চোরের অংশীদার এবং কাফেলার বন্ধু

কাফেলার সাথী এবং চোরের অংশীদার

পুরনো দিনের কথা। তখন ব্যবসা-বাণিজ্য চলতো শহর থেকে শহরে সফরের মাধ্যমে। মালামাল এক শহর থেকে আরেক শহরে নিয়ে যাওয়া হতো ঘোড়া বা উটে, যাতে বেশি দামে বিক্রি করে ভালো লাভ করা যায়। কিন্তু একটা সমস্যা ছিল—রাস্তাঘাট ছিল বিপজ্জনক। এখনকার মতো মসৃণ, পরিপাটি, আলোময় আর নিরাপদ ছিল না।

সেই সময়ের পথ ছিল আঁধারে ভরা, বিপজ্জনক। মরুভূমি, জনহীন প্রান্তর—এসব জায়গায় রাত কাটাতে হতো। আর এসব জায়গাতেই ওঁৎ পেতে থাকতো সন্ত্রাসী, চোর-ডাকাতের দল। ব্যবসায়ী বা বাণিজ্য কাফেলা পথ অতিক্রম করার সময় ডাকাতরা হামলা চালিয়ে লুটে নিতো সব সম্পদ। এ কারণে ব্যবসায়ীরা একসাথে দলবেঁধে চলতো, যাতে ডাকাতদের আক্রমণের আশঙ্কা কমে।

একদিন এমনই এক কাফেলা এক শহর থেকে আরেক শহরের পথে রওনা হলো। কাফেলায় ছিল বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী, প্রত্যেকের কাছেই প্রচুর পরিমাণে মালপত্র। এগুলো বিক্রি করে লাভ করার আশায় তারা পথ পাড়ি দিচ্ছিল।

দু’দিন চলার পর কাফেলা এক বিপজ্জনক জায়গায় পৌঁছালো। রাস্তা ছিল আঁকাবাঁকা, চড়াই-উতরাইময়। এমন জায়গাগুলো ডাকাতদের জন্য আদর্শ লুকানোর স্থান। ব্যবসায়ীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়লো। রাত নেমে আসার পর ভয়ের মাত্রা আরও বেড়ে গেল।

কাফেলার গাইড সবাইকে বললো, “আমাদের ভালো একটা জায়গা খুঁজে বিশ্রাম নেওয়া উচিত। সকালে সূর্যের আলোয় এগোলে ডাকাতের ভয় কম থাকবে।”

তারপর কাফেলার প্রধান নির্দেশ দিলো, “মূল্যবান জিনিসপত্র বিশ্রামের জায়গা থেকে একটু দূরে লুকিয়ে রাখো।” সবাই তাই করলো। কিন্তু একজন ব্যবসায়ী একেবারেই উদ্বিগ্ন হলো না। সে অন্যদের সাহায্য করলো, কিন্তু নিজের মালামাল বিশ্রামের জায়গার কাছেই রেখে দিলো।

রাত নামতেই সে বললো, “আমাদের উচিত পাহারার ব্যবস্থা করা। একজনের পর একজন পাহারা দেবো, তাহলে নিরাপদে থাকতে পারবো।” সবাই এতে রাজি হলো।

সে বললো, “ঠিক আছে, আমি প্রথম পাহারা দেবো। দুই ঘণ্টা পর অন্য একজনকে ডাকবো, সে পাহারা দেবে, আমি ঘুমাবো।”

সবাই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লো। আর ভাবলো, কী সৌভাগ্য, আমাদের দলে এত ভালো একজন মানুষ আছে!

কিন্তু ব্যবসায়ীটি ধীরে ধীরে পথের মোড়ে গিয়ে ডাকাতদের ইশারা করলো। একটা ছায়া দেখে উচ্চস্বরে বললো, “তোমরা যদি ডাকাত হও, তাহলে আমাকে সর্দারের কাছে নিয়ে যাও। গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।”

ডাকাতরা তার হাত-পা বেঁধে সর্দারের কাছে নিয়ে গেলো। ব্যবসায়ী বললো, “আমাদের কাফেলা কাছেই বিশ্রাম নিচ্ছে। আমি জানি, তারা তাদের মূল্যবান জিনিস কোথায় লুকিয়েছে। কিন্তু শর্ত আছে—আমার মাল নিতে পারবে না, আর লুটের ভাগ আমাকে দিতে হবে।”

ডাকাত সর্দার রাজি হলো।

ব্যবসায়ী দ্রুত ফিরে এসে অন্যদের ঘুমিয়ে পেলো। একজনকে ডেকে বললো, “দুই ঘণ্টা হয়ে গেছে, এবার তোমার পাহারার পালা। আমি ঘুমাই।”

অল্প কিছুক্ষণ পরই ডাকাতরা হামলা করলো। পাহারার দায়িত্বে থাকা লোকটি চিৎকার করে সবাইকে ডাকলো। কিন্তু কিছুই করার ছিল না। ডাকাতরা সব লুট করে নিয়ে গেলো।

সকাল হলে কাফেলার সবাই কান্নাকাটি করতে লাগলো। কিন্তু তারা অবাক হয়ে দেখলো—একজন ব্যবসায়ীর মালামাল চুরি হয়নি!

কেউ বললো, “ও আমাদের জন্য কত কিছু করেছে, তার পবিত্র অন্তরই তাকে রক্ষা করেছে!”

আরেকজন বললো, “সে-ই প্রথম পাহারার দায়িত্ব নিয়েছিল, তার পুরস্কার সে পেয়েছে!”

অন্যজন বললো, “আমাদের মাল তো পাথরের নিচে লুকানো ছিল, সে যেহেতু তারটা কাছেই রেখেছিল, তাই ডাকাতরা দেখতে পায়নি!”

ঠিক তখনই সেই ব্যবসায়ী বললো, “তোমাদের কান্নাকাটি সহ্য হয় না, আমি একাই চললাম!”

সে উটের পিঠে মাল বোঝাই করে রওনা দিলো। কিছু দূর গিয়ে সে ডাকাতদের আস্তানায় পৌঁছালো এবং তার প্রাপ্য অংশ বুঝে নিলো।

দু-তিন দিন পর কাফেলার ব্যবসায়ীরা শহরে গিয়ে দেখে—তাদের সেই সাথী মালামাল বিক্রি করছে!

একজন খেয়াল করলো, তার দোকানে কাফেলার চুরি যাওয়া জিনিসও আছে। সবাই একসাথে কাজির কাছে গেলো।

কাজি ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করালো।

ব্যবসায়ীকে দেখে কাজি বললো, “আশ্চর্য! তুমি তাহলে ‘চোরের পার্টনার আর কাফেলার সাথী’! তোমাকে এমন শাস্তি দেবো, যা দেখে আকাশের পাখিরাও কান্না করবে!”

সেই থেকেই এই কথা প্রচলিত হলো—
“কাফেলার সাথী এবং চোরের অংশীদার!”

অপরাজিতা-রুপকথা

কীসে আনন্দ? যেখানে অন্তর খুশি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *