
আমি তখন মেডিকেল কলেজের ফিফ্থ ইয়ার এর ছাত্রী। ঢাকায় বাসা হবার কারনে অন্য সব ছাত্রীদের মত আমাকেও মেডিকেল কলেজের হলেই থাকতে হত। সেদিন ইভিনিং শিফ্ট সেরে হলে ফিরতে অনেক রাত হয়েছিল বলে তাড়াহূড়ো করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম আর প্রায় সাথে সাথেই ঘুম এসে গেল। ঘুমের মাঝে স্বপ্নে দেখলাম কলেজের মর্গে লাশ কাঁটার বিছানায় আমি শুয়ে আছি আর ফরেনসিক বিভাগের এক ডাক্তার একে একে আমার পড়নের সমস্ত পোশাক খুলে ফেলছেন। বুঝলাম আমি তখনও জীবিত, কিন্তু সবাই ভাবছে আমি মরে গেছি আর তাই পোস্টমর্টেমের জন্য আমাকে এখানে রাখা হয়েছে। আমি তখন হাত পা নাড়তে কিংবা কোন শব্দ করতে পারছিলাম না, শুধু বুঝতে পারছিলাম ডাক্তার এখন আমার পোস্টমর্টেম না করে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন। আমাকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে কাপড় গুলা দূরে একটি বিছানায় সরিয়ে রাখলেন তিনি। তারপর ডাক্তার আমার দিকে এগুতেই হঠাৎ আমার মোবাইলের পরিচিত রিং-টোন শুনতে পেলাম। বুঝলাম বিছানায় রাখা আমার কাপড়ের ভিতর থেকে মোবাইল ফোন বাঁজছে। রিং এর আওয়াজ ক্রমেই বেড়ে চলেছে আর ডাক্তার ক্রমশ এগিয়ে আসছেন আমার দিকে। হঠাত মনে হল এটা একটা দুঃস্বপ্ন। তাই প্রাণপনে ঘুম ভাংগার চেষ্টা করলাম আর এক সময় ঘুম ভেংগে গেল। ঘুম ভাংগার পর দেখলাম সত্যি আমার মোবাইলে রিং হচ্ছে। মনে মনে কলার কে ধন্যবাদ দিলাম, কারন তিনি ফোন না করলে ঘুমের মাঝে আরো কত কি হত কে জানে! -হ্যালো -ভাল আছ এষা? -হ্যাঁ। কে বলছেন? -কেন চিনতে পারছ না? -না। কে হাসান ভাই নাকি? -না হাসান না। -তাহলে কে? -তুমি এখন কি পড়ে আছ এষা? স্কার্ট না সালোয়ার কামিজ? -থাপড়ায় গালের দাঁত ফেলে দিব হারামীর বাচ্চা। এই বলে ফোন রেখে দিয়ে কলারের নাম্বার চেক করলাম।
অপরিচিত নাম্বার, মোবাইলে সেইভ করা ছিল না। ব্যাটা জানত যে আমি ঘুমাচ্ছি, তাই ফোন ধরার আগে নাম্বার চেক করব না। তাই পরিচিত মানুষের মত কথা বলার চেষ্টা করছিল। হঠাত মনে হল আমিই বা হাসান ভাই নাকি জিজ্ঞেস করলাম কেন? হাসান ভাই ত মারা গেছেন অনেকদিন হল। রাগ নামিয়ে আবার ঘুমাবার চেষ্টা করলাম। রাত তখন ক’টা বাজে জানতে ইচ্ছা হচ্ছিল, কিন্তু মোবাইলের আলো চোখে লাগবে বলে আর সময় দেখলাম না। এর কিছুক্ষন পর আবার ফোন বেঁজে উঠল। বুঝতে পারলাম ওই বদমাশ লোকটা আবার ফোন করেছে। তাই কল রিসিভ করলাম না। ফোন বন্ধ করে ঘুমাবার চেষ্টা করলাম আর হঠাত লোড শেডিং শুরু হল। এখন যে আর গরমে ঘুম আসবে না তা পুরোপুরি নিশ্চিত। তবু গরমে হাসফাস করতে করতে ঘুমাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোন কাজ হল না। পাশের খাঁটের দুই রুমমেট তখন রুমে ছিল না। বোধহয় ওদের আজ নাইট ডিউটি। থাকলে নাহয় ওদের সাথে গল্প করে সময় পার করা যেত। অনেক্ষন অপেক্ষার পরও ইলেকট্রিসিটি না আসায় মনে হল এভাবে কষ্ট করে শুয়ে থাকার কোন মানে হয় না। ছাঁদে গিয়ে বসে থাকি, তাতে গরম কিছুটা হলেও কম লাগবে। মোবাইল অন করে মোবাইলের আলোয় পথ দেখে ছাঁদে চলে এলাম। ছাঁদে আসার পর আবার মোবাইল বাঁজতে শুরু করল। এবার কল না কেঁটে বদমাশটা কে কিছু শক্ত কথা শুনিয়ে দেবার কথা ভাবলাম। তা না হলে ব্যাটা হয়ত কালও আবার ফোন করবে। তাই ফোন ধরে ধমকের সুরে বললাম, -হ্যালো কে আপনি? -আমি অনেক দূর থেকে তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি এষা। প্লিজ আমায় ভুল বুঝো না। -আপনি কে সেটা কি বলবেন? নাহলে আমি ফোন রেখে দিব। -আমি হাসান। -আপনি হাসান ভাই না আমি জানি। কারন হাসান ভাই মারা গেছেন। আপনি কে সত্যি করে বলুন। -সত্যি এষা আমি হাসান। আমি এখন ছাঁদে তোমার কাছে এলে কি তুমি আমায় বিশ্বাস করবে? একথা শুনার পর আর কথা বাড়ানোর সাহস রইল না। বুঝতে পারলাম লোকটা আশে পাশের কোন বিল্ডিং থেকে আমাকে দেখতে পাচ্ছে। তাই কল কেটে দিলাম। প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হল। কিছুদিন আগেই মোবাইলের সিম পাল্টেছি। এরই মাঝে হয়ত ক্লাসের কারো কাছ থেকে নাম্বারটা কেউ পেয়ে গেছে। অথবা ক্লাসের কেউই আমাকে ফোন করে পরীক্ষা করছে। আমি তাঁর কথায় সাড়া দিলে হয়ত কথা রেকর্ড করে ক্লাসের সবার কাছে তা কোনভাবে পৌছে দিবে আর আমাকে খারাপ সাজাবার চেষ্টা করবে।
এ অবস্থায় আর ছাঁদে দাঁড়িয়ে থাকার কোন মানে হয় না, কারন লোকটা আমায় ঘুমাবার পোশাকে দেখতে পাচ্ছে। তবে অন্ধকার থাকায় তা নিয়ে আমি খুব একটা শঙ্কিত হলাম না। আমি তখন ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভিতর আশে পাশের বিল্ডিং গুলার দিকে তাকিয়ে কিছু বের করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোন লাভ হলো না। তাই রুমে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। মোবাইলের আলো জ্বেলে ছাঁদের দরজার দিকে এগুতে যাব আর ঠিক তখন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম কে যেন আমার কানের কাছে ফিস ফিস করে বলে উঠল, এষা যেয়ো না দাঁড়াও। আমি আসছি। একথা শুনার পর প্রচন্ড ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে যাবার মত অবস্থা হল। মনে হল যেন ছাঁদে আমি ছাড়া আর অন্য কেউও আছে। ভয়ে আমি তখন মারা যাচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম ছাঁদে যে আছে সে যদি মানুষ হয় তাহলে হয়ত আমার অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। আর যদি সেটা অন্য কিছু হয় তাহলে যেন সেটা আমার চোখের সামনে না আসে, কারন আমি সেই ভংকর দৃশ্য সহ্য করতে পারব না। কিছু বুঝে উঠবার আগেই আরো একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। হঠাত কোথা থেকে যেন একটা আলোর ঝলকানি এসে ছাঁদের মেঝেতে পড়ল আর আমি দেখতে পেলাম মেঝেতে একটা কালো ছাঁয়া মূর্তি বসে আসে।ছায়ামূর্তিটার মানুষের মত হাত পা আছে কিন্তু শরীরের গঠন মানুষের মত নয়। আমায় দেখতে পেয়ে ছায়ামূর্তিটা দ্রুত পানির ট্যাংকির দিকে হামাগুড়ি দিয়ে চলে গেল আর ধীরে ধীরে পানির ট্যাংকির দেয়ালে মিশে যেতে শুরু করল।
এর পরে কি হয়েছিল আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। সম্ভবত আমি সেখানেই জ্ঞান হারাই। জ্ঞান ফিরে পাবার পর জানতে পারি আমি প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলাম আর চিৎকার করে মা’কে ডাকছিলাম। আমার চিৎকার শুনে নিচ থেকে ছাত্রীরা ছুটে এসে আমাকে রুমে নিয়ে যায়। মেডিকেলের ছাত্রী হিসেবে ভূত প্রেতে বিশ্বাস করাটা আমার মোটেই শোভা পায় না। তবুও আমি পরবর্তীতে এই ঘটনার কোন ব্যাখ্যা দাড় করাতে পারিনি। জানিনা হাসান ভাই কি সত্যি সত্যি সেদিন আমাকে স্বপ্নের ওই ডাক্তারের হাত থেকে বাঁচাতে এসেছিলেন কিনা। কারন সেই স্বপ্ন আমি এর আগেও বেশ কয়েকবার দেখেছিলাম। এই স্বপ্নের পিছনে একটা কারনও আছে, তবে সেই কারনের সাথে এই ঘটনার কোন সম্পর্ক নেই বলে তা উল্লেখ করছি না। এষা ময়মনসিংহ চিঠিটি পড়ার পর এষাকে ফোন করলেন সিদ্দিকুর রহমান। -হ্যালো স্লামালাইকুম -মিস্ এষা বলছেন? -জ্বী। কে বলছেন প্লিজ? -আমি মাসিক হরর পত্রিকার সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান । -ও আচ্ছা। আমার লেখাটা কি ছাঁপানো হচ্ছে? -জ্বী। তবে তাঁর আগে আপনার আরো সাহায্যের প্রয়োজন। -বলুন আমি কি করতে পারি? -আপনি বোধহয় জানেন আমাদের চিঠিপত্র বিভাগে এ ধরনের লেখার সাথে সম্পাদকের দাড় করানো একটা ব্যাখ্যা থাকে।
আর সেটার জন্য আপনার সাহায্যের প্রয়োজন। -আমাকে কি আপনাদের অফিসে আসতে হবে? -যদি আসতে পারেন তাহলে খুবই ভাল হয়। আর নাহলে ফোনেই কাজটা সেরে নেয়া যাবে। কখন ফোন করলে আপনার সাথে সময় নিয়ে কথা বলা যাবে? -আমি আসলে এখন একটু ব্যাস্ত আছি। আপনি চাইলে আমি নিজেই কাল আপনাকে ফোন করব অথবা আপনাদের অফিসে এসে দেখা করে যাব। -আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। -আপনাকেও। ভাল থাকবেন। ফোন রাখার পর সিদ্দিকুর রহমান তাঁর রহস্য ডায়েরীর একটি খালি পাতা খুলে বসলেন। সেখানে দ্রুত কিছু নোট লিখে ফেললেনঃ ১) হাসান সাহেব কে? প্রথমে যেই লোকটি টেলিফোন করেছিল তাঁর গলার স্বর কি হাসান সাহেবের মত ছিল? ধরে নেয়া যাক হ্যাঁ। আর সে কারনেই এষা তাকে প্রথমে হাসান সাহেব মনে করেছিল। কিন্তু এষা কেন ফোনে হঠাত একজন মৃত মানুষের কথা স্মরণ করবে? তাহলে কি হাসান সাহেব এষার খুব কাছের কেউ ছিলেন যাকে এষা এখনো প্রত্যাশা করে? সেই তীব্র প্রত্যাশা থেকে কি এষা মনে করে হাসান ভাই তাঁর কাছে এসেছিল তাঁকে সেই ফরেনসিক বিভাগের ডাক্তারের হাঁত থেকে রক্ষা করার জন্যে? আর তাই সে সাধারন একটা ব্ল্যাংক কল কে হাসান সাহেবের কল মনে করে অনেক কিছু ভেবে বসে? হতে পারে হাসান সাহেবের মৃত্যুর সময় এষা তাঁর কাছে ছিল না, তাই তাঁর অবচেতন মন সব সময় চাইত হাসান সাহেবের সাথে শেষ আরেকটিবার দেখা করতে? কিন্তু মৃত মানুষের কোনভাবেই ফিরে আসা সম্ভব না বলে তাঁর অবচেতন মন সেই ইচ্ছা নিয়ে হতাশায় ভুগছিল। তাই সেদিন সেই স্বপ্ন আর ব্ল্যাংকল এর সাথে কোন সংযোগ ঘটিয়ে তাঁর অবচেতন মন সাধারন কোন ছাঁয়া কে হাসান সাহেবের ছাঁয়ামূর্তিতে রুপান্তর করে? যদি তাই হয় তাহলে এই ঘটনার প্রভাবক হিসেবে অন্য কোন ঘটনা কাজ করেছে যা এষা তখন খেয়াল করেনি।
সেই না জানা ঘটনা কে বের করতে পারলেই অনেক রহস্য বেরিয়ে আসবে। ২) এষা লিখেছে কেউ তাঁর কানের কাছে ফিসফিস করে কথা বলেছিল এবং সে তা স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিল। এই স্পষ্ট শুনতে পাবার ঘটনাই হাসান সাহেবের ছাঁয়ামূর্তির ঘটনার প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। এছাড়াও আরেকটি কারন এই ছাঁয়ামূর্তির অস্তিত্বকে জোড়ালো করতে পারে। এষা লিখেছে তাঁর তখন দুই ধরনের ভয় হচ্ছিল। প্রথমত ছাঁদে যা ছিল তা যদি মানুষ হয় তাহলে তাঁর বড় কোন ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। দ্বিতীয়ত সেটা যদি মানুষ না হয় তাহলে সে প্রচন্ড ভয় পাবে। একজন মেডিকেলের ছাত্রী হিসবে এষা কখনো ভূত প্রেত বিশ্বাস করত না। তাই লোকলজ্জার ভয়ে তাঁর জাগ্রত মন চাচ্ছিল এটা যেন কোন মানুষ না হয়, কারন এষা জানে ভূত বলে কিছু নেই, আর এটা মানুষ না হলে ভূত হবারও সম্ভাবনা নেই, হয়ত মনের ভুল হতে পারে যা ভাল করে লক্ষ্য করলে বুঝা যাবে। অপরদিকে এষার অবচেতন মন প্রচন্ডভাবে হাসান ভাই কে প্রত্যাশা করছিল। সেই ভয়ংকর মূহুর্তে এষার চেতন ও অবচেতন দু’টা মনের ইচ্ছাই এক হবার কারনে এষা ছাঁয়ামূর্তির অস্তিত্বকে বিশ্বাস করেছিল। ঘটনার ব্যাখ্যা দাড় করাতে অবশ্যই আমাদের কোন অলৌকিক ঘটনা কে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। তাহলে এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এষার কানে কে ফিস ফিস করে কথা বলেছিল? আশেপাশে যদি কেউ না থাকে তাহলে একমাত্র মোবাইল ফোনেই সে কথা শুনতে পাবে। কিন্তু এষা তখন কলারের সাথে কথা বলছিল না। তাই মোবাইলে সে ফিস ফিস কন্ঠটি শুনেনি।
আবার এষা লিখেছে সে মোবাইলের আলোয় পথ দেখে ছাঁদের দরজার দিকে এগুচ্ছিল। তাহলে কি হতে পারে সে যখন মোবাইলে আলো জ্বালবার জন্য মোবাইলের বোতামে চাপ দেয় তখন সেই কলারের কল রিসিভ হয়ে যায় আর সেই কলার কাছের কোন বিল্ডিং থেকে এষাকে ছাঁদের দরজার দিকে না যেতে বলে? আর মোবাইলের সে কথাই এষার কানের কাছে ফিস ফিস করে কথা বলার মত মনে হয় কারন সে জানত না সে ভুলে কল রিসিভ করে ফেলেছে? এই ব্যাখ্যা যুক্তি সংগত। ৩) এখন ছাঁয়ামূর্তির অস্তিত্বকে মিথ্যা প্রমাণ করতে হলে যে কারনটি দাড় করানো যেতে পারে তা হল এষা যা দেখেছিল তা ঘুমের ঘোরে দেখেছিল। অর্থাৎ, এষা লিখেছে ছাঁদে তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিল কারন লোডশেডিং হচ্ছিল। কিন্তু ঘুটঘুটে অন্ধকারে কোন ছাঁয়ামূর্তি দেখা সম্ভব নয়। তাহলে এষা আরো আগেই অন্য কোন কারনে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু জ্ঞান ফিরে পাবার পর সেই ভয়ের কারন তাঁর মনে থাকে না বরং অজ্ঞান থাকাকালীন সময়ে স্বপ্নে যেই ছাঁয়ামূর্তি দেখতে পায় তাকেই সে সত্যিকার ছাঁয়ামূর্তি বলে মনে করেছিল। এবার ধরা যাক এষা সত্যি ছাঁয়ামূর্তি দেখার পর জ্ঞান হারিয়েছিল।আর যদি এষা সত্যি ছাঁয়ামূর্তি দেখে জ্ঞান হারায় তাহলে অবশ্যই সেই সময় কিছুটা হলেও আলো ছিল।
এষার মতে ছাঁয়ামূর্তিটা এসেছিল একটা আলোর ঝলকানির মাধ্যমে। তাহলে কি ধরে নেয়া যায় তখন হঠাত ইলিকট্রিসিটি চলে আসে বলে আসে পাশের বাড়িগুলা তে আলো জ্বলে উঠে আর এষা সেই আলোকেই আলোর ঝলকানি মনে করে? এই ঘটনা কে সাহায্য করতে আরেকটি ঘটনার বাস্তব রুপান্তর প্রয়োজন। এষা কেন ইলিক্ট্রিসিটি ফিরে আসা খেয়াল করবে না? হতে পারে সে ইলেক্ট্রিসিটি ফিরে আসার সময় প্রচন্ড ভয় পেয়েছিল অর্থাৎ ছাঁয়ামূর্তিটাকে দেখেছিল? আর যদি ছাঁয়ামূর্তিটা কে দেখেই থাকে তাহলে সেই ছাঁয়ামূর্তিটা এষার কাছ থেকে ধীরে ধীরে দূরে সরে গেল কেন? হতে পারে এষার কাছের বিল্ডিং থেকে যেই মানুষ টা এষার সাথে কথা বলছিল হঠাত ইলেকট্রিসিটি চলে আসবার কারনে সে দ্রুত জানালা থেকে সরে যায় আর তাঁর ছাঁয়া ধীরে ধীরে দেয়ালে মিলিয়ে যায়? কিন্তু এষা লিখেছে ছাঁয়ামূর্তির মানুষের মত হাত পা ছিল কিন্তু শরীরের গঠন মানুষের মত না। শরীরের গঠন মানুষের মত না বলতে সে কি বুঝিয়েছে? ছাঁয়ামূর্তিটিকে যদি তাঁর অবচেতন মন নিয়ে আসে তাহলে সেই অবচেতন মন তাঁর শরীরের গঠন মানুষের মত করে কেন আনল না? আর সে যদি কোন মানুষের সাধারন ছাঁয়া দেখেও ভয় পায় তাহলেই বা সেই ছাঁয়ার শরীর মানুষের মত ছিল না কেন? এখানেই যুক্তি কাজ করছে না। তাই ছাঁয়ামূর্তির অস্তিত্ব সত্যি কি মিথ্যা তা মোবাইলে ফিস ফিস কন্ঠ শুনবার মত সহজে প্রমাণ করা গেল না।
৪) ফরেনসিক বিভাগের সেই ডাক্তার কে? এষা কেনই বা এধরনের স্বপ্ন আগে দেখত? তা একমাত্র এষার সাথে কথা বলেই জানা যাবে। ৫) উপরের কোন যুক্তিই কাজ করবে না যদি হাসান সাহেব এষার খুব কাছের মানুষ না হয়ে থাকেন। অর্থাৎ এষার অবচেতন মন যদি হাসান সাহেব এর দেখা পেতে না চায়। কিন্তু তা হবার সম্ভাবনা কম কারন এষা চিঠির শেষে লিখেছে যে হাসান সাহেব কি সত্যি এষা কে ফরেনসিক বিভাগের ডাক্তার এর হাত থেকে রক্ষা করতে এসেছিল কিনা তা সে জানে না। খুব কাছের মানুষ না হলে দূরের কাউকে এভাবে ছুটে আসার কথা এষা কখনো চিন্তা করবে না। আর এসব কারনেই এষার সাথে কথা বলে আরো কিছু তথ্য জানতে হবে, যা রহস্য সমাধানে সাহায্য করবে। আপাতত শুধু একটা বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যেতে পারে যে এষা আসলে মোবাইলে সেই কলারের ফিস্ ফিস্ কন্ঠ শুনেছিল। এই সূত্র ধরেই সামনে এগুতে হবে। এখন এষাকে যে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করতে হবে তা হলঃ ১) হাসান সাহেব কে ছিলেন? ২) জ্ঞান ফিরে পাবার পর এষা মোবাইলে সেই কলারের কল কতবার রিসিভ করেছিল সেটা কি চেক করেছিল ? দু’বার না তিনবার? ৩) সেই কলারের নাম্বার নিশ্চয়ই এষা মোবাইল থেকে সংগ্রহ করে রেখেছিল? সেই নাম্বারে কি পরে কখনো ফোন করা হয়েছিল কলারের সন্ধান জানতে? ৪) ছায়াঁমূর্তির শরীরের গঠন তাঁর কাছে মানুষের মত মনে হয়নি কেন? ৫) ফরেনসিক বিভাগের সেই ডাক্তার কে? এর পরদিন সিদ্দিকুর রহমান এষার সাথে ফোনে কথোপকথোন সেরে নিলেন এবং মূল পাঁচটি প্রশ্নের জবাব তাঁর ডায়েরীতে লিখে রাখলেনঃ
১) হাসান সাহেব এষার মেডিকেল কলেজের সিনিয়র স্টুডেন্ট ছিলেন। এষার সাথে তাঁর বিয়ে হবার কথা ছিল। হাসান সাহেব এম,বি,বি,এস শেষ করে লন্ডনে চলে যান লেখাপড়ার জন্য কিন্তু লন্ডনে একটা রোড এক্সিডেন্টে তিনি মারা যান দু’বছর আগে। হাসান সাহেবের সাথে এষার সম্পর্ক খুব বেশিদিনের ছিল না বলে এষা হাসান সাহেবের পরিবার এর ঠিকানা জানত না। তাই হাসান সাহেবের মৃত্যুর সংবাদটি পায় হাসান সাহেবের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছে। ২) কল কতবার রিসিভ করা হয়েছিল কিংবা কলারের নাম্বার কি ছিল তা এষা জানতে পারেনি,কারন তাঁর মোবাইল ফোনটি চুরি হয়ে গিয়েছিল। সে যখন চিৎকার করে জ্ঞান হারায় তখন তাঁর চিৎকার শুনে হলের ছাত্রীরা ছুটে এসে তাকে রুমে নিয়ে যায়, আর পরবর্তীতে কেউ তাঁর ফোনটি সরিয়ে ফেলে। ৩) তিন নম্বর মন্তব্য অনুযায়ী -জানা যায় নি। ৪) এষা বলতে চাচ্ছে ছাঁয়ামূর্তির বুক থেকে কোমরের দিকটা ছিল অস্বাভাবিক রকমের চওড়া অর্থাৎ তাঁর শরীরের অনুপাত কখনোই মানুষের মত ছিল না। আর সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার ছিল যে ছাঁয়ামূর্তির দুপাশে দু’টি পাখা ছিল। এই পাখার কারনেই সে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছিল যে এটা কোন মানুষের ছাঁয়া নয়। ৫) ফরেনসিক বিভাগের সেই ডাক্তার এষা কে পছন্দ করতেন। হাসান সাহেবের মৃত্যুর পর এষার সাথে তাঁর কিছুটা সম্পর্ক গড়ে উঠে। পরবর্তীতে অনেক রোগীর অভিযোগে সেই ডাক্তারের নামে একটা স্ক্যান্ডাল ছড়িয়ে পড়লে এষা সেই সম্পর্ক কে আর এগুতে দেয়না। কিন্তু ডাক্তার তারপরও এষাকে বিয়ের জন্য চাপ দিয়ে যায়। এর প্রায় পনের দিন পর ‘মাসিক হরর’ পত্রিকায় সম্পাদকের ব্যাখ্যা সহ এষার চিঠিটি ছাঁপা হয়। সম্পাদকের ব্যাখ্যার খানিকটা অংশঃ …………লন্ডনে হাসান সাহেবের একটা রোড এক্সিডেন্ট হয় ঠিকই কিন্তু তিনি তাতে মারা যান না। বেঁচে গেলেও তিনি শারীরিকভাবে পংগু হয়ে যান এবং হুইল চেয়ার ব্যাবহার করতে শুরু করেন। এমতাবস্থায় তিনি এষা ও তাঁর পরিবারের কথা চিন্তা করে এষা কে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেন।কারন এই পংগুত্বকে এষা সহজভাবে নিলেও এষার পরিবার হয়ত সার্বিকভাবে এই বিয়েতে খুশী থাকবে না, তাছাড়া তিনিও চান না তাঁর ভালবাসার মানুষটি সারাজীবন একজন হুইলচেয়ারে বসে থাকা মানুষের সাথে ঘর করুক। তাই তিনি তাঁর বন্ধুর মাধ্যমে এষাকে তাঁর মৃত্যুর খবরটি পৌছে দিয়েছিলেন।
হাসান সাহেবের বাবা মা গ্রামে থাকতেন বলে এষাও পরে আর তাঁর বাবা মা’র সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি। লন্ডন থেকে ডিগ্রী নিয়ে হাসান সাহেব তখন দেশে ফিরে এসেছিলেন। সম্ভবত অল্প কিছুদিন পর তিনি আবার লন্ডন ফিরে যেতেন কারন ফোনে তিনি বলেছিলেন তিনি অনেক দূর থেকে এষার সাথে দেখা করতে এসেছেন। এষা যেন জানতে না পারে তাই তিনি এষার হোস্টেলের পাশের একটি বাড়িতে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিলেন কিছুদিনের জন্যে। হাসান সাহেব যেহেতু একই মেডিকেলের ছাত্র ছিলেন তাই তাঁর জন্য এ কাজটি করা খুব একটা অসুবিধের কিছু ছিল না। তিনি কিছুদিন এষা কে লুকিয়ে লুকিয়ে সেই বাড়ী থেকে দেখে চোখ জুড়াতেন। কখনো ভাবেন নি এষার সামনে তিনি যাবেন। এষা সাধারনত বিকেলের মধ্যে হলে ফিরে আসে, কিন্তু সেদিন এসেছিল অনেক রাত করে। তাই তিনি এষাকে দেখতে পাননি। আর এই না দেখার কষ্ট তাকে এষাকে ফোন করতে বাধ্য করে, কারন হয়ত পরদিনই তিনি দেশে ছেড়ে চলে যাবার কথা ভাবছিলেন। ফোন ধরার পর এষা যখন জিজ্ঞেস করে কে ফোন করেছে তখন তিনি ভুল করে বলে ফেলেন ‘কেন চিনতে পারছ না?’ এর জবাবে এষা হাসান সাহেবের কন্ঠ চিনে ফেললে তিনি তা অস্বীকার করেন আর তাঁর মিথ্যা কে আরো জোড়ালো করার জন্য তিনি ইচ্ছে করে এষাকে অশ্লীল একটা প্রশ্ন করেন বসেন, যেন এষা এটা কে একটা ব্ল্যাংক কল হিসেবে মনে করে। এষার অবচেতন মন সব সময়………………… এষাকে ছাঁদে দেখে হাসান সাহেব প্রচন্ডভাবে এষার সাথে কথা বলতে ইচ্ছাপোষন করেন।তখন ছিল গভীর রাত। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকলে মানুষের আবেগ অনেক সময় প্রবণ হয়ে উঠে এবং তা অনেক কিছু মানতে চায় না। তাই এই পর্যায়ে তিনি এষার সাথে দেখা করে সব কিছু খুলে বলতে চেয়েছিলেন। সেই সময় হঠাত ইলেকট্রিসিটি চলে আসে আর এষা হুইল চেয়ারে বসা হাসান সাহেবের ছাঁয়া ছাঁদের মেঝেতে দেখতে পায়। এষা যে হাসান সাহেবের ছাঁয়া দেখতে পেয়েছে তা তিনি বুঝতে পারেন এবং সেকারনে দ্রুত তিনি জানালা থেকে সরে যান।
এখন প্রশ্ন থাকতে পারে হাসান সাহেব ত এষার সাথে দেখা করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাহলে তিনি কেন দ্রুত সরে গেলেন? হতে পারে ইলেকট্রিসিটি চলে আসার পর তিনি এষাকে ছাঁদে আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন আর তখন তিনি মত পাল্টান।চারদিকের আলো তাঁর আবেগ কে দমন করতে সাহায্য করে। অথবা এমনো হতে পারে এষাকে শোবার পোষাকে দেখে ফেলায় এষা লজ্জিত হতে পারে বলে তিনি পাশের বাড়িতে থাকবার বিষয়টি গোপন করতে চেয়েছিলেন। এষাকে ফোন করা থেকে শুরু করে এষার জ্ঞান হারানো পর্যন্ত যা কিছু হয়েছিল তার সব কিছুর মূলে রয়েছে হাসান সাহেবের অনিয়ন্ত্রিত আবেগ। আর সেই আবেগ হাসান সাহেবকে অনেক যুক্তিহীন সিদ্ধান্ত নিতে কিংবা দ্রূত সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য করেছিল। তিনি যখন হুইল চেয়ারে করে জানালা থেকে দ্রুত সরে যাচ্ছিলেন তখন এষা তাঁর হুইল চেয়ারের ছাঁয়াকে ছাঁয়ামূর্তিটির পাখা ভেবে ভুল করে। আর তখনই এষা নিশ্চিত হয়ে যায় এটা কোন মানুষের ছাঁয়া নয়। হাসান সাহেবের হুইল চেয়ারে করে দ্রুত সরে যাবার ঘটনা কে এষা ছাঁয়ামূর্তির হামাগুড়ি দিয়ে দূরে সরে যাওয়া মনে করে………… ফরেনসিক বিভাগের সেই ডাক্তারের সাথে এষার কিছুটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল আর পরবর্তীতে তা এগুতে পারেনি ডাক্তারের স্ক্যান্ডালের কারনে ( সম্ভবত স্ক্যান্ডালটি নারীঘটিত কোন ব্যাপার ছিল )। তাই সেই সব মিলিয়ে এষা প্রায় সেই ডাক্তার কে নিয়ে এধরনের স্বপ্ন দেখত। সেদিন হাসান সাহেবের ফোনের রিং এ এষার কাঁচা ঘুম ভেংগে যায় আর ফোন ধরে সে হাসান সাহেবের কন্ঠ শুনতে পায়। হাসান সাহেবের পরিচিত কন্ঠ ও সেই স্বপ্ন এষার অবচেতন মনকে হাসান সাহেবের ছাঁয়ামূর্তির অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে সাহায্য করে আর এষা তখন ভয়ে জ্ঞান হারায়। আমার এই ব্যাখ্যা শুধুমাত্র এষার সাথে কথোপকথোনের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। ব্যাখ্যা তখনই গ্রহনযোগ্য হবে যদি হাসান সাহেব মারা না যান। তা জানা সম্ভব নয় কারন হাসান সাহেবের একমাত্র বন্ধু যাকে এষা চিনত তিনি কিছুদিন আগে মারা যান।
এছাড়াও মেডিকেল কলেজের রেজিস্ট্রি অফিস থেকে হাসান সাহেবের গ্রামের ঠিকানা সংগ্রহ করতে চাইলে খুবই অদ্ভুতভাবে হাসান সাহেবের ঠিকানার পাতাটি ছেঁড়া পাওয়া যায়। তবে এষার বর্ণিত ছাঁয়ামূর্তির সাথে প্রাচীন গ্রীক পৌরাণিক কাহিনীর পাখাওয়ালা শয়তানের মিল পাওয়া যায়। কাহিনীর বর্ণনা অনুযায়ী শয়তান অমাবশ্যার রাতে প্রজননের জন্য মৃত আত্মার উপর ভর করে কুমারী মায়েদের সাথে মিলনের মাধ্যমে নতুন শয়তানের জন্ম দেয়। আর তার জন্য অবশ্যই পরিচিত মানুষের বেশ ধরা প্রয়োজন। হতে পারে এষার গর্ভে তখন ওই ডাক্তারের সন্তান ছিল যা সে সবসময় গোপন করে চলেছে এবং তাই সে লেখাতেও স্বপ্নের কারন উল্লেখ করেনি। হয়ত আমার কাছে সেই পৌরাণিক কাহিনীর শয়তানের কথা শুনে এষা নিজেই রেজিস্ট্রি অফিসে যোগাযোগ করে হাসান সাহেবের ঠিকানার পাতাটি ছিঁড়ে ফেলে, কেননা হাসান সাহেবের মৃত্যুর রহস্য উদঘাটিত হলে হয়ত নতুন কোন অজানা তথ্য বেরিয়ে আসবে যা এষা কাউকে জানতে দিতে চায়না।