আমার দ্বারা বিশেষ কিছু অ্যাচিভ করা সম্ভব না সেটা আমি বুঝে গেছি। তাই মরেই অ্যাচিভ করলাম নাহয়। ঠাকুর বলেছেন, জন্মেছিস যখন, একটা দাগ রেখে যা। সেই দাগটাই আমি রাখতে চাই… আনোখা কোনো একটা উপায়ে সুইসাইড করে।

বহু ভেবেছি, ভাবতে ভাবতে মাথার চুল কমে গেছে। কিন্তু একটা সহজ সুন্দর নতুন আত্মহত্যার উপায় ভেবে পাইনি। যাই ভেবে বার করি, মনে হয় এ তো ক্লিশে হয়ে গেছে বহু ব্যবহারে… কিম্বা মনে হয় এই মেথডে সুইসাইড করলে মরারই গ্যারান্টি হয়তো থাকবেনা, সেটা হলে খুব বিপদ, বেঁচে গেলে জেলেও যেতে হতে পারে। তাহলে উপায়? ভাবতে ভাবতে আরো ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে পড়ি, সেই ফ্রাস্ট্রেশন থেকে হয়ে পড়ি আরোই আত্মহত্যাকামেচ্ছু।

শেষপর্যন্ত এই স্ট্রেস আর সহ্য করতে না পেরে একদিন গিয়ে দাঁড়ালাম আমাদের ২৮ তলা ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে। হোক পুরোনো মেথড, ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়েই মরব আমি। আর নিতে পারছিনা মাথার ওপর এ চাপ। সারাজীবনে পারিনি সফল হতে, মরার ব্যাপারেও নাহয় ব্যর্থই রয়ে গেলাম। উঠে দাঁড়ালাম ছাদের পাঁচিলের উপর। নিচের দিকে তাকালাম। ভয় করলনা কিন্তু। প্রায় সারা শহরটা দেখা যায় আমাদের ছাদ থেকে। ওই যে ইডেন গার্ডেন্স, যেখানে ভারত অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ দেখতে গিয়ে আলাপ আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর সাথে… ওই যে ধর্মতলার মোড়ের গ্র্যান্ড হোটেল, ওর সামনেই ট্যাক্সির তলায় একদিন হারিয়েছিলাম সেই প্রিয় বন্ধুকে। ওই যে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, ওখানেই একদিন শর্মিলার বুকে মুখ গুঁজে কেঁদেছিলাম। ময়দানের ওই সবুজ ঘাসের ওপরই কত আনন্দে কেটেছে কত সোনালী বিকেল। ওই সেই রামুকাকার বাড়ি, হয়তো কাকা এখন কাকিমার বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শান্তিতে ঘুমোচ্ছেন। এরকম আরও কত ছোট ছোট বাড়ির সারি… এই বিশাল শহরে তারা হয়তো ইন্ডিভিজুয়ালি ইনসিগ্নিফিক্যান্ট, কিন্তু তাদের একেকজনের গর্ভে প্রতিনিয়ত অভিনীত হয়ে চলেছে কত নাটক, বয়ে চলেছে কত সুখ দুঃখের স্রোত… কই তারা তো আমার মত কেউ এরকমভাবে উঠে দাঁড়ায়নি ছাদের উপর… আমার মনে হল – আমি একটা বিশাল ভুল করছি, এখনও অনেক কিছু পাওয়ার আছে আমার, এই দুনিয়ার থেকে, এই কলকাতার থেকে… আমার থেকে… এই ভেবে ছাতের পাঁচিল থেকে নেমে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই… মাথাটা কেমন ঘুরে গেল। ছাতের দিকে নামার বদলে আমার দেহটা পাঁচিল থেকে স্থানচ্যুত হল ২৮ তলার নিচের রাস্তার দিকে… সেই রাস্তা দিয়ে তখন অত রাত্রেও বয়ে চলেছে জীবনের স্রোত।

ফ্র্যাঙ্কো তিরেমো এর নাম শুনেছে এরকম বাঙ্গালীর বাচ্চা খুঁজে পাওয়া ভার। অথচ সাহিত্য জগতে নতুন কিছু করার কথা ভেবে যাঁরা এগিয়ে এসেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম এই তিরেমো। ১৯২২ সালে স্পেনের মাদ্রিদ শহরে তিরেমো এবং তাঁর কয়েকজন বন্ধু মিলে ঠিক করেন এক অদ্ভুত উপায়ে লেখালিখি করবেন। তাঁদের লেখার বিষয় কোনো নির্দিষ্ট কিছু থাকবেনা, আগে থেকে স্থিরও করা হবেনা। লিখতে বসে তাঁরা চোখ বন্ধ করে ভাববেন, এবং চোখ বন্ধ করা মাত্র মাথায় যা আসবে সেটাকেই নিজের মত চলতে দেবেন নিজের পথে। সে পথ জতই আজগুবি হোকনা কেন। এরকম ভাবে সৃষ্টি করা ছোটো ছোটো কিছু লেখার কোলাজ তৈরি করবেন তাঁরা।

এবার আসা যাক আসল মজার ব্যাপারটায়। এই ছোটো ছোটো লেখাগুলো নিজেদের মধ্যে সম্পর্কযুক্ত হবেনা। তাদের মধ্যে কেবল একটাই সম্পর্ক থাকবে – সেটা হল এই যে কোনো একটি লেখার টুকরো বাকি টুকরো গুলোর থেকে অন্যদিকে পথ চলবে। একটি লেখার বিষয়বস্তু হবে অন্য লেখার থেকে সম্পূর্ণ অর্থোগোনাল। অর্থাৎ একটি টুকরো শেষ করার পরার চোখ বুজে লেখক যখন ভাববেন, তখন তাঁর ভাবনা যেকোনো পথে চলতে পারবে বটে, কেবল আগে যে পথে চলেছে সেইটে বাদে। এই অর্থোগোনাল ডিরেকশনে টুকরোগুলি যাত্রা করবে বলে তাঁরা এর নাম দিলেন অর্থো-কোলাজ। এই ধরনের অর্থো-কোলাজ লিখে তার সঙ্গে কিছু ছবিও দেওয়া যেতে পারে, তবে সেই ছবিগুলো হতে হবে আবার লেখার টুকরো গুলোর সঙ্গে অর্থোগোনাল। সর্বোপরি লেখার নামটিও হতে হবে লেখার বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কবিমুক্ত।

এই অদ্ভুতুড়ে লেখা অর্থোকোলাজ খুব জনপ্রিয় হয়েছিল একথা বলা যায়না, তবে তিরেমোর তিরোধানের পর তাঁর সাগরেদরা কিন্তু এই ঘরানায় অসাধারণ কিছু কোলাজ রচনা করেছিলেন। ফ্যান্টাস্টিক সাহিত্যের ইতিহাসে অর্থোকোলাজ তাই একটা বিশেষ স্থান অধিকার করে।

দূর মশাই… এতক্ষণ যা যা বললাম সব বিশ্বাস করলেন নাকি? করে থাকলে ভুলে যান, কারণ এ সবই আমার বানানো আষাঢ়ে গপ্প। গতকাল রাত্রে শুয়ে শুয়ে চোখ বুজে চিন্তা করতে এইসব মাথায় আসছিল… তারপর? তারপর আর কি। চিন্তাটাকে স্রেফ তার পথে চলতে দিলাম…

মাসছয়েক আগের ঘটনা। ঘুরতে গেছি ইনো রিভার স্টেট পার্কে। রোদ ঝলমলে দিন। ইনো নামের সরু এক চিলতে নদী বয়ে চলেছে কুলকুল করে। দুধারে জঙ্গল আর তার মধ্যে দিয়ে নানারকমের ট্রেল। তারই একটায় হাঁটছি। তখন পাতা ঝরার মরশুম। চারিদিকে গাছের ডালে আধা শুকনো হলুদ-লাল পাতা ঝরার অপেক্ষায় দিন গুনছে। নর্থ ক্যারোলিনার ফল কালার পৃথিবী বিখ্যাত। সেই রঙের জগতে বুঁদ হয়ে আছি। এদিক দেখছি, ওদিক দেখছি, কোথাও হয়তো কোনো গাছ ইতিমধ্যেই এক্কেবারে ন্যাড়া হয়ে গেছে, কোনো গাছের পাতা হলুদ, কোথাও কমলা, লাল… আবার চিরহরিৎ পাইন গাছগুলো তখনও তাদের দৃপ্ত সবুজ রঙ ধরে রেখেছে। এই রঙের খেলা দেখতে দেখতে মনে হল কেবল নীল রঙটা মিসিং। ওইটে হলেই লুকোনো চিত্রকরের আঁকা ছবিটা এক্কেবারে সম্পূর্ণ হত।

কিন্তু নাহ। নীল রঙ নেই কোত্থাও। গোলাপী রঙের ফুল ফুটে আছে, ঘাসের ফাঁকে হাল্কা বেগুনী ঘাসফুল… আর ঝিঁঝির ডাক দিনের বেলাতেও। কেবল ওই নীলটাই পেলুম না কোনোখানে। এইসব ভাবতে ভাবতে অন্যদিকে তাকিয়ে পথ চলেছি, খেয়াল করিনি ওই ট্রেলেই আমার আগে আগে যাওয়া মার্কিন দম্পতিকে। চলতে চলতে বোধকরি খুব কাছে চলে এসেছিলাম, ছেলেটি হয়তো মনে করল আমি ওদের প্রাইভেসিতে বিঘ্ন ঘটাচ্ছি। পিছন ফিরে বললে “What the fuck?” এই বলে নিজের মধ্যম অঙ্গুলিটি ঊর্ধমুখে তুলে দেখাল আমায়। একটু ঘাবড়ে গিয়েই আমি ওর আঙ্গুলটাকে ফলো করে তাকালাম উপর দিকে। আর তাকাতেই চোখ পড়ল আকাশের দিকে। মুখে হাসি ফুটল আমার। হ্যাঁ ছবিখানা সম্পূর্ণ হয়েছে বটে!

মাঝরাত্রে ভীষণ তেষ্টায় ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। পাশে অনুপমা শুয়ে আছে। গায়ের চাদরটা সরে গেছে অনেকটা। আস্তে করে সেটা টেনে দিলাম ওর গায়ের ওপর। হঠাত ওর গায়ে হাতের স্পর্শ হতেই চমকে উঠলাম। এ যে কনকনে ঠাণ্ডা! নাকের নিচে হাতটা নিয়ে যেতেই বুকের ভিতরটা ধড়াস করে উঠল। কোনো নিঃশ্বাস প্রশ্বাস অনুভব করতে পারা যাচ্ছেনা। ওর দেহটা ধরে নাড়া দিলাম… জোরে জোরে… “অনুপমা! অনুপমা!” ডাকলাম কয়েকবার… কোনো সাড়া নেই… তাহলে… তাহলে কি?… বুকফাটা আর্তনাদ করে উঠতে ইচ্ছে করছে আমার… সেই সময় হঠাতই…

ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। চমকে উঠে বসলাম। সারা শরীর ঘেমে গেছে। পাশে তাকিয়ে দেখলাম নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে অনুপমা। ওর বুকটা ওঠা নামা করছে স্বাভাবিক নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল আমার। এমনতরো দুস্বপ্ন কেন যে দেখি! গলাটা শুকিয়ে গেছে। পাশের বেডসাইড টেবলে রাখা জলভর্তি গ্লাসটা অন্ধকারের মধ্যে নিতে গেলাম হাত বাড়িয়ে। অসতর্ক হাতের স্পর্শে কাচের গ্লাসটা মেঝেতে সশব্দে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল… আর ঠিক সেই মুহূর্তে…

আমার ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। পাশে তাকিয়ে দেখলাম বাকি বিছানাটা ফাঁকা। একটা অজানা আশঙ্কায় ভরে গেল মন। আমি কি বেঁচে আছি… জেগে আছি নাকি স্বপ্নের জগতে আছি সেটাই উপলব্ধি করতে সময় লাগল কিছুটা। ঘোরটা কাটলে মনে পড়ল আজ বিকেলেই অনুপমার দেহটা নিজে হাতে দাহ করে এসেছি নিমতলার শ্মশানে।

 

[বিধিসম্মত সতর্কীকরণ – গপ্পের আমিগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সত্যি আমি নই, তাই দয়া করে সেগুলোকে সত্যি আমির সাথে গুলিয়ে ফেলবেননা। দুএকটি ক্ষেত্র বাদে গল্পগুলো প্রায় পুরোটাই কাল্পনিক, কোনো বাস্তব চরিত্রের সাথে মিল পাওয়া গেলে তা নিতান্তই কাকতালীয়]

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!