চোরাই ধন– ১ম অংশ– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

মহাকাব্যের যুগে স্ত্রীকে পেতে হত পৌরুষের জোরে ; যে অধিকারী সেই লাভ করত রমণীরত্ন । আমি লাভ করেছি কাপুরুষতা দিয়ে , সে কথা আমার স্ত্রীর জানতে বিলম্ব ঘটেছিল । কিন্তু , সাধনা করেছি বিবাহের পরে, যাকে ফাঁকি দিয়ে চুরি করে পেয়েছি তার মূল্য দিয়েছি দিনে দিনে ।

দাম্পত্যের স্বত্ব সাব্যস্ত করতে হয় প্রতিদিনই নতুন করে , অধিকাংশ পুরুষ ভুলে থাকে এই কথাটা । তারা গোড়াতেই কাস্টম্‌ হৌসে মাল খালাস করে নিয়েছে সমাজের ছাড়চিঠি দেখিয়ে , তার পর থেকে আছে বেপরোয়া । যেন পেয়েছে পাহারাওয়ালার সরকারি প্রতাপ উপরওয়ালার দেওয়া তকমার জোরে ; উর্দিটা খুলে নিলেই অতি অভাজন তারা ।

বিবাহটা চিরজীবনের পালাগান ; তার ধুয়ো একটামাত্র , কিন্তু সংগীতের বিস্তার প্রতিদিনের নব নব পর্যায়ে । এই কথাটা ভালোরকম করে বুঝেছি সুনেত্রার কাছ থেকেই । ওর মধ্যে আছে ভালোবাসার ঐশ্বর্য , ফুরোতে চায় না তার সমারোহ ; দেউড়িতে চার-প্রহর বাজে তার সাহানা রাগিণী । আপিস থেকে ফিরে এসে একদিন দেখি আমার জন্যে সাজানো আছে বরফ-দেওয়া ফল্‌সার শরবত , রঙ দেখেই মনটা চমকে ওঠে ; তার পাশেই ছোটো রুপোর থালায় গোড়ে মালা , ঘরে ঢোকবার আগেই গন্ধ আসে এগিয়ে । আবার কোনোদিন দেখি আইসক্রীমের যন্ত্রে জমানো শাঁসে রসে মেশানো , তালশাঁস এক-পেয়ালা , আর পিরিচে একটিমাত্র সূর্যমুখী । ব্যাপারটা শুনতে বেশি কিছু নয় কিন্তু বোঝা যায় , দিনে দিনে নতুন করে সে অনুভব করেছে আমার অস্তিত্ব । এই পুরোনোকে নতুন করে অনুভব করার শক্তি আর্টিস্টের । আর ইতরে জনাঃ প্রতিদিন চলে দস্তুরের দাগা বুলিয়ে । ভালোবাসার প্রতিভা সুনেত্রার নবনবোন্মেষশালিনী সেবা । আজ আমার মেয়ে অরুণার বয়স সতেরো , অর্থাৎ ঠিক যে বয়সে বিয়ে হয়েছিল সুনেত্রার । ওর নিজের বয়স আটত্রিশ , কিন্তু সযত্নে সাজসজ্জা করাটাকে ও জানে প্রতিদিন পুজোর নৈবেদ্য-সাজানো , আপনাকে উৎসর্গ করবার আহ্নিক অনুষ্ঠান ।

সুনেত্রা ভালোবাসে শান্তিপুরে সাদা শাড়ি কালো পাড়ওয়ালা । খদ্দর-প্রচারকদের ধিক্কারকে বিনা প্রতিবাদে স্বীকার করে নিয়েছে; কিছুতেই স্বীকার করে নি খদ্দরকে । ও বলে, ‘ দিশি তাঁতির হাত , দিশি তাঁতির তাঁত , এই আমার আদরের । তারা শিল্পী , তাদেরই পছন্দে সুতো , আমার পছন্দ সমস্ত কাপড়টা নিয়ে । আসল কথা , সুনেত্রা বোঝে হালকা সাদা রঙের শাড়িতে সকল রঙেরই ইশারা খাটে সহজে । ও সেই কাপড়ে নূতনত্ব দেয় নানা আভাসে , মনে হয় না সেজেছে । ও বোঝে , আমার অবচেতন মনের দিগন্ত উদ্ভাসিত হয় ওর সাজে — আমি খুশি হই , জানি নে কেন খুশি হয়েছি ।

প্রত্যেক মানুষেই আছে একজন আমি , সেই অপরিমেয় রহস্যের অসীম মূল্য জোগায় ভালোবাসায় । অহংকারের মেকি পয়সা তুচ্ছ হয়ে যায় এর কাছে । সুনেত্রা আপন মনপ্রাণ দিয়ে এই পরম মূল্য দিয়ে এসেছে আমাকে , আজ একুশ বছর ধরে । ওর শুভ্র ললাটে কুঙ্কুমবিন্দুর মধ্যে প্রতিদিন লেখা হয় অক্লান্ত বিস্ময়ের বাণী । ওর নিখিল জগতের মর্মস্থান অধিকার করে আছি আমি , সেজন্যে আমাকে আর-কিছু হতে হয় নি সাধারণ জগতের যে-কেউ হওয়া ছাড়া । সাধারণকেই অসাধারণ করে আবিষ্কার করে ভালোবাসা । শাস্ত্রে বলে , আপনাকে জানো । আনন্দে আপনাকেই জানি আর-একজন যখন প্রেমে জেনেছে আমার আপনকে ।

বাবা ছিলেন, কোনো নামজাদা ব্যাঙ্কের অন্যতম অধিনায়ক , তারই একজন অংশিদার হলেম আমি । যাকে বলে ঘুমিয়ে-পড়া অংশিদার একেবারেই তা নয় । আষ্টেপৃষ্ঠে লাগাম দিয়ে জুতে দিলে আমাকে আপিসের কাজে । আমার শরীর-মনের সঙ্গে এই কাজটা মানানসই নয় । ইচ্ছা ছিল , ফরেস্ট্‌ বিভাগে কোথাও পরিদর্শকের পদ দখল করে বসি , খোলা হাওয়ায় দৌড়ধাপ করি , শিকারের শখ নিই মিটিয়ে । বাবা তাকালেন প্রতিপত্তির দিকে ; বললেন , ‘ যে কাজ পাচ্ছ সেটা সহজে জোটে না বাঙালির ভাগ্যে । হার মানতে হল । তা ছাড়া মনে হয় , পুরুষের প্রতিপত্তি জিনিসটা মেয়েদের কাছে দামী । সুনেত্রার ভগ্নীপতি অধ্যাপক ; ইম্পীরিএল সার্ভিস তার , সেটাতে ওদের মেয়েমহলের মাথা উপরে তুলে রাখে । যদি জংলি ‘ নিস্‌পেকেট্টর সাহেব ‘ হয়ে সোলার হ্যাট প ‘ রে বাঘ-ভালুকের চামড়ায় মেঝে দিতুম ঢেকে , তাতে আমার দেহের গুরুত্ব কমিয়ে রাখত , সেই সঙ্গে কমাত আমার পদের গৌরব আর-পাঁচজন পদস্থ প্রতিবেশীর তুলনায় । কী জানি এই লাঘবতায় মেয়েদের আত্মাভিমান বুঝি কিছু ক্ষুণ্ন করে ।

এ দিকে ডেস্কে-বাঁধা স্থাবরত্বের চাপে দেখতে দেখতে আমার যৌবনের ধারা আসছে ভোঁতা হয়ে । অন্য কোনো পুরুষ হলে সে কথাটা নিশ্চিন্ত মনে ভুলে গিয়ে পেটের পরিধিবিস্তারকে দুর্বিপাক বলে গণ্য করত না । আমি তা পারি নে । আমি জানি , সুনেত্রা মুগ্ধ হয়েছিল শুধু আমার গুণে নয় , আমার দেহসৌষ্ঠবে । বিধাতার স্বরচিত যে বরমাল্য অঙ্গে নিয়ে একদিন তাকে বরণ করেছি নিশ্চিত তার প্রয়োজন আছে প্রতিদিনের অভ্যর্থনায় । আশ্চর্য এই যে , সুনেত্রার যৌবন আজও রইল অক্ষুণ্ন , দেখতে দেখতে আমিই চলেছি ভাঁটার মুখে — শুধু ব্যাঙ্কে জমছে টাকা ।

আমাদের মিলনের প্রথম অভ্যুদয়কে আর-একবার প্রত্যক্ষ চোখের সামনে আনল আমার মেয়ে অরুণা । আমাদের জীবনের সেই উষারুণরাগ দেখা দিয়েছে ওদের তারুণ্যের নবপ্রভাতে । দেখে পুলকিত হয়ে ওঠে আমার সমস্ত মন । শৈলেনের দিকে চেয়ে দেখি , আমার সেদিনকার বয়স ওর দেহে আবির্ভূত । যৌবনের সেই ক্ষিপ্রশক্তি , সেই অজস্র প্রফুল্লতা , আবার ক্ষণে ক্ষণে প্রতিহত দুরাশায় ম্লানায়মান উৎসাহের উৎকণ্ঠা । সেই দিন আমি যে পথে চলতেম সেই পথ ওরও সামনে , তেমনি করেই অরুণার মায়ের মন বশ করবার নানা উপলক্ষ ও সৃষ্টি করছে , কেবল যথেষ্ট লক্ষগোচর নই আমিই । অপর পক্ষে অরুণা জানে মনে মনে , তার বাবা বোঝে মেয়ের দরদ । এক-একদিন কী জানি কেন দুই চক্ষে অদৃশ্য অশ্রুর করুণা নিয়ে চুপ ক ‘ রে এসে বসে আমার পায়ের কাছের মোড়ায় । ওর মা নিষ্ঠুর হতে পারে , আমি পারি নে ।

অরুণার মনের কথা ওর মা যে বোঝে না তা নয় ; কিন্তু তার বিশ্বাস , এ-সমস্তই ‘ প্রভাতে মেঘডম্বরম্‌ ‘, বেলা হলেই যাবে মিলিয়ে । ঐখানেই সুনেত্রার সঙ্গে আমার মতের অনৈক্য । খিদে মিটতে না দিয়ে খিদে মেরে দেওয়া যায় না তা নয় , কিন্তু দ্বিতীয়বার যখন পাত পড়বে তখন হৃদয়ের রসনায় নবীন ভালোবাসার স্বাদ যাবে মরে । মধ্যাহ্নে ভোরের সুর লাগাতে গেলে আর লাগে না । অভিভাবক বলেন , বিবেচনা করবার বয়েস হোক আগে , তার পরে, ইত্যাদি । হায় রে , বিবেচনা করবার বয়েস ভালোবাসার বয়েসের উলটো পিঠে ।

কয়েকদিন আগেই এসেছিল ‘ ভরা বাদর মাহ ভাদর ‘ । ঘনবর্ষণের আড়ালে কলকাতার ইটকাঠের বাড়িগুলো এল মোলায়েম হয়ে , শহরের প্রখর মুখরতা অশ্রুগদ্‌গদ কণ্ঠস্বরের মতো হল বাষ্পাকুল । ওর মা জানত অরুণা আমার লাইব্রেরি ঘরে পরীক্ষার পড়ায় প্রবৃত্ত । একখানা বই আনতে গিয়ে দেখি , মেঘাচ্ছন্ন দিনান্তের সজল ছায়ায় জানলার সামনে সে চুপ করে বসে; তখনো চুল বাঁধে নি , পুবে হাওয়ায় বৃষ্টির ছাঁট এসে লাগছে তার এলোচুলে ।

সুনেত্রাকে কিছু বললেম না । তখনি শৈলেনকে লিখে দিলেম চায়ের নিমন্ত্রণ-চিঠি । পাঠিয়ে দিলেম আমার মোটরগাড়ি ওদের

গল্পের দ্বিতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!