চেক চার্লি ১

মেসে একসাথে চার বাঙালি থাকার ইতিবাচক দিক একটাই – দিনের শেষে বাঙালি খাবার খাওয়া যায়। এ ছাড়া সব ব্যাপারে বৈচিত্র ও মতানৈক্য থাকাটা বাঙালির জাত্সিদ্ধ অধিকার। আমাদের থাকার জায়গাটাকে ১২ক ভূতের আস্তানা বললে ১২ টা ভূতই হয়ত আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে ভুগে ভুগে আবার মানুষ হিসেবে জন্মগ্রহণ করবে। আমাদের মধ্যে সবথেকে ট্যাঁশ নমুনাটি হলো সিরাজ।
সে মুসলিম নয় , পিতৃদত্ত পুরো নাম তার সিরাজ মুখার্জী ও ডাক নাম নিল। ওর দাবি ডাকনামটা ওর নিজের দেওয়া ও সেটা মানে শুন্য, যেটা কিনা ওর আসল আইডেন্টিটি , কুইজ বা অন্যকিছুর সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। নিল এক চিনা মোবাইল কোম্পানিতে কাজ করে , কিন্ত কি কাজ করে তা আজও কেউ বুঝে উঠতে পারেনি কেননা দু-তিন মাস অন্তর অন্তর একই মাইনেতে ওর পদপরিচয়টি নিয়ম করে পাল্টে যায়।

কখনও কাস্টমার রিলেশনশিপ ম্যানেজার তো কখনও লিড জেনারেশন এগজিকিউটিভ , আবার ঘুরে ফিরে প্রায়শই সে বিজনেস ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার ছাপা কার্ড নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। বড়লোক বাপের এক ছেলে, গুচ্চি বা আরমানি ছাড়া কথা বলে না, ব্লুস বা রক ছাড়া কিছু শোনে না এবং মুসুর ডাল সেদ্ধকে লেন্টিল সুপ আর গাঁজাকে গ্রাস ছাড়া কিছু বলতে পারে না। দ্বিতীয় স্যাম্পলটি বৌধায়ন মজুমদার , চশমা পড়া এক রুগ্ন রিসার্চ স্কলার যার দুটো বই তিনটে জামা নেই, নতুন জামা কেনার কথা জিজ্ঞেস করলে বলে , ‘একটা জামা তৈরী করতে কত কার্বন ডিপোসিট্ হচ্ছে আবহওয়ায় তা আন্দাজ করতে পারিস?’ একটা ক্রনিক বিরক্তি নিয়ে সারাদিন ধরে হয় সে কাশছে না হয় ভুরু কুঁচকে ঢেকুর তুলছে। কোনো কিছু তার ভালো লাগে বলে আমরা কেউ জানি না কেননা ঘি আলু সেদ্ধ ভাত খাওয়ার মত সাধারণ একটা কাজের সময়ও সে খালি টেনশন করে যায় যে শহরের এই বাতাসে টক্সিন বেড়ে গেল , ওই জলে ন্যাচারাল মিনারেল কমে গেল !
তৃতীয় স্পেসিমেনটা অনামিত্র কর, একে বিষ-হারামি বললে কম বলা হয় কেননা আমাদের যাবতীয় বাওয়ালে জড়ানো ও সে ঝামেলা থেকে উদ্ধার করার ক্ষেত্রে এর অবদান সিংহভাগ। মিডিয়া হাউস গুলোতে ফ্রিলান্সার হিসেবে ছবি তোলা, আল বাল সিরিয়ালের স্ক্রিপ্ট লেখা, ডকুমেন্টারী বানানোর নামে বিদেশী ফান্ডিং এজেন্সীর পয়সায় মোচ্ছব করা ও দিনের পর দিন কিভাবে একজন নিজেকে ক্যাজুয়ালি সাসটেইন করতে পারে তার অভিনব উপায় গুলো নিরন্তর আবিষ্কার করাটাই তার মূল কাজ। আর আমাকে তো সবাই চেনে তাই আলাদা করে আর পরিচয় দিলাম না। গল্পটা আমাদের কাউকে নিয়ে নয়, আমরা পার্শ্বচরিত্র মাত্র।

ঘটনার শুরু হুট করে অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আমাদের কুক কাম কেয়ারটেকার ছেড়ে চলে যাওয়ার পর। দু তিন দিন পরেই বেজায় কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট দেখা দিল মেস মেম্বারদের মধ্যে। কে চা করবে, কে আলু কাটবে, কে জল ভরবে এসব সুক্ষ ব্যাপার স্যাপার নিয়ে নিল ও বিজ্ঞানীর মধ্যে চব্বিশ ঘন্টা ঝামেলা লেগেই থাকে। একজন দুধ দিয়ে পাউরুটি খাবে তো অন্যজনের ফ্রেঞ্চ টোস্ট চাই। রবিবার সকালে এই ক্যাওতালের মাঝে অনামিত্র যথারীতি নিজের অন্তিম ঝাঁটটা জ্বলে যাওয়ার পরে খেপে খুপে দু এক জায়গায় ফোন করলো ও কিছু না বলেই বেরিয়ে গেল । হাব ভাব দেখে মনে হলো ও আজ কাউকে একটা ধরে বেধে নিয়ে আসবেই ।
দুপুরের আগে ফিরলোও বটে , সাথে একটা পঞ্চম নমুনা কে নিয়ে। হাতে ওর চেয়ে বড় এক বাক্স টেনে ঘেস্টে নিয়ে ঢুকলো ছেলেটি, বয়স ষোলোও হতে পারে আবার চব্বিশও হতে পারে! বোঝা মুস্কিল কেননা ওর হাইট মেরে কেটে ৪ ফুট, মানে ছেলেটি থুড়ি লোকটি বামন। কৌশিক গাঙ্গুলির ‘ছোটদের সিনেমায়’ নাকি অভিনয় করেছে , তবে কোনো ডায়ালগ ছিল না। ডায়লগ কেন ছিল না তা অবশ্য পরে বুঝলাম। কিরকম একটা ভয় পাওয়া হাসি নিয়ে সে সবার উদ্দ্যেশ্যে বলল, “ছালাম ছ্যার, মেছে এর আগে আমি কুনোদিন কাম করি লাই ..” ” নাম কি ? ” আমি জিজ্ঞেস করলাম। “চেক চার্লি , ছ্যার ..” নামটা শুনেই বৌধায়নের মুখটা আরো বিরক্তিতে ভরে গেল। নিলের এসব ব্যাপারে কোনো বক্তব্য নেই, সে ল্যাপটপে একমনে কিসব খুটখাট করে যাচ্ছে। অনামিত্র এবার খুলে বলল যে ওরে আসল নাম শেখ সৈফুদ্দিন , সার্কাসে খেলা দেখানোর সময় চার্লি চাপলিন সাজতো বলে সবাই ডাকত ‘চার্লি ‘ আর তারপর থেকে সৈফুদ্দিন উচ্চারণ করা কঠিন দেখে নিজের ওই নামটা নিজেই দিয়েছে সে ।

আমি বললাম ,” তা অনামিত্র ও কি সব কাজ গুলো করতে পারবে?” অনামিত্র কিছু বলার আগেই চার্লি বলে উঠলো , ” চিওর পারব ছ্যার , চার্কাছে ম্যালা কাজ , এতো কিচুই লয়। ” নিল হুট করে জিজ্ঞেস করে বসলো , “হ্যাশ ব্রাউনি বানাতে পারবি?” এবারে একটু ঘাবড়ে গেল চার্লি। আমি বললাম, “‘ছাড় না , খামকা ভয় পাওয়াচ্ছিস কেন বেচারাকে ?” অনামিত্র চার্লিকে বলল , “ঠিক আছে , ওই যে রান্নাঘর , চট করে চার কাপ লাল চা বানিয়ে নিয়ে আয় ততক্ষণ আমরা একটু আলোচনা করে নি ” চার্লি কোনো কথা না বাড়িয়ে চার্লি চ্যাপলিনের মতন হাটার ভঙ্গিতে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। বৌধায়ন বলল , “আজকাল এরকম অজানা লোকজনকে থানায় না জানিয়ে বাড়িতে রাখা উচিত না।

ওই জোকারটার নিশ্চই কোনো আইডি প্রুফও নেই ! ” অনামিত্র বলল , “আইডি প্রুফ কি সেটাই ও জানেনা। জন্ম একবার বলে আসামে একবার বলে বিহারে। তবে ও আমার এক পরিচিত লাইন প্রোডিউসার-এর বাড়িতে মাস চারেক কাজ করছে, ও সেই ভদ্রলোকই ওকে রেফার করলো।” বিজ্ঞানীর হাজার প্রশ্নের উত্তর সামলে, নিলের দাবি দাওয়া মেনে, চার্লির তৈরী চা খেতে খেতে মাইনে পত্তর ঠিক ঠাক করে শেষ মেষ ওকে রেখেই দেওয়া হলো। চলবে….

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়তে পারেন...

আবিষ্কার

১ ‘ টুবলু, টুবলু, টুবলু উ উ উ ‘ মার গলা, অনেকক্ষন ধরেই শুনতে পাচ্ছি। …

সরল ও হাতি

সরল এখন খুব খুশি । কারণ সরল ইশকুলে ভর্তি হয়েছে । বাবু সরলকে ইশকুলে যেতে…

পুষুর দুঃস্বপ্ন

আলমারির তাকে থরে থরে সাজানো মধুভর্তি বয়ামগুলোর দিকে তাকিয়ে পুষুর দু চোখ চকচকিয়ে উঠলো। ‘কি…